সুভাষ সিংহ রায়: বঙ্গবন্ধু-পরিবারের একাধিক সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। তাঁরা হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধুর জেষ্ঠ্যপুত্র শেখ কামাল, শেখ কামালের নবপরিণতা বধূ সুলতানা কামাল।
আরও পড়ুন: তিস্তার পানি বণ্টন ভারতের ওপর নির্ভর
আমাদের জানা প্রয়োজন ও নতুন প্রজন্মকে জানানো উচিত বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে তাদের কার কী ভূমিকা ছিল। যত বেশি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠ করছি তত বেশি উপলব্ধি করছি বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অবদান ছিল অনন্য সাধারণ। ১৯৪৯ সালে ২৬ মার্চ তৎকালীণ মুসলিম লীগ সরকারের প্ররোচনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবুর রহমানের ছাত্রত্ব বাতিল করে। ২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বঙ্গবন্ধুর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়। সেই বছরের ১৪ আগস্টের সিন্ডিকেট সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ১৯৪৯ সালের আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য তৎকালীন আইন বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র (রোল-১৬৬, এসএম হল) শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক্সিকিউটিত কাউন্সিল ২৬ মার্চ, ১৯৪৯ সালে যে জরিমানা ও অভিভাবক প্রত্যায়িত মুচলেকা প্রদানের ও অনাদায়ে ছাত্রত্ব বাতিলের যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল, আজকের সিন্ডিকেট সেই সিদ্ধান্তকে অগণতান্ত্রিক ও ন্যায় বিচারের পরিপন্থি হিসেবে গণ্য করে। ... তাই ১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল কর্তৃক গৃহীত উক্ত বহিষ্কারাদেশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সর্বসম্মতিক্রমে প্রত্যাহার করছে।’
১৯৪৯ সালে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের জন্য আন্দোলন করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পাঁচজন শিক্ষার্থীকে ২৬ মার্চ সাময়িক বহিষ্কার করে। ১৭ এপ্রিলের মধ্যে ভবিষ্যতে ভালো আচরণ করবে এই মর্মে সংশ্লিষ্ট প্রভোস্টের কাছ থেকে ফরম নিয়ে তাদের অভিভাবকদের নিশ্চয়তা পত্র দিলে ছাত্রত্ব ফিরে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। অন্য চারজন এই শর্ত মেনে ছাত্রত্ব ফিরে পেলেও শেখ মুজিবুর রহমান শর্ত মেনে ছাত্রত্ব ফিরে নেননি। ১৮ এপ্রিল তাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়। বলা হয়েছিল যে ১৫ রুপি জরিমানা এবং পরিবারের মাধ্যমে মুচলেকা দিয়ে তাঁরা ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। সাময়িক বহিষ্কারাদেশ পাওয়া বাকি চারজন ছিলেন এমএ প্রথম পর্বের কল্যাণচন্দ্র দাসগুপ্ত, এলএলবি দ্বিতীয় বর্ষের নাঈমউদ্দিন আহমেদ, এমএ প্রথম পর্বের ছাত্রী নাদেরা বেগম ও বিএ প্রথম বর্ষের মুহাম্মদ আবদুল ওয়াদুদ। ১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব বাতিল করে, এর ২২ বছর পর ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই গোটা ভূখণ্ড থেকে তাদের চিরতরে বহিষ্কার করে।
আরও পড়ুন: রাশিয়া যাচ্ছেন মিয়ানমারের জান্তাপ্রধান
আমরা আরো জানতে পারি ১৯৪৯ সালের ৯ মে মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করে আপস করতে বলেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন তিনি জেলারকে জানিয়ে দেবেন। দু’দিন পরে শেখ মুজিবুর রহমান চার দফা শর্ত দিয়ে উত্তর দিয়ে দেন।
1. Unconditional withdrawal of the punishment order by Dacca University authority.
2. Unconditional release of student prisoners throughout East Pakistan arrested in this connection.
3. No further victimization.
4. Withdrawal of the ban on newspapers banned in this connection.
Sd/ - Sk. Majibor Rahman
Dacca Central Jail
10.5.49
[Secret Documents Of Intelligence Branch on Father Of The Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman - 1st Part 1948-1950; Page : 71]
আরও পড়ুন: বন্যায় বিপর্যস্ত পাকিস্তান, নিহত ১৩শ
বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অনন্য সাধারণ অবদান নিয়ে বর্ণনা করতে গেলে অনেক অনেক জানা প্রয়োজন, সেটি আমাদের ক’জনেরই বা আছে। কবি মুহম্মদ রফিক লিখেছিলেন: ‘বাঙালির শুদ্ধনাম শেখ মুজিবুর রহমান’। বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতিটি সদস্য মুক্তিযুদ্ধে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। বিগত ১০-১২ বছর হলো বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ভূমিকার কথা জাতি জানতে পারছে। এ-বিষয়ে এক সময় নীলিমা ইব্রাহিমের লেখা ছাড়া খুব লেখা চোখে পড়ত না। এখন বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশের ও দেশের বাইরে অবস্থানরত প্রবাসীদের কাছ থেকে বঙ্গমাতার ছবি ও অজানা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে ও দেশ নির্মাণে বেগম ফজিলাতুন নেছার অনন্য সাধারণ ভূমিকার কথা বিশেষভাবে জানা যাচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির উদ্যোগে গত দু-বছর ধরে নানারকম কর্মসূচির আয়োজন ছিল বেশ চোখে পড়ার মতো। জাতীয় প্রচার মাধ্যমে বিশেষ করে সব ক’টি টেলিভিশনে ‘মুক্তিযুদ্ধ প্রতিদিন’ এবং ‘বঙ্গবন্ধু প্রতিদিন’ একটা গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় চিত্তরঞ্জন সাহা যে প্রকাশনা সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন তার নাম ‘মুক্তধারা’। মুক্তধারা থেকে বেশ ক’টি বই প্রকাশিত হয়েছিল। তার মধ্যে একটি বই ছিল ‘রক্তাক্ত বাংলা’; সেই বইয়ে একটি লেখার শিরোনাম ছিল ‘বঙ্গবন্ধু ও রক্তাক্ত বাংলা’। বিখ্যাত লেখক রঞ্জন সেই লেখাটি লিখেছিলেন। সেই লেখা থেকে ক’টি লাইন এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে: ‘ব্যক্তি কখনো ইতিহাসের একটি বা একাধিক পঙ্ক্তি, পৃষ্ঠা বা অধ্যায় হয়ে উঠেন, কখনো গোটা ইতিহাস হয়ে উঠেন। যিনি শুধু জাতির উত্থানে নেতৃত্ব দেন বা পতনে জড়িত থাকেন বা এই উত্থান-পতন পর্বেই নিজের ব্যক্তিত্বের সম্প্রসারণ সীমাবদ্ধ রাখেন, তিনি ইতিহাসের এক বা একাধিক অধ্যায়। কিন্তু যিনি জাতির উত্থানে-পতনে, সুখে-দুঃখে মিশে গিয়ে নিজের সুখ, দুঃখ, উত্থান, পতন, জীবন ও মৃত্যুকে এই ইতিহাসের ধারায় সমর্পিত করেন, ইতিহাসের অতীত ও বর্তমানের ঐতিহ্যে স্থিত হন, আবহমান ইতিহাসের স্রোতকে সংগ্রাম ও সাধনায় অধঃপত থেকে ঊর্ধ্বমুখী করার চেষ্টা করেন, তিনিই ইতিহাসের মানসপুত্র, গোটা ইতিহাসের প্রতিভূ, জাতির স্রষ্টা, নবনায়ক। জগলুল-নাহাশ মিশর ইতিহাসের এক একটি অধ্যায়। নাসের গোটা ইতিহাস। নওরোজী, গোখলে, মালব্য, মোহাম্মদ আলী ভারতের ইতিহাসের এক একটি অতি উজ্জ্বল অধ্যায়। গান্ধী সমগ্র ইতিহাস। ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী বাংলাদেশের ইতিহাসের খণ্ড খণ্ড অধ্যায়। মুজিব সমগ্র ইতিহাস।”
আরও পড়ুন: প্রেমিকের বিয়ে, প্রেমিকার আত্মহত্যা
শেখ হাসিনা ১৯৫৬ সালে টিকাটুলির নারীশিক্ষা মন্দির বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে থাকা শুরু করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি আজিমপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। শেখ হাসিনা ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। নিজের সময়ের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “৬২ সাল থেকে যখন আজিমপুর স্কুলে পড়তাম, স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব খুব কড়া ছিলেন। তাই অনেক সময় দেয়াল টপকে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসতাম মিছিল-মিটিংয়ে যোগ দিতে।” ওই সময়ের মিছিলের সঙ্গে এখনকার মিছিলের পার্থক্যও বলেন তখনকার ছাত্রলীগের সংগঠক শেখ হাসিনা। “এখন তো মিছিলের জায়গা খুবই কম। আমরা মিছিল করতাম সেই পুরান ঢাকায়। ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের সামনে থেকে আমরা মিছিল নিয়ে যাবই, যাতে যারা কারাগারে আছে, তাদেরকে উৎসাহিত করা যায়। চকবাজার, মৌলভীবাজার, নবাবপুর হয়ে পুরো এলাকা আমরা ঘুরতাম তখন। লম্বা পথ পাড়ি দিতাম মিছিল করতে করতে। সারাদিন আমরা মিছিলে থাকতাম। এভাবেই কিন্তু আমরা সংগ্রাম গড়ে তুলেছি।”
চার দশকের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর পদে থাকা শেখ হাসিনা ছাত্রলীগে বিভিন্ন পদে ও ছাত্র সংসদের দায়িত্বে থাকার কথাও বলেন। “আমি ছিলাম ছাত্রলীগের একজন ক্ষুদ্র কর্মী। বদরুন্নেছা কলেজ যেটা; সে সময় ছিল ইডেন ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজ, সেই কলেজে আমি নির্বাচিত ভিপি ছিলাম।” “ছয় দফা দেবার পর যখন আব্বা, আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ, ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ সবাই কারাগারে বন্দি। ঠিক ওই সময় নির্বাচন করাটা কঠিন ছিল। কিন্তু সেই নির্বাচনে আমরা জয়ী হয়েছিলাম।” ওই কলেজে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন শেখ হাসিনা। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। বিভিন্ন পদে ও ছাত্র সংসদের দায়িত্বে থাকলেও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে কোনো পদ না পাওয়ার ‘দুঃখের’ কথাও শোনান শেখ হাসিনা। সেইসঙ্গে তিনি বলেন, “সত্য কথা বলতে কি, পদ পেলাম আর না পেলাম, সে চিন্তা করে রাজনীতি করিনি। আমরা রাজনীতি করতাম জনগণের জন্য, দেশের জন্য, ছাত্রদের সমস্যা আমরা তুলে ধরতাম।”
শেখ হাসিনা ২৬ আগস্ট ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। তখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান। তিনি হয়তো গল্পের সেই রাখাল বালকের মতো উপলব্ধি করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অভিঘাতেই তার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে। এ কারণে তিনি বঙ্গবন্ধুকে হয়রানি ও নিঃশেষ করে দেওয়ার সবরকম প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। সে সময় সুধীমহলের সবাই জানতেন, গভর্নর মোনায়েম খানের প্রধান প্রতিপক্ষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ছিলেন তারই নিয়োজিত ড. ওসমান গণি। তিনিও ব্যক্তিগতভাবে প্রবল আওয়ামী লীগ বিদ্বেষী ছিলেন। সেই প্রতিকূল সময়ে শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য যান। কিন্তু ড. ওসমান গণির আক্রোশের ভয়ে সে সময় সরকারের প্রবল প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা, কারাবন্দি ও বিচারাধীন শেখ মুজিবের মেয়েকে ভর্তি করতে অনেক বিভাগ আগ্রহী ছিল না। সে সময় শেখ হাসিনাকে বাংলা বিভাগে ভর্তি করার বিষয়ে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঢাকা জেলে বন্দি ছিলেন। সেখানেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর আগ্রহে শেখ হাসিনা বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। তারপর তিনি নিয়মিত ক্লাস শুরু করলেন। শেখ হাসিনা লেখাপড়া ও শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়ে খুবই মনোযোগী ছিলেন। অত্যন্ত প্রাণোচ্ছল শেখ হাসিনা সহপাঠীদের সঙ্গেও ছিলেন খুব আন্তরিক। শিক্ষকদেরও তিনি অপরিসীম শ্রদ্ধা করতেন। সদালাপী ও সরলতায় তিনি অল্পসময়ে সবার আপন হয়ে ওঠেন।
আরও পড়ুন: স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি ঘোষণা
শেখ হাসিনা এখন বাঙালি জাতির বিকল্পহীন অবলম্বন। গত চার দশকের অধিক সময় আওয়ামী লীগ ও বাঙালি জাতিকে তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর এই সুদীর্ঘ পথচলা ফুলের পাপড়ি বিছানো ছিল না মোটেই। বরং ছিল পথে পথে বাঁধা। সর্বশেষ দেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে ‘মাইনাস ফর্মুলা’ বাস্তবায়নের অপচেষ্টায় ২০০৭ সালের ইয়াজউদ্দিন-মইনউদ্দিন- ফকরুদ্দিন সরকার কারাবন্দি করেছিল শেখ হাসিনাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহস্রাধিক সদস্য সুধা সদন ঘিরে রেখেছিল; যেন এক রণ-প্রস্তুতি। নিতান্ত অমানবিকভাবে ও অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় সিএমএম কোর্টে; প্রেরণের আদেশ হয় কারাগারে। রাখা হয় তাঁকে সংসদ চত্বরে স্থাপিত সাব-জেলে। সেখানে দুঃসহ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়েছে তাঁকে। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক অঙ্গীকার, দৃঢ়চেতা মনোবল আর অকৃত্রিম দেশপ্রেম সেদিন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। গ্রেপ্তারের আগে দেশবাসীর উদ্দেশে লেখা তেজোদীপ্ত চিঠি আর আদালত প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে তাঁর ৩৬ মিনিটের প্রদত্ত ভাষণ আমাদের ভগ্নহৃদয়কে আশান্বিত করেছিল, আমরা উজ্জীবিত হয়েছিলাম।
মহানগর আওয়ামী লীগের সংগ্রহ করা ২৫ লাখ স্বাক্ষর, দেশ-বিদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের প্রতিবাদ, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে অনুপ্রাণিত অজস্র মানুষের অবিরাম প্রয়াস ও প্রার্থনার সঙ্গে যুক্ত হয় বাঙালির জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বাতিঘর এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্জে ওঠা; বিশ্ববিদ্যালয়টি তার অতীত সংগ্রামী ঐতিহ্যের অনুসরণেই সেদিন শেখ হাসিনার গ্রেপ্তারের তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং তাঁর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই আন্দোলনে তখন মোটা দাগে ৩টি বিষয় জোরালোভাবে উঠে আসে। প্রথমত, শেখ হাসিনা ও শিক্ষকদের মুক্তি; দ্বিতীয়ত, অবিলম্বে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার এবং তৃতীয়ত, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। আমাদের আন্দোলনের ধাপসমূহের মধ্যে ৩টি ছিল অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, উপরিউক্ত ৩ দাবিতে গণমাধ্যমে ১৬৭ জন শিক্ষকের স্বাক্ষরসংবলিত বিবৃতি প্রদান; দ্বিতীয়ত, শিক্ষক সমিতির তলবি সভা আহ্বান এবং তৃতীয়ত, নিপীড়ক সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ, ঘৃণা প্রকাশ আর ধিক্কারের প্রতীক হিসেবে কলাভবনের শীর্ষ চূড়ায় কালো পতাকা উত্তোলন।
বঙ্গবন্ধুর জেষ্ঠ্যপুত্র শেখ কামাল । কবি সুকান্ত মাত্র ২১ বছর বেঁচে ছিলেন । শেলী, কীটস্, বায়রন বেশী দিন বাঁচেননি; শেখ কামালের ছিল মাত্র ২৬ বছরের জীবন। এই অল্প বয়সে জীবনে কত কি না করেছেন! মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বিশাল অবদান ছিল। ক্রীড়াক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা, সঙ্গীতাঙ্গনে তাঁর অবদান, নাট্যাঙ্গনে অনবদ্য ভূমিকার কথা নতুন প্রজন্মের জানা প্রয়োজন। কেননা বর্তমান প্রজন্ম শেখ কামালকে কতটুকুই জানে বা জানার সুযোগ পেয়েছে। কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক তাঁর উপন্যাসে বিষয়টা এমনভাবে তুলে এনেছেন: ‘ছেলে হলে কী নাম রাখবেন? জেলে বসে আমি এই কথাটা অনেক ভেবেছি। তুর্কি বীর কামাল পাশার নামে নাম রাখব। তুমি কী বলো? ছেলে হলে নাম রাখব ‘শেখ কামাল’। রেণু বললেন সুন্দর নাম।’’
প্রকৃত অর্থে সেটাই শেখ কামাল নামকরনের ইতিহাস। ২২ বছর বয়সে শেখ কামাল মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন। আবার যুদ্ধফেরত এই মুক্তিযোদ্ধা নিজেকে সামরিক বাহিনী থেকে সরিয়ে নিয়ে আসেন গণমানুষের কাতারে। ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট ওয়ার কোর্স’-এর কমিশন পেয়ে তিনি মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। যতদিন বেঁচে ছিলেন কেবল ছুটেছেন নতুন সৃষ্টির নেশায়। রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, খেলা, সংস্কৃতি সব অঙ্গনে দাগ কেটেছেন শেখ কামাল। সমাজ বদলানোর জন্যই যে তাঁর জন্ম হয়েছিল। অভিনেত্রী ডলি জহুরের বিশ্বাস, “কামাল ভাই বেঁচে থাকলে দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের মাথা হয়ে থাকতেন।” বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তওরিক হুসেইন বাদল কোনো অঙ্গনের জন্য আলাদা করতে পারে না কামালকে, “কামালকে নির্দিষ্ট করে কোনো ছাঁচে ফেলা মুশকিল। একদিকে তার রাজনীতি, সেই কলেজ-জীবন থেকে তার সরব উপস্থিতি। তারপর মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছে। পাশাপাশি নাটক করছে। সেতার বাজাচ্ছে। আবার নিজে খেলছে, আবাহনী গড়ছে। এমন বহুমাত্রিক চরিত্রের তরুণ খুঁজে পাওয়া দায়। চাইলে কেউ হতে পারবে না, ‘ঈশ্বর প্রদত্ত’ কিছু না থাকলে এমন হওয়া যায় না।”
আরও পড়ুন: স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি ঘোষণা
এ-রকম ক্ষণজন্মা মানুষদের হাতেই সমাজের খোলনলচে বদলে যায়। শেখ কামালের ২৬ বছরের কর্মজীবনে আছে অনেক বদলানোর ছবি। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে তাঁর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়ার স্মৃতি থেকে সমাজবিজ্ঞানের সহপাঠী তত্তরিক হুসেইন বাদল বলেন, “আমরা গিয়েছিলাম পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী মেলায় অংশ নিতে। সেবার এখানকার অনেক নাটকের দল গিয়েছিল সেখানে। ডাকসু থেকে আমরা গিয়েছিলাম নাটকের দল নিয়ে। সেই দলের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম স্যার (বর্তমানে জাতীয় অধ্যাপক)। নাটকের নাম ‘কেউ কিছু বলতে পারে না’। জর্জ বার্নার্ড শ’র লেখা অনুবাদ করেছিলেন নাট্যকার মুনীর চৌধুরী। কামাল তাঁর প্রধান চরিত্র, বিপরীতে ছিলেন ফেরদৌসী মজুমদার। আমি প্রম্পটিং এবং অভিনয় করেছি। তখনো পাসপোর্ট হয়নি, পারমিট নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার জীবনের প্রথম প্লেনে চড়া। কলকাতায় নামার পর আমাদের এয়ারপোর্টে বরণ করে নিয়েছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়, আকাশবাণীর জনপ্রিয় খবর পাঠক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অনেকে। আমাদের সেই দলে ছিলেন আনোয়ার হোসেন দিলু, হাবিবউল্লাহ হাবিব, আসলাম ভূঁইয়া, যারা পরে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন।”
উল্লেখ করা যেতে পারে সলিমুল্লাহ হলের বার্ষিক নাটকে শেখ কামাল নিয়মিত অভিনয় করতেন। প্রয়াত শিক্ষাবিদ আবুল ফজল শেখ কামালকে যেভাবে মূল্যায়ন করেছেন তা পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করছি: ১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই শেখ কামালের সাথে সুলতানা খুকী বিয়ে হয়েছিল। সুলতানা কামাল ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লু খেতাব প্রাপ্ত । এবং গোটা পাকিস্তানের ভিতরে প্রতিযোগিতায় উচ্চ লম্ফে স্বর্ণপদক জিতেছিলেন। মাত্র একমাসও হয়নি তাদের বিয়ের বয়স তখনই ঘটে বাঙালি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ড।
আমি একটা বিষয় লক্ষ করেছি, এখনকার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের একটা বড় অংশ বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুর পরিবার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানেন না। অথচ দেশবিরোধী শক্তির সমর্থকরা তাদের নিজেদের প্রয়োজনে (প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ভালো করবার জন্যে ) এসব বিষয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি জানার চেষ্টা করতে দেখা যায়। বঙ্গবন্ধুর সপরিবারের হত্যাকাণ্ডের পর ৪৭ বছর পার হয়ে গেছে এখনও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পিছনের কুশীলবদের আমরা চিহ্নিত করতে পারিনি কিংবা জাতির সামনে উন্মোচিত করতে পারিনি। তার জন্যে প্রয়োজন সঠিক ইতিহাস জানা ও সবাইকে জানানো। শোক থেকে জেগে উঠুক শক্তি; শোক থেকে যেন আমরা জাগরণ ঘটাতে পারি।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক