মোস্তফা হোসেইন: নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে চমক, ধমক আর রাজনৈতিক বাহাসও জমে উঠেছে। নির্বাচনে এমনটাই হওয়ার কথা। সুতরাং প্রতিদ্বন্দ্বীদের মুখরোচক কিংবা কর্কশ যেমন কথাই প্রচার হোক না কেন, বলতে হবে, নির্বাচনী পরিবেশ সাম্প্রতিক অনেক নির্বাচনের মধ্যে অত্যন্ত সুষ্ঠু ও সুন্দর। একই সঙ্গে নির্বাচনপ্রেমী ভোটাররা কিন্তু প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি রাজনৈতিক আক্রমণকেই উপভোগ করছেন। প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতি কৈফিয়ত কিংবা হিসাব-নিকাশ নিয়েও বিশ্লেষণ করছে তারা। সবদিক বিবেচনা করলে বলা যায়, যা চলছে তা নির্বাচনী আবহাওয়ায় স্বাভাবিক বলেই গণ্য হতে পারে।
তবে প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিয়ে কিছুটা ব্যতিক্রম এখানে আছে, দুটি পরিবারের ঐতিহ্যগত দূরত্বকে কেন্দ্র করে। এটা দলীয়ভাবেও যে পর্যবেক্ষণ করছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। লক্ষণীয় হচ্ছে, নির্বাচনী বক্তব্য হিসেবে আজ মাঠে চাউর হচ্ছে তার কিছু কিছু বিষয়, ভবিষ্যৎ রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে। আবার বিগত সময়ে রাজনৈতিক দলগুলো ও নেতারা যে অবস্থানে থেকে রাজনীতি করেছেন তারও প্রভাব এখন এই মুহূর্তে পড়তে পারে। এটা শুভ হোক কিংবা অশুভ হোক তাকে একবারেই পাশ কাটিয়ে থাকা যাবে না।
নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনী রাজনীতি বড় দল আওয়ামী লীগের ব্যস্ততা বাড়িয়ে দিয়েছে, এটা সবার চোখে পড়েছে। বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব গোটা দলকে নাড়া দিয়েছে, এটাও বাস্তব। কিন্তু এর পরিণতিটা যে কী, বোধকরি তারা নিজেরাও ভাবতে পারছেন না। কারণ শেখ হাসিনা দলের প্রয়োজনে ডান-বাম তাকাতেও অভ্যস্ত নন, ইতোমধ্যে প্রমাণ হয়ে গেছে। আমরা নিকট অতীতের কথা ভাবতে পারি।
মনে আছে নিশ্চয়ই, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর কথা। তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন, মন্ত্রী ছিলেন এর চেয়ে বড় কথা আওয়ামী লীগের সাথে তার সম্পর্ক। আওয়ামী লীগ আর আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীকে আলাদা ভাবার কোনো সুযোগ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর সরাসরি ছোঁয়া পাওয়া পরীক্ষিত নেতা ছিলেন তিনি।
কিন্তু যে মুহূর্তে দেখা গেলো, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী দলের জন্য ক্ষতিকর, সঙ্গে সঙ্গে দলীয়প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করলেন না। সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্তের মতো ঝানু পার্লামেন্টারিয়ান, মন্ত্রীর কথাও আমরা ভুলে যাইনি। এমন উদাহরণ আরও দেওয়া যাবে। এই সূত্র ধরে যে কেউ বুঝতে পারবেন আওয়ামী লীগ এর প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধু কন্যা কতটা কঠোর হতে পারেন। নিজের অতি আদরের কর্মী নেতাকে এক মুহূর্তে দূরে সরাতে দ্বিধা করেন না।
সুতরাং নারায়ণগঞ্জে যে খেলা চলছে, সেই খেলা কিন্তু নারায়ণগঞ্জ থেকে কলকাতায় যাওয়া স্লোগানের খেলা হবে না। দলকে সুসংহত করতে গিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত চমকও আসতে পারে। এমন ভাবার কারণ নেই সেই চমক হবে সেলিনা হায়াৎ আইভী উচ্চারিত চমক।
শামীম ওসমান অকস্মাৎ সংবাদ সম্মেলন করে নৌকার প্রচারে নামার ঘোষণা দিয়েছেন। বলেছেন, ‘হাতি কাঁধে নিয়ে দৌড় দেবেন, নৌকায় উঠতে দেবেন না’। একইসঙ্গে আইভীর সঙ্গে দূরত্বের কথাও বেরিয়ে এসেছে তার বক্তব্যে। নৌকাকে সমর্থন দান প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘কে প্রার্থী, হু কেয়ার? কলাগাছ না আমগাছ আমাদের দেখার বিষয় নয়।’ নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন নিয়ে শামীম ওসমানের ভূমিকা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদগুলো যেমন দুই নেতার দূরত্বকে প্রকাশ করে, একই সঙ্গে ‘কলাগাছ না আমগাছ’ এমন মন্তব্যও প্রার্থী বাছাইকেই সমালোচনায় ফেলে দেয়। প্রশ্ন আসতে পারে, কলাগাছ কিংবা আমগাছকেই কি দল মনোনয়ন দিয়েছে? যদিও দলীয় আনুগত্যের প্রশ্নে এমন বক্তব্যকে ধর্তব্য নয় কেউ বলতে পারেন। কিন্তু কর্মীদের মধ্যে দ্বিধা থেকেই যেতে পারে।
অন্যদিকে আইভীও বলেছেন, ‘কে আমাকে সমর্থন দিলো কিংবা দিলো না, এ নিয়ে জনগণ কিংবা ভোটারদের মাথাব্যথা নেই। আমার নির্বাচনী এলাকার ভোটাররা সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন কাকে ভোট দেবেন’। আইভীর এমন বক্তব্য স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং নিজ দলীয় একজন নেতা শামীম ওসমানের সঙ্গে তার দূরত্বেরও প্রমাণ দেয়।
এধরনের বক্তব্য যে ভোটারদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তাদের দূরত্ব রয়েই গেছে। নির্বাচনের দিনক্ষণ অতি সন্নিকটে হওয়ার পরও দলীয় স্বার্থে দুই স্থানীয় নেতার সামনাসামনি কথা বলার কোনো সংবাদ এ পর্যন্ত হয়নি। এমনকি ফোনালাপের কোনো সংবাদও জানা যায়নি।
সিটি করপোরেশনের একজন ভোটার শামীম ওসমান। অন্যদিকে আইভী নিজে স্থানীয় এমপি শামীম ওসমানেরও দলের মেয়র প্রার্থী। এমন অবস্থায় শামীম ওসমানের কাছে ভোট চাওয়া কি অশোভন হবে? মেয়র প্রার্থী হিসেবে তিনি শামীম ওসমানের ভোট চাইতেই পারেন।
আবার স্থানীয় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচনী খোঁজখবর কিংবা পরামর্শ সহযোগিতার জন্যও মেয়র প্রার্থীও ফোন করতে পারেন মেয়র প্রার্থীকে। অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি কাজ নির্বাচনে মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। সাধারণ কর্মীরা এমনটা আশা করতে পারেন। তারা দেখতে চাইতে পারেন দুই নেতা অত্যন্ত নির্বাচন উপলক্ষে একে অন্যের সঙ্গে কথা বলেছেন, মাঠপর্যায়ে তাদের কর্মীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন।
নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন প্রসঙ্গে এটুকু দেখে মনে হতেই পারে, ওখানে আসলে ত্রিপক্ষীয় নির্বাচন হচ্ছে। অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম, সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং শামীম ওসমান একেকটি পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। স্বাভাবিক কারণেই বিএনপি নেতা তৈমূর আলম সেই সুযোগকেই কাজে লাগাতে চাইছেন। আসলে নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতেও খেলা জমে উঠেছে। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও বর্জন করেছে। সেই সুবাদে দলীয় সিদ্ধান্ত রক্ষার কারণেই তৈমূর আলমকে তারা উপদেষ্টা পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। কিন্তু একইসঙ্গে বলে দিয়েছে স্থানীয় নেতাকর্মীরা যদি তার হয়ে কাজ করেন তাহলে দল কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না।
অ্যাডভোকেট তৈমূর আলমের তাৎক্ষণিক মন্তব্যে এমনটাই মনে হয়েছে, তিনি যেন হাফছেড়ে বেঁচেছেন। বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এ সিদ্ধান্তকেই কি তিনি হাফছেড়ে বাঁচা বলে মনে করেন? এখানেও দলের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ক্ষোভ প্রকাশ হয়ে পড়ছে বলে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন।
একইসঙ্গে আলোচনায় এসেছে-বিএনপির সিদ্ধান্ত বিরোধী অবস্থানে গিয়ে তৈমূর আলম যখন নির্বাচনে অংশ নিলেন তখন তাকে দল থেকে বহিষ্কার না করে কি নির্বাচনী ফলাফল অপেক্ষা করার কৌশল নেয়া হয়েছে? আসলে নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন শুধু নারায়ণগঞ্জেরই নির্বাচন নয়, কেন্দ্রীয় রাজনীতির খেলাও সেখানে যুক্ত হয়েছে। সেখানে একক কোনো দলই নয়, ছোট বড় দলগুলোরও অনেক কিছু নির্ভর করতে শুরু করেছে। এমন পরিস্থিতিতে দেখা যাক-শেষ পর্যন্ত নৌকার পাল উড়বে নাকি হাতি হেলেদোলে চলবে? লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও শিশুসাহিত্যিক।
সাননিউজ/এমআর