প্রভাষ আমিন: আধুনিক বিশ্বে জনপ্রতিনিধি বেছে নেওয়ার একমাত্র উপায় নির্বাচন। এখন আর ১৭ জন ঘোড়সওয়ার নিয়ে এসে রাজ্য দখল করে রাজতন্ত্র কায়েমের সুযোগ নেই। রাজতন্ত্র এখন টিকে আছে টিমটিম করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সমাজতন্ত্রের উপযোগিতাও আর নেই।
সমাজতান্ত্রিক চীন বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক আধিপত্য কায়েম করছে পুঁজিবাদকে পুঁজি করেই। জনগণ ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে, এই ব্যবস্থাই এখন বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই যে শেষ কথা, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বেশিরভাগ জনগণ যাদের ভোট দেবে, তারাই সরকার গঠন করবে। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও দেখা গেছে, ৩৫ ভাগ ভোট পাওয়া দল ক্ষমতায় চলে যায়। তার মানে ৬৫ ভাগ ভোটার যাদের বিপক্ষে ভোট দিল গণতান্ত্রিকভাবে তারাই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে যায়। তারচেয়ে বড় কথা হলো, বেশিরভাগ মানুষ যে সবসময় ভালোটা বেছে নেবে, তেমনটা নাও হতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নিজেদের ভালোটা বুঝতে গিয়ে সংখ্যালঘুদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে।
বাংলাদেশে এর একটা টাটকা উদাহরণ আছে। কোটা বৈষম্য সৃষ্টি করে—এই ধুয়া তুলে আন্দোলন করে বাংলাদেশ থেকে কোটা ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ কোটার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু যাদের সুরক্ষা দিতে কোটা ব্যবস্থার প্রচলন; সেই দুর্বল সংখ্যালঘুদের কথা শোনার কেউই ছিল না। অথচ বাস্তবতা হলো, একটি সভ্য ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্রে কোটা ব্যবস্থা রাখাই হয় বৈষম্য দূর করার জন্য, দুর্বল মানুষকে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা দেওয়ার জন্য।
একাত্তরের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘কেউ যদি ন্যায্য কথা বলে আমরা তা মেনে নেব, এমনকি তিনি যদি একজনও হন।’ এটাই হলো গণতন্ত্রের মূল কথা। কিন্তু ন্যায্যতার গণতন্ত্র কবে আসবে বিশ্বে? যতদিন না আসবে, ততদিন আমাদের বিদ্যমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপরই আস্থা রাখতে হবে। এমনকি ৩৫ ভাগ মানুষের ভোট নিয়েও ৬৫ ভাগ মানুষের অপছন্দের দলও ক্ষমতায় চলে যেতে পারে।
বাংলাদেশেও বিদ্যমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই প্রচলিত। তবে ৫০ বছরের মধ্যে অন্তত ২০ বছর বাংলাদেশ শাসন করেছে সামরিক শাসকরা। তবে বাকি সময়ের যে গণতন্ত্র, তা নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ৫০ বছরেও বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সবাই কৌশলে বা গায়ের জোরে নির্বাচনে জিততে চান। এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ৫০ বছরে বাংলাদেশে কয়েকটি ভালো নির্বাচন হলেও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন একটিও হয়নি। কারণ নির্বাচন যেমনই হোক, পরাজিত দল সবসময়ই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো নির্বাচনে জিততে চাইবে। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলো প্রতিদ্বন্দ্বী সবার জন্য একটি সমান মাঠ এবং সমান সুযোগ তৈরি করা। আর এই কাজটি ঠিকমতো করার জন্য নির্বাচন কমিশনের হাতে প্রয়োজনীয় আইনি ক্ষমতাও আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের অধিকাংশ নির্বাচন কমিশনই তাদের সেই আইনি ক্ষমতা ব্যবহার করে, সবার জন্য সমান সুযোগের একটি নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই সাবেক নির্বাচন কমিশনার মানেই জাতির কাছে ভিলেন।
জিয়া এবং এরশাদের সামরিক শাসনের আমলে বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রহসনে পরিণত হয়েছিল। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে এলে নির্বাচনী ব্যবস্থারও উন্নতি হয়। কিন্তু মানতেই হবে গত একযুগে বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা আবার তলানিতে ঠেকেছে।
২০১৪ এবং ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। ২০১৪ সালে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় নির্বাচন হয়েছে অনেকটাই একতরফা। আর সেই একতরফা নির্বাচনে ভোটের আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের নিয়ে সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গিয়েছিল সরকারি দল।
২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও সরকারি দলের কৌশলের কাছেই তারা হেরে গিয়েছিল, এখন যেটা নিয়ে আফসোস করে বিএনপি। বারবার সরকারি দলের অপকৌশলের কাছে হেরে যাওয়া বিএনপি আসলে নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না।
তারা একবার বলে নির্বাচনে যাব না, আবার নির্বাচনে যায়; সংসদে যাব না বলেও সংসদে যায়; একবার স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নেয়, একবার নেয় না। তাদের এই দোদুল্যমানতা বিপাকে ফেলে স্থানীয় নেতাকর্মীদের। বিএনপি কোনো বিপ্লবী দল নয়। ক্যান্টনমেন্টে গঠিত হলেও বিএনপি এখন গণতান্ত্রিক দল। নির্বাচনের মাধ্যমেই তারা ক্ষমতায় যেতে চায়। কিন্তু সেই নির্বাচনেই তারা অংশ নিচ্ছে না।
আমি জানি, নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর মানুষের যে অনাস্থা তাতে বিএনপি নির্বাচনে গেলেও পরিস্থিতি খুব একটা পাল্টাবে না বা তারা জিতে যাবে না। কিন্তু নির্বাচনে অংশ নিলে নেতাকর্মীরা অনেকটা নির্বিঘ্নে মাঠে নামতে পারেন, জনগণের কাছে যেতে পারেন। তাতে জনগণের সাথে তাদের একটা যোগাযোগ গড়ে ওঠে। কিন্তু একেবারে বর্জন করলে সেই সুবিধাটাও হারায় তারা। এমনিতেই বিএনপি অনেক রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। নির্বাচনের সুযোগে জনগণের কাছে যাওয়ার সুবিধাটা আখেরে তাদের ভালোই হবে হয়তো।
বিএনপির বর্জনের সুযোগে দেশজুড়ে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাথে লড়াই হচ্ছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর। ‘নৌকা’ প্রতীক পেলেই জয় নিশ্চিত, এই মিথ এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভেসে গেছে। পঞ্চম দফা নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থীরা হেরেছেন। অনেক জায়গায় নৌকা জামানত হারিয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা সব জায়গায়ই তুমুল জনপ্রিয় এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। অধিকাংশ স্থানেই, বিএনপি নেতাকর্মীরা নৌকাকে হারাতে বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নেমেছিল।
তবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নয়, গোটা দেশ এখন উত্তপ্ত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে। নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের সমীকরণটা দেশের অন্য জায়গার মতো নয়। সব জায়গায়ই আওয়ামী লীগে কম বেশি বিরোধ আছে। তবে নারায়ণগঞ্জের মতো প্রকাশ্য এবং সক্রিয় বিরোধ খুব বেশি নেই। নারায়ণগঞ্জে ওসমান পরিবার আর চুনকা পরিবারের দ্বন্দ্ব আওয়ামী লীগের সমান বয়সী।
ওসমান পরিবারের নেতৃত্ব এখন শামীম ওসমানের হাতে। আর নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান আলী আহমেদ চুনকার উত্তরাধিকার বহন করছেন তার কন্যা ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। নারায়ণগঞ্জ রাজনীতির ভাগাভাগিটা খুব কৌশলী। বরাবরই স্থানীয় রাজনীতি চুনকা পরিবারের নিয়ন্ত্রণে।
একসময় আলী আহাম্মদ চুনকা ছিল নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান। তার কন্যাও নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। সিটি করপোরেশন হওয়ার পর তিনি টানা দুইবার মেয়র হয়েছেন। এবার তৃতীয় চেষ্টা। ২০১১ সালে সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে শামীম ওসমান আইভীর কাছে হেরে যান। তবে স্থানীয় নির্বাচনে হারলেও জাতীয় নির্বাচনে বরাবরই ওসমান পরিবারের আধিপত্য।
শামীম ওসমান আওয়ামী লীগের এমপি, তার ভাই সেলিম ওসমান জাতীয় পার্টির এমপি। আরেক ভাই প্রয়াত নাসিম ওসমানও জাতীয় পার্টির এমপি ছিলেন।
নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি বরাবরই আওয়ামী লীগের সাথে আওয়ামী লীগের লড়াই। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনে অংশ না নিলেও তাদের নেতা তৈমুর আলম খন্দকার স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আর এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে তিনি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টার পদ হারিয়েছেন।
দৃশ্যত, নারায়ণগঞ্জে সেলিনা হায়াৎ আইভীর সাথে তৈমুর আলম খন্দকারের লড়াই। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন শামীম ওসমানের সমর্থন কে পাবেন? আওয়ামী লীগের এমপির সমর্থন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরই পাওয়ার কথা। কিন্তু আইভী নিজেই বলছেন, তৈমুর আলম শামীম ওসমানের প্রার্থী। কিন্তু তৈমুর দাবি করছেন তিনি সবার প্রার্থী। আসলে শামীম ওসমানের সমর্থনের দায় কেউই নিতে চাইছেন না। শামীম ওসমানের সমর্থন পেলে একটা বড় অংশের ভোট না পাওয়ার ঝুঁকি আছে যেকোনো প্রার্থীর জন্য।
তবে নারায়ণগঞ্জে তৈমুর আলম খন্দকার নয়, আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগই। তবে নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের পরাজয় নিশ্চিত। এমনকি সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও এই পরাজয়ের দায় তাদের বহন করতে হবে। যদি নির্বাচনে তৈমুর আলম খন্দকার জিতে যান, তবে সবাই বলবে, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জনরায় হয়েছে। আর যদি আইভীর জেতেন, তাহলে সবাই বলবে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হতে পারে না, এটা তার প্রমাণ। মানুষ যাই মনে করুক, নির্বাচনটা যাতে ভালো হয়, নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি যাতে মানুষের আস্থা ফিরে আসে; সেটুকুই আপাতত চাওয়া।
লেখক: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ