অজয় দাশগুপ্ত : আজ থেকে ৫০ বছর আগের কথা। আমি তখন গোঁফ গজানো কিশোর। টিন এইজের প্রায় শেষ ধাপে। বাড়ি থেকে সিনেমা দেখতে যাবার চল ছিল। মাঝেমধ্যে ম্যাটিনি বা ইভিনিং শো দেখে আসতাম সবাই মিলে।
আরও পড়ুন: আমরা ব্যয় সংকোচন করছি
সদ্য স্বাধীন দেশে ভারতীয় বাণিজ্যিক ছবি আর মুক্তিযুদ্ধের আগে নির্মিত ফাইল চাপা পড়া ছবিগুলো চলতো দেদারসে। এর ভেতরেই মুক্তি পেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম ছবি ‘ওরা ১১ জন’। তখন দুইভাবে প্রচার প্রচারণা হতো। এক, রিকশা চড়ে মাইক হাতে শহরময় ঘুরে বেড়ানো লোকটি সুর করে করে বলতো অমুক হলে মুক্তি পাচ্ছে অমুক ছবি।
দুই, আরেকটি প্রচার মাধ্যম ছিল শহরময় পোস্টার। পাড়া মহল্লার দেয়ালে দেয়ালে শোভিত পোস্টারগুলো খুঁটিয়ে দেখতাম আমরা। সে পোস্টার দেখেই ঠিক করেছিলাম প্রথম দিনেই দেখতে হবে সিনেমাটি।
চট্টগ্রাম শহরের সিনেমা হলে সেদিন অন্য এক দৃশ্য। সকাল ১০টা-১১টা থেকে টিকিটের জন্য লাইন। সে লাইন বাড়তে বাড়তে কুণ্ডলী পাকিয়ে চলে গেছে দূর থেকে দূরে। এমন লাইন ভেদ করে কিশোর উত্তীর্ণদের টিকেট পাওয়া দুঃসাধ্য। তাও ব্ল্যাকে মানে কালোবাজার থেকে বেশি দামে টিকিট কেটে ‘ওরা ১১ জন’ দেখেছিলাম আমরা।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এর আগে পরে অনেক ছায়াছবি নির্মিত হয়েছে। বীরোত্তম কাদের সিদ্দিকীর কাহিনি নিয়ে ‘বাঘা বাঙালি’, মমতাজ আলীর ‘রক্তাক্ত বাংলা’ মনে রাখার মতো মুভি। তখন না বুঝলেও এখন ঠিক বুঝতে পারি কেউ কেউ কায়দা করে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটাক্ষ করতেও ছবি বানিয়েছেন। মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়ার জন্য এদের ‘অমানুষ’ বলার অপচেষ্টায় ছবির নাম দেয়া হয়েছিল ‘আবার তোরা মানুষ হ’। কেন? মুক্তিযোদ্ধারা কি মানুষ ছিলেন না? যাঁরা দেশের জন্য জান বাজী রেখে লড়াই করেন তাঁরা তো মহামানব। এসব মহানদের ‘অমানুষ’ বলার ধৃষ্টতা দেখেছি আমরা।
আরও পড়ুন: বড় ধাক্কা খেয়েছে মমতার তৃণমূল কংগ্রেস
বলছিলাম ‘ওরা ১১ জন’ ছবিটির কথা। সে সময় সারা দেশ কাঁপিয়ে তোলা এই ছবির নায়ক ছিলেন নবাগত খসরু। বীর মুক্তিযোদ্ধা খসরু আজীবন বঙ্গবন্ধু অনুগত এক মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর অভিনয় জীবন বা অভিনয় প্রতিভা বড় বিষয় না, বিষয় ছিল একজন খাঁটি মুক্তিযোদ্ধার ছায়াছবিতে নায়ক হওয়া। আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা সোহেল রানা ছিলেন এই ছবির প্রযোজক। চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘ওরা ১১ জন’-এ নায়ক রাজ রাজ্জকও অভিনয় করেছিলেন। সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিল রাজাকার চরিত্রে এ টি এম শামসুজ্জামান। এই ছায়াছবিতে ফিরে এলেন রবীন্দ্রনাথ। বাঙালির মন মননে বহুদিন বেজেছে, ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা। এখনো চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই রাইফেল কাঁধে খসরু গ্রামে ঢুকছেন, নেপথ্যে গীত হচ্ছে এই গান। ‘ওরা ১১ জন’র গান, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলো যারা’ এতো বছর পরও মানুষের মনে জাগরুক।
আরও পড়ুন: সৌদিতে চাকরি বদলানোর সুযোগ
৫০ বছর পূর্বে মুক্তিযুদ্ধের এই ছবির আবেগ ও বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি আমরা। সোহেল রানা, চাষী নজরুল ইসলাম দল বদল করেছেন। খসরু হয়ে গেছেন অদৃশ্য। কিন্তু ইতিহাস তো বদলায় না। বদলায় না অতীত। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে ‘ওরা ১১ জন’ অনাদিকাল তার গৌরব ও মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকবে।
‘ওরা ১১ জন’ মুক্তিযোদ্ধা তথা দেশের সব যোদ্ধাদের জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। আমরা তোমাদের ভুলবো না।জন ব্যারিস্টার সুমনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
প্রবাসী