ড. মো. নজরুল ইসলাম: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যেসব ঘটনায় ত্বরান্বিত হয়েছে, ড. জোহার আত্মদান তার অন্যতম। ঘটনাটি ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকের। বুনিয়াদি গণতন্ত্রের আবিষ্কর্তা আইয়ুব খান হাস্যকর ‘উন্নয়ন দশক’ উৎসব আরম্ভ করলেন।
পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান দুই প্রদেশের ছাত্র-জনতা বুঝল এই অপ্রাসঙ্গিক ‘উন্নয়ন দশক’ উদযাপনের আড়ালে পাকিস্তানের জনগণকে ধোঁকা দিয়ে একনায়কত্ব দীর্ঘস্থায়ী করা ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের নেই। ফলে তারা আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ল।
উত্তাল হয়ে উঠল পাকিস্তানের রাজনীতি। মানুষ সরকার পতনের আন্দোলনে রাস্তায় নেমে পড়ল। পূর্ব পাকিস্তানে জনগণের আন্দোলন পায় ভিন্ন মাত্রা। অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে ভারত ভাগের পর থেকেই।
ভারত ভাগের পর পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান হয়ে আরেক ঔপনিবেশিক শাসনের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব বাংলার জনগণ উপেক্ষিত হতে থাকে। শুরু হয় অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন ও সীমাহীন বৈষম্য।
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ বাংলার জনগণের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আইয়ুব শাহী পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার ব্যাপারে কতটা উদাসীন। সীমাহীন বৈষম্য ও পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা এবং জনগণের মুক্তি বিবেচনায় নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা প্রস্তাব পেশ করেন।
আওয়ামী লীগের ছয় দফার মধ্যে মানুষ খুঁজে পায় স্বায়ত্তশাসনের ইঙ্গিত। পূর্ব বাংলার মানুষ ছয় দফাকে মুক্তির সনদ হিসাবে গ্রহণ করে। তাই বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার ভিত্তিতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের আইয়ুববিরোধী আন্দোলনকে দেয় ভিন্ন মাত্রা।
আইয়ুব খান এই আন্দোলকে বানচাল করতে শুরু করেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। বন্দি করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সরকারি সাক্ষীদের সাক্ষ্য যে বানোয়াট ও ফরমায়েশি, তা প্রমাণ হতে থাকে।
এ সময়, ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯, সার্জেন্ট জহুরুল হককে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে হত্যা করা হয় । চারদিকে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ছাত্র-জনতা প্রতিবাদে নেমে আসে রাজপথে। ঘটে গণঅভ্যুত্থান। রাজপথে ছাত্রনেতা আসাদসহ অনেককে গুলি করে হত্য করা হয়।
এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের বাঁচাতে গিয়ে পাক সেনাদের গুলি ও বেয়নেটের আঘাতে শহিদ হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্রের প্রাণপ্রিয় শিক্ষক ড. সৈয়দ মুহম্মদ শামসুজ্জোহা (ড. জোহা)। তিনি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
ড. জোহার আত্মদান পূর্ব পাকিস্তানের গণআন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্বে নিয়ে যায়। আইয়ুব শাহী ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিয়ে শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হয়। ছাত্র-জনতা শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, ড. জোহার মৃত্যু আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে বেগবান করে, ফলে বাংলাদেশ অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নিতে পেরেছে।
উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে পূর্ব বাংলার মানুষ পরাধীনতার নাগপাশমুক্ত স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রে পূর্ণ নাগরিক অধিকার নিয়ে উন্নতির শিখরে চড়বে-এ আশায় বিভোর ছিল। সেই পাকিস্তান কাটিয়ে দিল দীর্ঘ সাত বছর শুধু গঠনতন্ত্র প্রস্তুত করে একটি নতুন নির্বাচন করতে। পূর্ব বাংলার মানুষ দেখল তাদের মাতৃভাষা কেড়ে নেওয়ার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। দীর্ঘ ছয় বছর তীব্র আন্দোলন করতে হলো তাদের, বাংলা ভাষাকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা আদায় করে নিতে। তারা দেখল পূর্ব বাংলার মানুষের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ আর বাংলার সম্পদ লুণ্ঠন। মোহভঙ্গ হলো পূর্ব বাংলার মানুষের।
জনগণের বুঝতে বাকি থাকল না যে তারা আরেক ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েছে। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে বাংলার মানুষ দেখল পূর্ব পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ অরক্ষিত রেখে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানে সামরিক শক্তির ব্যবহার। পাকিস্তানি জান্তা জানিয়ে দিল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অধিকার ও নিরাপত্তা নয়, তারা চায় পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ। আশাহত বাংলার মানুষের মনে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। স্বায়ত্তশাসন অথবা স্বাধীনতা ছাড়া বিকল্প আর কিছু নেই-এ ধারণা মানুষের মনে বদ্ধমূল হতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার বিষয়বস্তু ও মানুষের চাওয়ার অনুরণন ঘটে।
ক্ষুব্ধ মানুষ মুক্তির নেশায় একের পর এক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৬৯ সালের ঘটনাপ্রবাহ সামলাতে ব্যর্থ আইয়ুব সরকার আক্রমণাত্মক পথ বেছে নেয়। কর্তব্যরত একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে পর্যন্ত হত্যা করতে পিছপা হয়নি তারা। ড. জোহার মৃত্যু বাংলার মানুষের ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটায়। আইয়ুবের কোনো চেষ্টাই আর কাজে আসে না। তারা বাধ্য হয় ২৫ মার্চ ১৯৬৯ ক্ষমতা ছেড়ে দিতে। দায়িত্ব পান আরেক সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান। জোহার মৃত্যু যে বিস্ফোরণ ঘটায়, তা মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা আরও তীব্র করে। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭০ সালের ভোটে এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে এর পরিসমাপ্তি ঘটে। জোহার আত্মদান তাই আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম নিয়ামক।
ড. জোহার মৃত্যু ঘটেছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। ড. জোহাও কি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন? এ প্রশ্নও কেউ কেউ করতে পারেন। ড. জোহা ছিলেন একজন ছাত্রবান্ধব আদর্শ শিক্ষক; সত্যিকার অর্থে শিক্ষক। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান, নিজের গবেষণা ও ছাত্রদের গবেষণাকর্মের তত্ত্বাবধান নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটত তার। সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল প্রক্টরের দুরূহ দায়িত্ব। ছাত্রবান্ধব জোহার ছাত্রকল্যাণকর অনেক ঘটনা এখনো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সবার মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। এরূপ গুণী একজন শিক্ষক জনপ্রিয় ও সবার গ্রহণযোগ্য হবেন-এটাই স্বাভাবিক।
তার জনপ্রিয়তা কাজে লাগাতেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাকে প্রক্টরের দায়িত্ব অর্পণ করে। ব্যক্তি জোহা ছিলেন খেলা পাগল, সংস্কৃতিমনা একজন প্রগতিশীল মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসএম হলের ছাত্র থাকাকালীন (১৯৫০-১৯৫৪) তিনি ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এসএম হল ছিল আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। এ জন্য তাকে কয়েক দিন হাজত বাস করতে হয়। কর্মজীবনের প্রথম পর্যায়ে গ্রেট ব্রিটেনের সাউথ ওয়েলসে অবস্থিত রাজকীয় অর্ডন্যান্স কারখানায় বিস্ফোরক দ্রব্যের ওপর প্রশিক্ষণ (১৯৫৬-১৯৫৯) শেষে ৪ আগস্ট ১৯৫৯ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের ওয়াহ্ ক্যান্টনমেন্টে সহকারী পরিচালক পদে যোগদান করেন। এ সময় তিনি সরাসরি প্রত্যক্ষ করেন পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ।
ক্ষুব্ধ জোহার নীরব প্রতিবাদ ছিল-চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন ১৯৬১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। দুই দফায় বিলেত গিয়ে বিএসসি (স্পেশাল), এআরসিএস, পিএইচডি ও ডিআইসি ডিগ্রি নিয়ে ফিরে আসেন।
একজন জনপ্রিয় ছাত্রবান্ধব আদর্শ শিক্ষক ছাত্রদের জীবন রক্ষার্থে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন-এটি জানার পর বাংলার মানুষের প্রতিক্রিয়া কী ছিল তার সাক্ষী ইতিহাস। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে জোহা একটি আলোচিত নাম। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে জোহার অবদানকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। ড. জোহার আত্মদান বাংলাদেশের মানুষ কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবছর ১৮ ফেব্রুয়ারি ‘শিক্ষক দিবস’ হিসাবে পালন করে আসছে। এদিন ছাত্র-শিক্ষক স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ড. জোহার অবদানকে স্মরণ করে যা করেছে এবং এ যাবৎ করে আসছে, তা প্রশংসনীয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ‘জোহা স্মারক বক্তৃতা’ নামে একটি ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। প্রতিবছর এই দিনে দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, বিচারপতি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাদের জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা প্রদান করেন। বক্তারা নীতিনির্ধারণীসহ দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতির দিকনির্দেশনা বক্তৃতায় উপস্থাপন করেন। সেসব বক্তৃতা বই আকারে প্রকাশিত হয়।
আরও পড়ুন: একুশের চেতনা ও দেশাত্মবোধ
তবে জাতীয় বীর ড. জোহার জন্য সরকারের আরও কিছু করণীয় আছে। ড. জোহাকে একুশে পদক দেওয়া হয়েছে। তবে মানুষ সবচেয়ে বেশি খুশি হবে তাকে স্বাধীনতা পদক দেওয়া হলে। ১৮ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করা হলে সেটি হবে জোহার অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবির সঙ্গে দেশের সর্বস্তরের শিক্ষকদের দাবি-ড. জোহার মৃত্যু দিবস ১৮ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ ঘোষণা করা হোক। এ ব্যাপারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদয় মনোযোগ প্রত্যাশা করছে দেশের শিক্ষক সমাজ। এ ঘোষণার মাধ্যমে জোহার অবদানকে সম্মান জানানো হবে, একইসঙ্গে তার আত্মা পাবে শান্তি।
ড. মো. নজরুল ইসলাম : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; বর্তমানে উপাচার্য, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।
সাননিউজ/এমএসএ