ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম : আবহমানকাল ধরেই বাংলাদেশের মানুষ বন্যা নামক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয়। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এখানে ভারি বর্ষণ অনিবার্য। বাংলাদেশে সাধারণত আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুই মাসে বন্যা দেখা যায়। তবে বর্ষার অনেক পরও কোনো কোনো সময় বন্যা দেখা দেয়। তবে পাহাড়ি ঢল বা উজান থেকে আসা পানিতেই আমাদের দেশে অধিকাংশ সময় বন্যা হয়। প্রতিবছর দেখা যায় বর্ষার শুরুতেই প্রথমে আসাম ও পরে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা দেখা দেয়। এতে দেশের নিচু অঞ্চলগুলো তলিয়ে যায়।
আরও পড়ুন: সেতু-উড়াল সড়ক নির্মাণের নির্দেশ
অতিবৃষ্টি, নিচুভূমি, বফরগলা পানি, নদীর তলদেশ ভরাট, নদীপথে বাধা, অপরিকল্পিত রাস্তা-ঘাট, সমুদ্রে জোয়ার- এসব কারণে সৃষ্ট ছোট-বড় বন্যায় দেশের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছেই। প্রতিবছর বন্যায় লাখ লাখ মানুষ বসতিহীন বা আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে; ফসলের ক্ষতি হয়; যোগাযোগ ব্যবস্থায় ক্ষতি হয়। বন্যা-পরবর্তী সময়ে দূষিত পানি ও বায়ুর প্রভাবে নানা রকম রোগ দেখা দেয়। বন্যাকবলিত দেশে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা কষ্টকর। দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ে। গ্রামের দরিদ্র মানুষ সবকিছু হারিয়ে জীবিকার সন্ধানে শহরের দিকে ধাবিত হয়।
দীর্ঘকাল ধরে এ দেশের মানুষ বন্যা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৬০ সালে ত্রিপুরার জমিদার গোমতী নদীর দুই তীর বরাবর বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেন। ওই সময় সুনামগঞ্জের জমিদারও বন্যা নিয়ন্ত্রণে কৃষকদের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন এবং ফসলের অংশের বিনিময়ে শনির হাওড়ে বাঁধ নির্মাণ করেন। ১৯৫৪-৫৫ সালের বিপর্যয়কর বন্যার পর পূর্ব পাকিস্তান ওয়াপদা প্রতিষ্ঠা হয়। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত ৫৮টি বন্যা নিয়ন্ত্রণের সমীক্ষা ও কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। অবশ্য পরে আর সেসব সমীক্ষা অনুযায়ী কাজ করা হয়নি।
আরও পড়ুন: রাশিয়া ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী সংগঠন’
বাংলাদেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-ভরাট হয়ে যাওয়া নদীগুলো খনন করা, বৃষ্টির পানি যাতে বড় বড় নদীতে দ্রুত নেমে যেতে পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক খাল ও নালা খনন করা, প্রয়োজনে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা, নদী ও খালের উভয় তীরে বেড়িবাঁধ দিয়ে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোকে বন্যার প্রকোপ থেকে রক্ষা করা। বন্যার পূর্ববতী, বন্যাকালীন ও বন্যার পরবর্তী সময়ে কি করণীয় সে সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো দরকার।
বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর যৌথ প্রচেষ্টায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা এবং বন্যা সম্পর্কে সতর্কবার্তা প্রদানের ব্যবস্থা করা। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার ও পানি উন্নয়ন বোর্ড বন্যা নিয়ন্ত্রণে কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীর আড়াই লাখ কিউসেক পানি মেঘনা নদীতে সরানোর ব্যবস্থা করে ময়মনসিংহ, সিলেট জেলার তিন লাখ একর জমি বন্যার হাত থেকে রক্ষার উদ্যোগ, ব্রহ্মপুত্র বাঁধ নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প-২ উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প। তবে এসব প্রকল্প গ্রহণই যথেষ্ট নয়। হাওড় এলাকার আরও প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।
আরও পড়ুন: এক্সপ্রেসওয়ের টোল ১ জুলাই শুরু
রাজধানী ঢাকা শহররক্ষা বাঁধ (বেড়িবাঁধ) নির্মাণ করে ঢাকাকে রক্ষা করা হয়েছে। রাজশাহীতেও এ জাতীয় বাঁধের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরকারি-বেসকারিভাবে বন্যা সমস্যা সমাধানের জন্য বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। এ ছাড়া নদী ও সাগর উপকূলে বাঁধ নির্মাণের ফলেও সে এলাকার লোক বন্যার কিছুটা হলেও রক্ষা পাচ্ছে। বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসন কার্যক্রম যথেষ্ট নয়।
২০০৪ সালে বন্যার সময় জাতিসংঘ বন্যা-পরবর্তী ৬ মাসে তিন কোটি হতদরিদ্র মানুষকে সাহায্য করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন জানিয়েছিল। এ ছাড়া বন্যার্তদের জন্য চীন ১ লাখ ডলার নগদ অর্থ ও ১০ লাখ ডলারের নির্মাণসামগ্রী দিতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেসব প্রতিশ্রুতির যথাযথ বাস্তবায়ন ঘটেনি। এসব পুনর্বাসন কাজে অন্যের ওপর ভরসা করলে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হতে পারে। বিশ্বের অনেক দেশই এখন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বন্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা করছে।
আরও পড়ুন: বিরোধী দল দমনে হিংস্র রূপে সরকার
তাই আমাদেরও উচিত এ ব্যাপারে সচেষ্ট হওয়া এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা। বিশেষজ্ঞদের মতে আমাদের বন্যার প্রধান কারণ হচ্ছে উজানের পানি। এ সমস্যা সমাধানের জন্য ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে আলোচনা করে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। বন্যার ক্ষয়ক্ষতি বেড়েই চলেছে। কাজেই এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক হতে হবে এবং পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করতে হবে।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার; পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড