লীনা পারভীন : ধর্ম একজন মানুষের ব্যক্তিগত অনুভূতির অত্যন্ত নাজুক একটি জায়গা। যে যেই ধর্মেরই হোক না কেন, তার কাছে নিজের ধর্মই শ্রেষ্ঠ এবং সেই ধর্মের অনুসারীরা সেই রীতিমাফিক নিজেকে চালাতে চায়। এতে দোষের কিছু নেই বরং ধর্ম সৃষ্টির কাল থেকেই মানুষ নিজেকে সেই বিধিমাফিক চালাতে চেষ্টা করে। ধর্ম হচ্ছে একটি জীবনবিধান। সেখানে কী করা যাবে আর কী করা যাবে না তার একটি গাইডলাইন বলা থাকে। সেগুলোর ১০০ শতাংশ কেউ মেনে চলতে চায় আবার কেউ পারে না।
আরও পড়ুন: রানি এলিজাবেথ মারা গেছেন
আমি ধর্ম বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই বা এই লাইনে আমার জ্ঞান শূন্যের কাছাকাছি। আমার পরিবারের কমবেশী সবাই নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ধর্ম পালনের চেষ্টা করে ঠিক যেমনটা অন্য পরিবারেও হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমাদের দেশের একদল লোক সমাজের মানুষের ভেতরে বাস করা এই নাজুক জায়গাটি নিয়ে ব্যবসার ফাঁদ পেতে বসেছে।
সিনেমাটির কিছু দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসেছে যেখানে দেখা যাচ্ছে নায়ক নায়িকাকে কোলে নিয়ে আছে। নায়িকা মাছের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট লাগিয়ে একধরনের অভিব্যক্তি করছেন, যা সরাসরি তার অবদমিত আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করছে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে
ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান রাখে না এমন লোকরাও দেখি সবাইকে সবক দিতে চায়। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার আমরা প্রায়শই দেখি। সেটি নিয়েও পক্ষে-বিপক্ষে কথা আছে। ধর্ম যেহেতু ব্যক্তি বিশ্বাসের বিষয় তাই এর রাজনীতিকীকরণ মানেই হচ্ছে সেখানে একদলের স্বার্থ রক্ষা হবে আবার আরেক দল বঞ্চিত হবে। রাষ্ট্রের কোন ধর্ম হয় না কারণ এই কাঠামোতে কেবল একদল বা একই ধর্মের লোকের বাস হয় না। সেখানে নানা ধর্ম, বর্ণের মানুষ নিয়েই গড়ে ওঠে।
সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে নারীর পোশাকসহ নানা সেনসেটিভ বিষয়ে বিতর্ক চলছে। অত্যন্ত উদ্দেশ্যমূলকভাবে একদল ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাককেই দায়ী করছেন। গত কয়দিনে দেখলাম একদল ছাত্র আবার প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় নেমেছে একজন নারী কোনধরনের পোশাক পরবে আর পরবে না সেই দিকনির্দেশনা নিয়ে।
আরও পড়ুন: ব্রিটেনের নতুন রাজা চার্লস
বাস্তবে আমার পছন্দ দিয়ে আমি আরেকজনকে চালানোর চেষ্টা মানেই সেটা অন্যায়ের পর্যায়ে চলে যায়। সমাজে চলমান অস্থিরতার মাঝেই দেখলাম সিনেমা নিয়েও শুরু হয়েছে ধর্মকে ব্যবহার করে প্রচারণা। অবাক হলাম যে ‘ভাইয়ারে’ নামের সেই সিনেমার অভিনয় শিল্পীরা প্রকাশ্যে মিডিয়ার সামনে বলে বেড়াচ্ছেন এটা ‘পাপমুক্ত’ সিনেমা কারণ এই সিনেমায় নায়ক নায়িকার হাত ধরাধরির কোনো দৃশ্য নেই।
একজন তো বলেই ফেললেন ওজু করে সিনেমা হলে ঢুকলে সেই সিনেমা দেখার পর আবার নামাজ পড়া যাবে। মানে সিনেমা দেখলে ওজু নষ্ট হবে না। এখন তাকে প্রশ্ন করা উচিত যে সিনেমা দেখলে ওজু কেন ভাঙে আর এই সিনেমা দেখলে কেন ভাঙবে না? আমার জানামতে ধর্মে সিনেমায় অভিনয় করাই নিষিদ্ধ। নাচ-গান করা নিষিদ্ধ। অন্তত এমনটাই সমাজে প্রচার করেন অনেকে।
তাহলে সেই সিনেমা ‘পাপমুক্ত’ কেমন করে দাবি করা যায়? সিনেমাটির কিছু দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসেছে যেখানে দেখা যাচ্ছে নায়ক নায়িকাকে কোলে নিয়ে আছে। নায়িকা মাছের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট লাগিয়ে একধরনের অভিব্যক্তি করছেন, যা সরাসরি তার অবদমিত আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করছে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে।
আরও পড়ুন: বিশ্বজুড়ে বেড়েছে মৃত্যু
এভাবে দৃশ্য ধরে ধরেই তর্ক করা যায় কিন্তু সেটা আমার উদ্দেশ্য নয়। সিনেমা হবে সিনেমার গল্প অনুযায়ী। পরিচালক যা দেখাতে চাইবেন সেটারই দৃশ্যায়ন। সেখানে যদি আপনি সিনেমা প্রচারের ইস্যু হিসেবে ধর্মকে টানেন তাহলে আপনার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন আসে। সেই সিনেমার নায়কের বিরুদ্ধে আবার অভিযোগ আছে যে তিনি বাউল সঙ্গীত শিল্পী রীতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অবমাননার মামলা করেছিলেন যদিও পরে রীতা দেওয়ান মামলা থেকে মুক্তিও পেয়েছেন।
রীতা দেওয়ান একজন সঙ্গীত শিল্পী এবং তার বিরুদ্ধে গানের মাধ্যমে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ তুলেছিলেন এই নায়ক যিনি নিজেও একজন শিল্প জগতের মানুষ। তাহলে একজন শিল্পী হয়ে আরেকজন শিল্পীর প্রতি এতো বিরাগ কেন আসবে? আবার একই সিনেমার আরেক অভিনয় শিল্পীর একটি ভিডিও ক্লিপ ঘুরে বেড়াচ্ছে যেখানে তিনি বলছেন, সিনেমা দেখে তার কান্না পেয়েছিল কিন্তু মেকআপ নষ্ট হয়ে যাবে বলে কাঁদেননি।
এই তিনিই কিন্তু দাবি করেছেন যে তার সিনেমা পাপমুক্ত সিনেমা এবং ওজু করে সিনেমা দেখে আবার ওজু ছাড়া নামাজ পড়া যাবে। তিনি যদি এতোই ইসলামিক মানসিকতার হবেন তাহলে তার যুক্তি অনুযায়ী এমন মেকআপ করা এবং প্রকাশ্যে ক্যামেরার সামনে বেপর্দায় হাজার মানুষের সামনে কথা বলা কি ধর্মসম্মত?
আরও পড়ুন: জব্দ হচ্ছে সেই ওসির ‘পরশ মঞ্জিল’
বাস্তবে তাদের এসবই হচ্ছে মানুষের সহজ সরল অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করা। আমি ব্যক্তিগতভাবে একজন মানুষের সব প্রকার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। কে ধর্মীয় বিধি মেনে চলবে আর কে চলবে না বা কে কোন পোশাক পরবে বা পরবে না সেটাও যার যার ব্যক্তিগত রুচি ও স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়। সাধারণ মানুষ যা বিশ্বাস করে সে অনুযায়ীই চলতে পছন্দ করে। তারা যেহেতু নিজেরা বিশেষজ্ঞ নয় তাই সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের দ্বারা প্রভাবিত হয় সহজেই।
এখন সেই তারা যদি মানুষের সরলতাকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে নিজের ধান্দা করতে শুরু করে তখন এর বিরুদ্ধে কথা বলতেই হবে। সিনেমার প্রচারণার জন্য ধর্মকে ব্যবহার কোনোভাবেই সচেতন মানুষ সমর্থন করতে পারে না। এটা আরেকজন ধর্মপ্রাণ মানুষের অনুভূতিকে আঘাত করতেই পারে। সমাজের এমন নীতিহীন মানুষগুলো অতি সহজে তড়তড় করে উপরে ওঠার সিঁড়ি খোঁজে।
আরও পড়ুন: আকবর আলি খান আর নেই
আমরা কথায় কথায় মূল্যবোধকে টানি। অথচ নিজে কোন মূল্যবোধকে প্রচার করছি বা ধারণ করছি সেটা নিয়ে ভাবি না। সমাজে যখন এমন ভণ্ডদের অবাধ আচরণ বা বিচরণকে সহজ করে তোলা হয় তখনই আসলে সামাজিক মূল্যবোধ বাধাগ্রস্ত হয়। নতুন প্রজন্ম ভালোটা দেখতে ভুলে যায়। ভুলটাকেই সঠিক ভাবতে শুরু করে। তাই অবিলম্বে ধর্মকে যত্রতত্র প্রচারণার হাতিয়ার হওয়া থেকে আটকাতে হবে। প্রয়োজনে আইন করে রাজনীতি থেকে ব্যবসা সব জায়গায় ধর্মের অপব্যবহার রুখতে হবে। এতে ধর্মও বাঁচবে, মূল্যবোধও বাঁচবে।
লেখক: লীনা পারভীন, কলামিস্ট, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, ।