মুমতাহিনা লুবনা
আমার বিদেশ থাকার শুরু যে দেশে তার নাম ওমান। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়েছি বলতে গেলে। সাধারন জ্ঞানের বই থেকে ওমানের নাম আর তার রাজধানীর নাম মাস্কাট জানি ছোটবেলা থেকে। আর সালালাহ্ বন্দরের নাম আরও ভালোভাবে শুনি যখন সোমালীয় জলদস্যুদের কবল থেকে বাংলাদেশী নাবিকদের উদ্ধার করে সালালাহ্ বন্দরে আনা হয় তখন। এর বাইরে ভৌগলিক অবস্থান ছাড়া তেমন কিছুই তখন জানা ছিল না। শুধু জানতাম ফসিল ফুয়েলের উপর নির্ভরশীল আর পাঁচটা আরবদেশের মত চাঙ্গা অর্থনীতির দেশ ওমান। গুগলেও পনের বিশটার বেশি ভালো কোন ছবি ছিল না। তখনও জানতাম না প্রচারবিমুখ একটা গোপন রত্নের দেশটি হলো ওমান।
সে দেশে গিয়ে দেখলাম কি অদ্ভূত শান্তিপ্রিয় এক জাতি তারা। আর কি অদ্ভূত এক শাসক তাদের। রাজতন্ত্র যেহেতু, তাই কোন মিটিং নেই মিছিল নেই নেই কোন প্রচার অথচ কোন বিরোধীদলীয় লোক ও নেই। আছে শুধু তাদের সুলতানের প্রতি অগাধ ভালোবাসা আর আস্থা। দেশের সবার পিতার মত তিনি। সে দেশে সকল পরিচয়হীন অথবা অনাথেরা পিতার নামের জায়গায় জাতীয় পরিচয়পত্রে তার নাম লেখা হয়। কি অদ্ভূত এক আরব রাজা, তার নেই কোন রানী, নেই কোন উত্তরাধিকারী। না আছে ভোগ বিলাসের প্রাচুর্য্য, সাধারনদের মাঝে যৌবনকাল থেকে মিশে যাওয়া এক মানুষ তিনি। সে দেশের সবার প্রানের এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা।
সে দেশের অপরাধ প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। বহুবার বাড়ি লক না করে শতশত কিমি দূরে গিয়ে থেকে এসেছি। একটা সেফটিপিনও খোয়া যায় নি কখনো। বলতে গেলে অপরিচিত লোকের হাতে বাড়ির চাবি দিয়েও দেশে চলে গিয়েছি। যেখানে প্রতি উইকেন্ডে মুভি দেখে রাত দু’টা তিনটায় নির্জন পাহাড়ী আর মরু রাস্তায় শত কিমি দূরে বাসায় যাতায়াত করেছি জীবনে কোনদিন একটা অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে নি।
যখন গোটা আরববিশ্ব তাদের নেতৃত্ব আর অনাস্থায় ভোগে। জনগণের বিক্ষোভের মুখে তৃত্বীয় শক্তির হস্থক্ষেপে বিদ্রোহ আর যুদ্ধে জ্বলছে তারা। তখন চরম নিরাপত্তার বেস্টনীতে সেই মহান শাসক তার দেশকে ঝিনুকের মত শক্ত খোলসে আবৃত করে মুক্তার ন্যায় শান্তিকে রক্ষা করেছিলেন। কে বলবে আমাদের বাড়ী থেকে খুব কাছেই ইয়েমেন বর্ডার আর সেখানে কি যুদ্ধ! ইয়েমেনী বা সিরিয়ান সবাই আশ্রিত যে আসতে পেরেছে। আর পাঁচটা আরব দেশের চেয়ে শান্তিতে বিদেশি লোকেরা সেখানে চাকরী এবং বসবাস করে। প্রায় সাত লক্ষ বাংলাদেশীই রয়েছেন ওমানে । রাস্তায় বের হলে দেশ বলেও ভ্রম হত মাঝে মধ্যে।
সুলতান কাবুসের পিতা সাঈদ বিন তাইমুর ট্রিপিক্যাল রাজা ছিলেন। চরম কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভীতু টাইপের লোক ছিলেন, কোন প্রকার পরিবর্তন বা আধুনিকায়নে তার ভীতি ছিল। যে জন্য জাতি হিসেবেও ওমানীরা ছিল চরম পিছিয়ে। অথচ পাশের দেশ আরব আমিরাত, সৌদি আরব এবং অন্যান্য আরব ভাতৃরাস্ট্র কুয়েত, কাতার, বাহরাইন যেখানে উন্নতির দিকে ধাবিত হচ্ছিল। এসব বিবেচনায় তখন ক্রাউন প্রিন্স (যে পরবর্তীতে রুলার হবে) কাবুস বিন সাঈদ এক রক্তপাতহীন অভ্যূন্থানের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতা সময়ের আগেই হাতে নিয়েছিলেন।এরপর তিনি গোটা দেশের চেহারাই পাল্টে দেন। এজন্য ওনাকে আধুনিক ওমানের পিতা বলা হয়।
তার গুনের কথা বোধকরি বলে শেষ হবে না। তার দেশের জনগনের কষ্ট দূর থেকেই বুঝতে পারছি। আমরা চাকরীসূত্রে সেখানে ছিলাম তাই চলে আসতে কস্ট হয়েছে, দূর থেকেও তার শান্তিপ্রিয় রাজ্যটা মিস করি। একসময় যেখানেই যেতাম এয়ারপোর্টে নেমে রাস্তায় বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হত বাড়ী ফিরলাম। এ ধরনের অনুভূতি একজন বিদেশীকে দেয়ার কৃতিত্ব তারই। যার পরবর্তীতে সুযোগ থাকা সত্বেও কানাডা না গিয়ে সুলতান কাবুস হাসপাতালে আমার সন্তানকে জন্ম দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। সেখানে সব কিছু এতটাই আপন মনে হত।
ওমানীদের দাবী ছিল তাকে যেন শান্তি তে নোবেল প্রাইজ দেয়া হয়। প্রাইজ পৃথিবীতে না পেলেও পরকালে তিনি পাবেন আশাকরি। তার দেশের মানুষের এমন ভালোবাসা আর দোয়ার জন্য পরম করুনাময় তাকে বেহেশতের উচ্চস্থানে অধিষ্ঠিত করবেন। আমিন...।
মুমতাহিনা লুবনা: সাউথ অস্ট্রেলিয়া
সান নিউজ/সালি