আবু আহমেদ: দেশের বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি নতুন কোনো বিষয় নয়। তারা ওঁৎ পেতে থাকে, কখন ঝোপ বুঝে কোপ মারা যায়। অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও সত্য, এই অশুভ প্রবণতার খেসারত দিতে হয় বা হচ্ছে ভোক্তাকে ব্যবস্থাপনাগত নানা ত্রুটির কারণে। সম্প্রতি ভোজ্যতেল নিয়ে বাজারে যে তুঘলকি কাণ্ড পরিলক্ষিত হলো, তা এ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থা ও বিদ্যমান নানামুখী সংকটের কারণে ভোগ্যপণ্যসহ জ্বালানির দামের ক্ষেত্রে যে অস্থিতিশীলতা দেখা গেছে বা যাচ্ছে, এ থেকে খুব সহজেই মনে হয় বের হয়ে আসার উপায় নেই। কিন্তু এর সুযোগ যাতে মুনাফাবাজরা তাদের পকেট স্ম্ফীত করার স্বার্থে নিতে না পারে; গভীর নজর রাখা উচিত সেদিকে।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, রমজানে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানো আমাদের দেশে অসাধু ব্যবসায়ীদের অভ্যাসগত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। সরকারের সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীসহ দপ্তর-অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বরাবরের মতো হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেও এর সুফল পায়নি ভোক্তারা। অসাধুরা রমজানকে উছিলা করে মুনাফাবাজি চালায়। এবার ঈদের ৪-৫ দিন আগে থেকেই বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট প্রকট হয়ে ওঠে। দায়িত্বশীল কোনো কোনো মহল থেকে বলা হয়, রমজানের পর আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হবে। তখনই তৎপর হয়ে ওঠে মজুতদাররা। পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মুনাফা লোটার এমন নজির আমাদের এখানে অনেক আছে। ঈদের ডামাডোলের মধ্যে ভোজ্যতেল পরিশোধন ও সরবরাহকারীদের সমিতি ইচ্ছামতো দাম নির্ধারণ করে। পরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তা-ই অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হয়।
গত কয়েক দিন ধরে সংবাদমাধ্যমে ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ভোজ্যতেলের রেকর্ড দাম নিয়ে এবং এর পেছনের কারসাজির নানা চিত্র তুলে ধরে সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৩৮ টাকা আর খোলা সয়াবিনের দাম বাড়ানো হয়েছে ৪৪ টাকা। বেড়েছে পাম অয়েলের দামও। ভোজ্যতেল পরিশোধন ও সরবরাহকারীদের নির্ধারণ করা দামেই সরকারের সায় দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথাও উঠেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভোক্তার স্বার্থ না দেখে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে জীবনযাত্রার ব্যয় প্রায় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির ফলে জনজীবন এমনিতেই বিপর্যস্ত। এর মধ্যে ভোজ্যতেলের দাম এক লাফে এত বাড়ানোর বহুমুখী বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য।
'সময়ের এক ফোঁড় অসময়ে দশ ফোঁড়' বলে প্রবাদ চালু আছে। বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সময়মতো সরকারের তরফে উপযুক্ত পদক্ষেপ না নেওয়া এবং আমদানিকারকদের ঋণপত্র না খোলার কারণে আমদানি সরবরাহ কমে ঘাটতি দেখা দেয়। সরবরাহ ব্যবস্থার পথ নিস্কণ্টক না হলে বাজারে এর বিরূপ প্রভাব পড়বেই। সরবরাহ ব্যবস্থার পথ মসৃণ না রাখতে পারলে সংকট আরও গভীর হবে এবং দেশের বাজারে এবার ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে তা-ই দৃশ্যমান। ৮ মে সমকালসহ অন্য পত্রিকার প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ভোজ্যতেল মিলছে না চাহিদা অনুযায়ী। মজুত ভোজ্যতেল 'গোপন গুদাম' থেকে বেরিয়ে আসছে কৌশলে এবং নির্ধারিত নতুন দরের চেয়েও বাড়তি মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। মহানগর-নগর-শহর-মফস্বলের বিভিন্ন বাজার ও দোকানে ভোজ্যতেল মিলছে না, তাও সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। অর্থাৎ আবারও সেই কৃত্রিম সংকট। বাজার থেকে ভোজ্যতেল 'উধাও'। অতীতে দফায় দফায় ভোজ্যতেলের দাম সরকার বাড়ালেও এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। ভোজ্যতেল নিয়ে অতীতে এত সংকটের মুখে দেশ পড়েনি।
এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠতেই পারে- সংকট মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতি কতটা ছিল। চলমান ইউক্রেন সংকটের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলসহ অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামই বেড়েছে, তা অসত্য নয়। কিন্তু এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, তা কি সরকারের সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীলদের ধারণার মধ্যে ছিল না? এ অজুহাতে আমদানিকারকরা দফায় দফায় দাম বাড়িয়েছে আর সরকার প্রয়োজনের নিরিখে যথাযথ ব্যবস্থা না নিয়ে আমদানিকারকদের দাবির কাছে নত হয়েছে। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধ করে দেয় ও আর্জেন্টিনার রপ্তানি সীমিত করার মওকা আমদানিকারকরা নিয়েছেন। দেশে মজুতবিরোধী আইন থাকা সত্ত্বেও ভোগ্যপণ্য মজুতের দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো প্রতিকার অতীতেও লক্ষ্য করা যায়নি, এবারও তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় সুযোগসন্ধানীরা সুযোগ তো নেবেই এবং নিচ্ছে।
ভোক্তার কৃত্রিম সংকটের ফাঁদে পড়ার অন্যতম কারণ ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি। সুশাসন নিশ্চিত হলে অসাধুতা, নীতিহীনতার পথ সংকুচিত হতে বাধ্য। বাজার তদারকির জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলরা কি নিজ নিজ ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠ? যদি তা-ই হতো তাহলে সুযোগসন্ধানীরা ওঁৎ পেতে থাকতে পারত না। সংবাদমাধ্যমেই এসেছে, বাজার থেকে 'উধাও' ভোজ্যতেলের সন্ধানে গোয়েন্দারা মাঠে নেমেছেন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতেই শুধু নয়, সব সময় মনে রাখতে হবে- বাজার ব্যবস্থাপনায় ছাড় দেওয়া চলবে না। প্রয়োজনের নিরিখে সরকারকেও আমদানিকারক হতে হবে। ভোজ্যতেলসহ অন্য ভোগ্যপণ্য আমদানিতে ব্যক্তিগত খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। গত কয়েক দশকের মধ্যে বিশ্ববাজারে মূল্যস্ম্ফীতি এখন ওপরের দিকে। এক সময় প্রায় শূন্য মূল্যস্ফীতি ছিল। গ্লোবাল ফেনোমেনার এই ঢেউ আমাদের এখানেও লাগবে।
দেশের ভোজ্যতেলের যে চাহিদা রয়েছে; এর প্রায় ৮৮ শতাংশ আমদানি করছে হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে 'সিন্ডিকেট' করে দাম বাড়ানোর অভিযোগ নতুন নয়। এ ক্ষেত্রে আরও বেশিসংখ্যক প্রতিষ্ঠানকে আমদানির সুযোগ দিলে আজ এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। বিলম্বে হলেও এখন তা করা জরুরি। আমদানির পথ সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত। এর ফলে একদিকে যেমন প্রতিযোগিতা বাড়বে, অন্যদিকে কারোরই স্বেচ্ছাচারিতা চালানোর সুযোগ থাকবে না। সময়মতো চাহিদা অনুযায়ী যদি পদক্ষেপ নেওয়া হতো তাহলে ভোক্তাকে আজ দামের অস্বাভাবিক চাপে পিষ্ট হতে হতো না। আমাদের স্মরণে আছে, অতীতে পেঁয়াজ নিয়ে দেশে কী রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল এবং কারা করেছিল। এর তো দৃষ্টান্তযোগ্য কোনো প্রতিকার হলো না! কেন?
আরও পড়ুন: দুই বছর পর চাঙা ঈদ অর্থনীতি
বড় ব্যবসায়ীদের চাপে ছোট ব্যবসায়ীদের ব্যবসার পথ যাতে জটিল না হয়ে ওঠে, তাও নিশ্চিত করতে হবে। সাধারণ ভোক্তার সরাসরি সম্পর্ক ছোট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে, তা মনে রাখা বাঞ্ছনীয়। ভোজ্যতেলের দাম সহনীয় রাখতে সরকার উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর প্রত্যাহার করেছিল। কমিয়েছিল আমদানি করও। কিন্তু এর কোনো কিছুরই সুফল কেন ভোক্তারা পেল না; বিলম্বে হলেও তা খতিয়ে দেখা দরকার। ব্যবসার ক্ষেত্রে সুস্থ প্রতিযোগিতার পথ যত মসৃণ হবে; এর সুফলভোগী সবাই হবে কমবেশি। সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির মাধ্যমে সর্বত্র স্বল্প দামে ভোজ্যতেল বিক্রির ব্যবস্থা নেওয়াও জরুরি। আর অসাধুদের কারসাজি বন্ধে সরকারকে নির্মোহ অবস্থান নিয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতেই হবে। ব্যক্তি বা মহলবিশেষের নয়; সরকারকে প্রাধান্য দিতে হবে ভোক্তার স্বার্থ। বাজারের উত্তাপ যদি না কমে তাহলে তা সরকারের জন্য অস্বস্তির কারণ হতে পারে। বাজারে তদারকি জোরদার করে শৃঙ্খলা ফেরাতেই হবে।
আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক
সাননিউজ/এমএসএ