দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু: ঢাকা মহানগরবাসী নানা সংকটে কতটা নাকাল এরই চিত্র উঠে এসেছে ৫ এপ্রিল সমকালের শীর্ষ প্রতিবেদনে। একদিকে প্রকৃতির রুদ্ররূপ, অন্যদিকে বহুবিধ বিড়ম্বনায় রমজানে মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে বহুগুণে। রমজানে মুসলমানদের জীবনযাত্রায় বাড়তি কিছু বিষয় অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এর মধ্যে কর্ম শেষে দ্রুত ঘরে ফেরার তাগিদ নিত্য জীবনযাত্রার অন্যতম অনুষঙ্গ। কয়েকদিন আগে সমকালের শীর্ষ প্রতিবেদনেই বলা হয়েছিল, রোজায় যানজট আরও ভোগবে। মূলত কিছুদিন ধরে ঢাকার রাস্তায় যানজটের তীব্রতা প্রতিদিনই যেভাবে দৃশ্যমান হচ্ছিল, এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই আশঙ্কা প্রকাশ পেয়েছিল। বস্তুত হলোও তাই। প্রথম রোজায় ঘরে ফেরার উদ্দেশে কর্মস্থল থেকে বের হয়ে অনেকেই রাস্তায় আটকে হকারের কাছ থেকে পানি কিনে সারতে হয়েছে ইফতার-পর্ব।
সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত-প্রচারিত হয়ে চললেও যানজট চিত্র তথৈবচ। উপরন্তু তা যেন ক্রমেই আরও প্রকট হচ্ছে। যাদের যাতায়াতমাধ্যম গণপরিবহন তাদের নিশ্চয় অনেক তিক্ত ও রসব্যঞ্জক অভিজ্ঞতা আছে। ঢাকা মহানগরীর বৃহদাংশ নির্ভরশীল গণপরিবহনের ওপর। কিন্তু গণের চেয়ে পরিবহন যেমন অপ্রতুল, তেমনি ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা রাস্তায় ক্রমেই বেড়ে চলার বিষয়টিও দৃষ্টিগ্রাহ্য। অতীষ্ঠ যাত্রীদের নানারকম ব্যঙ্গাত্মক-রসাত্মক কথাবার্তা সরকারের নীতিনির্ধারকদের কানে খুব একটা পৌঁছায় না। কিন্তু সরকার ও সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীলদের জন্য এসব মন্তব্য শ্রবণ প্রয়োজনের নিরিখেই খুব প্রয়োজন।
রোজাদাররা খুবই সংকটে পড়েছেন ইফতার-সেহরি নিয়ে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট তাদের এই কষ্টের সীমা-পরিসীমা ছাড়িয়েছে। ভুক্তভোগীদের কথা উঠে এসেছে সমকালের ওই প্রতিবেদনে। লাইনে গ্যাস সরবরাহের ঢাকার অনেক এলাকায় চুলাও জ্বলছে না। জরুরি প্রয়োজন মেটাতে সিলিন্ডার কেনাও অনেকের ক্রয়সাধ্যের বাইরে চলে গেছে সম্প্রতি একলাফে সিলিন্ডারের মূল্যবৃদ্ধিতে। ঢাকা ও এর আশপাশে ডায়ারিয়ার প্রকোপ মারাত্মকভাবে দেখা দিয়েছে। অনেকে বাধ্য হয়ে বাসি খাবার খাচ্ছেন। ঢাকা ওয়াসার সরবরাহকৃত মানহীন পানি ফুটিয়ে বিশুদ্ধ করে পান করাও দুরূহ হয়ে পড়েছে। ফলে ডায়রিয়া পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। লাইনের গ্যাস নিয়ে ভোক্তার বিলাপ সংবাদমাধ্যমে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। নিত্যপণ্যের বাজারে তাপ ক্রমেই বাড়ছে। আর এরও বিরূপ প্রভাব পড়েছে হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবারে। যারা ইফতার-সেহরি কিনে খেতে বাধ্য হচ্ছেন, তাদের প্রাণ যেন ওষ্ঠাগত। গ্যাস সংকট রোজায় কষ্টের ক্ষণ আরও প্রলম্বিত করেছে। আর বিদ্যুতের প্রায় অহরহ আসা-যাওয়া প্রশ্ন দাঁড় করিয়েছে- এত বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরও কেন বিদ্যুতের ভেল্ক্কিবাজি! তীব্র তাপদাহ, সরবরাহ লাইনে গ্যাসের 'নাই' হয়ে যাওয়া, রাস্তায় স্থবির জীবন সব মিলিয়ে বিষময় পরিস্থিতি।
গ্যাস ফিল্ডে থেকে উৎপাদন কমে যাওয়ার ধাক্কা লেগেছে গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে। তাই এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনেও ভাটা। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের বরাত দিয়ে সমকালে বলা হয়েছে, বিদ্যমান সংকট কাটাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। দ্রুতই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে এই প্রত্যাশা পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে 'হবে', 'হচ্ছে'র জটাজাল সহজে ছিন্ন হয় না। গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের তীব্রতা ঢাকার বাইরেও চলছে সমান্তরালে। বিড়ম্বনা-বঞ্চনায় মানুষ অতীষ্ঠ, ক্ষুব্ধ। গ্যাস উত্তোলনকারী কোম্পানিগুলোর অপরিণামদর্শিতার চিত্রও উঠে এসেছে সংবাদমাধ্যমেই। সক্ষমতার চেয়ে বেশি গ্যাস উত্তোলনের চরম ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা স্পষ্ট। মানুষের সামনে তাহলে কী আরও বেশি বিপদাশঙ্কা?
মানুষের কষ্টের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। লোডশেডিং-'গ্যাসশেডিং' আর পথে পথে বিড়ম্বনার যে বহুমুখী চিত্র উঠে আসছে, সেসব কি নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিগোচরীভূত হয় না? প্রশ্ন উঠতেই পারে- মানুষ কি উন্নয়নযজ্ঞের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভুল দর্শনের ছায়া দেখছে! গৃহস্থালি রান্নার কাজ থেকে শুরু করে শিল্পকারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও পরিবহনে গ্যাসের ওপর আমাদের যেভাবে নির্ভরতা বাড়ছে, এই চাহিদা মেটাতে গ্যাসের চাহিদা কিংবা উৎপাদন কোনোটাই যথেষ্ট নয়- এ কথা অনেক আগে থেকেই বলা হলেও এ অবস্থায় এতদিনে এর কি কোনো বিকল্প কিছু খোঁজা হয়েছে? সহসা গ্যাসের সংকট কাটবে এমন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু যত দ্রুত সম্ভব গ্যাসের স্বাভাবিক সরবরাহ নিশ্চিত করতেই হবে। শুধু গ্যাস ব্যবহারকারীরা দায়িত্বশীল হলেই চলবে না, ব্যবস্থাপনায় যে অনিয়ম-দুর্নীতি রয়েছে সেখানেও দৃষ্টি দেওয়া চাই অধিক গুরুত্ব দিয়েই। তাছাড়া এলএনজি আমদানি ও টার্মিনাল সংস্কারসহ স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে সংকটের সমাধান খুঁজতে হবে।
আরও পড়ুন: বাজার শোষকদের কবলে ভোক্তা
দেশের জ্বালানি খাত গ্যাসনির্ভর হওয়ায় বিশেষজ্ঞরা যেসব পরামর্শ দিয়েছিলেন যাতে সংকটের সৃষ্টি না হয়, সেসব কতটা আমলে নেওয়া হয়েছে জানি না। তবে 'দেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে' একসময় এ দাবি করা হলেও এখন দেখা যাচ্ছে ক্রমেই কমছে দেশীয় উৎস থেকে গ্যাসের উৎপাদন। কিন্তু সাধারণ মানুষ এত সমীকরণ বোঝে না। তারা চায় পথ থেকে ঘর পর্যন্ত নির্বিঘ্ন জীবনযাপন। আর তা নিশ্চিত করার দায় সরকারেরই। জনদুর্ভোগের ছায়া সরাতেই হবে।
দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু, সাংবাদিক ও লেখক
সাননিউজ/এমএসএ