অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার : উন্নত মুসলিম দেশগুলোয় কোরবানির জন্য রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। যিনি বা যাঁরা কোরবানি দেবেন, তিনি বা তাঁরা নিজেদের পালিত পশু বা পছন্দসই গৃহপালিত পশু ক্রয় করে নির্ধারিত স্থানে দিয়ে দেন। ঈদের দিন পশুগুলোকে সরকারিভাবে হালাল ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে জবাই করে, চামড়া, হাড়-মাংস ও বর্জ্য আলাদা করে, শুধু হাড়-মাংস পশুর মালিকের কাছে হস্তান্তর করা হয়। অতঃপর চামড়া প্রক্রিয়াজাতের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়। রান্নার অনুপযুক্ত হাড় ও অন্য বর্জ্যগুলো সঠিকভাবে ডাম্পিং বা পুনর্ব্যবহারের জন্য প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এতে পরিবেশ যেমন সুন্দর থাকে, পাশাপাশি কোরবানির মাংস রোগ-জীবাণুমুক্ত থাকে।
আরও পড়ুন: দায়িত্ব নিলেন নতুন গভর্নর
কিন্তু কোরবানিতে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট পুরোটাই উল্টা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা নিজেরাই নিজেদের পশু জবাই করি। অতঃপর চামড়া, হাড়-মাংস ও বর্জ্য আলাদা করি। কাজে দক্ষতা না থাকায় এবং অসাবধানতাবশত মাংসে রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে; অদক্ষ হাতের কারণে চামড়ার গুণগত মান নষ্ট হয় এবং সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, পরিবেশ দূষণ হয়। যত্রতত্র পশুর মলমূত্র, পশুর অবশিষ্ট খাদ্য, জবাই করা পশুর রক্ত, নাড়িভুঁড়ি, পাকস্থলীর বর্জ্য, হাড়, শিং, কান, মাথার চামড়া এবং রক্তে সিক্ত থাকা চাটাই (পাটি) ইত্যাদি আমরা যেখানে-সেখানে ফেলে রাখি। ফলে নোংরা হয় পরিবেশ।
অথচ একটু পরিবর্তনের ছোঁয়া পেলেই বর্জ্য সম্পদে পরিণত হবে। মানুষের খাদ্যাভ্যাসে গরু বা ছাগলের ভুঁড়ি অনেক আগে থেকেই আছে, যা অনেকের কাছে 'বট' নামে পরিচিত; আবার কিছু মানুষ নাড়িও খেয়ে থাকে। সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত করে প্রস্তুত করে রান্না করতে পারলে এগুলো বেশ মজাদার হয়। পশুর নাড়িভুঁড়ি, পাকস্থলীর বর্জ্য মাছের উপাদেয় খাদ্য। রক্তে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন; রক্ত থেকে পুষ্টিকর পশুখাদ্য তৈরি সম্ভব। অন্যদিকে হাড়ের গুঁড়া হাঁস-মুরগির উৎকৃষ্ট খাদ্য এবং এটি সার হিসেবেও জমিতে ব্যবহার করা যায়; হাড়-শিং থেকে বোতাম, তৈজসপত্র, ওষুধ, গৃহসজ্জার সামগ্রী ইত্যাদি প্রস্তুত করা যায়।
আরও পড়ুন: ছুটি শেষে খুললো অফিস
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-এর এক আলোচনা সভা থেকে জানা যায়, আকারভেদে একটি গরুতে ১৫ থেকে ২৫ কেজি হাড় উচ্ছিষ্ট হয়। আন্তর্জাতিক বাজার, বিশেষ করে চীন ও থাইল্যান্ডে গরুর হাড়ের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। পবার সূত্র থেকে আরও জানা যায়, বর্তমানে কোরবানির গরুর হাড়ের বাজারমূল্য প্রায় ৬৫ কোটি টাকা এবং কোরবানির মৌসুমসহ বছরের মোট জবাইকৃত গরুর হাড়ের বাজারমূল্য প্রায় ১৪০ কোটি টাকা। প্রতি বছর ল্যান্ডফিল থেকে গরুর হাড়-শিং পৃথক ও সংগ্রহ করে সিটি করপোরেশন নিজস্বভাবে লাভবান হতে পারে অথবা এ ব্যাপারে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করে তৃতীয় পক্ষকে ইজারা দেওয়া যেতে পারে।
বিগত বছরগুলোতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও উত্তর সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে কোরবানির পশু জবাইয়ের জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়েছিল। পর্যাপ্ত প্রচারণা ও সুযোগ-সুবিধার অভাবে এই কার্যক্রমে জনগণ স্বতঃস্ম্ফূর্ত অংশ নেয়নি। বর্জ্য সংগ্রহের সুবিধার জন্য প্রতি বছর সিটি করপোরেশন থেকে কোরবানির কিছুদিন আগে থেকে পলিব্যাগ বিতরণ করা হলেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় তেমন সুবিধা হচ্ছে না। সাধারণ মানুষের মতে, পলিব্যাগগুলো আকারে ছোট হওয়ায় একটি স্বাভাবিক আকারের গরুর বর্জ্য ধারণ করা সম্ভব নয়; ফলে অনেকেই এসব বর্জ্য ড্রেনে বা রাস্তায় ফেলে রাখছে।
আরও পড়ুন: সড়কের জন্য কোথাও যানজট হয়নি
ঈদের সময় সিটি করপোরেশনের অনেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী বাড়িতে চলে যান এবং তাঁদের পরিবর্তে কেউ থাকেন না; ফলে কম লোকবল নিয়ে বর্জ্যের স্তূপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। কোরবানির ঈদে নদীর স্বাস্থ্যের কথা ভুলে গেলে চলবে না। একে তো ঈদের সময় ঢাকার সব ড্রেন হয়ে বিপুল পশুবর্জ্য নদীতে গিয়ে মিশছে; পাশাপাশি ট্যানারি শিল্পের জন্য প্রধান কাঁচামাল 'চামড়া' প্রক্রিয়াকরণে শিল্পকারখানা থেকে বিপুল তরল বর্জ্য নদীতে মিশে যায়। যেহেতু সাভারের হেমায়েতপুরে অবস্থিত চামড়া শিল্পনগরীর কেন্দ্রীয় পরিশোধনাগার চাহিদার তুলনায় কম সক্ষমতার; তাই ট্যানারি মালিকদের কাছে অনুরোধ থাকবে, নিজস্ব ইটিপিগুলো যেন ২৪ ঘণ্টা পরিচালনা করেন। প্রয়োজনে কাঁচা চামড়া গুদামে রেখে সিইটিপির সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্য করে ধীরে ধীরে প্রসেস করা। এ ব্যাপারে শিল্প মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভূমিকা প্রত্যাশিত।
বন্যাকবলিত এলাকায় কোরবানি করার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বন্যাকবলিত এলাকায় এমনিতেই পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়; সঙ্গে খাদ্য ও ওষুধের সংকটের ফলে পরিস্থিতি হয়ে উঠে আরও ভয়াবহ। বন্যাকবলিত এলাকায় পশুহাট স্থাপন করা এবং পশু কোরবানিসহ সর্বক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যেন হাটের বর্জ্য, পশুর বর্জ্য ও উচ্ছিষ্ট যত্রতত্র পড়ে না থাকে, বিশেষ করে পানিতে যেন না মিশে যায়। অপেক্ষাকৃত উঁচু ও শুস্ক স্থানে হাট স্থাপন করতে হবে এবং পশু জবাই করতে হবে। বর্জ্য ব্যস্থাপনার জন্য শুস্ক মাটিতে গর্ত করে পুঁতে ফেলা যেতে পারে অথবা পলিব্যাগে করে যে এলাকায় বন্যা নেই, সেখানে ব্যবস্থাপনা করা যেতে পারে।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ ও যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)
সান নিউজ/এফএ