আমীন আল রশীদ
কক্সবাজারে স্বামী সন্তানকে আটকে রেখে একজন নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় চলছে। পুলিশের তরফে বলা হচ্ছে, ওই নারী আসলে পর্যটক নন। তিনি কয়েক মাস ধরেই কক্সবাজারে অবস্থান করছেন। যাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে, তারা ওই নারীর পূর্বপরিচিত। এমনকি কেউ কেউ ইঙ্গিত করছেন, ওই নারী ‘পতিতাবৃত্তি’র সঙ্গে যুক্ত এবং টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে ইত্যাদি।
এই ঘটনার কয়েকটি দিক ও ইমপ্যাক্ট রয়েছে। যেমন, যারা বলছেন বা দাবি করছেন যে, অভিযুক্তরা ওই নারীর পূর্ব পরিচিত এবং ওই নারী যদি সত্যি সত্যি ‘পতিতাবৃত্তি’র সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তাতেও কি এই ধর্ষণের ঘটনটি বৈধতা পায়? সম্মতি ছাড়া একজন পতিতার সঙ্গে জোর করে যৌন সম্পর্ক করাও যে ধর্ষণ, সেই বাস্তবতাটা আমাদের দায়িত্বশীল মানুষেরাও অনেক সময় ভুলে যান। দ্বিতীয়ত, ‘অভিযুক্ত এবং অভিযোগকারী পূর্ব পরিচিত’—এই কথা বলে কি ধর্ষণের অভিযোগকে হালকা করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে? তৃতীয়ত, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুরো কক্সবাজারের পর্যটন নিয়েই একটা বড় ধরনের নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ কক্সবাজারকে বয়কটের আহ্বান জানিয়েছেন। অনেকে মনে করছেন, এই ঘটনা পুরো দেশের পর্যটন শিল্পকে হুমকির মুখে ফেলবে। আসলে কি তা-ই?
প্রসঙ্গত, কক্সবাজারে একজন নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার ঠিক আগেই এখানে একসাথে কয়েক লাখ পর্যটকের আগমনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে কোনও কোনও রেস্টুরেন্টে ডাল-ভাতের দাম চারশো টাকা নেওয়া, এক হাজার টাকার হোটেল রুম পাঁচ হাজার টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল।
প্রশ্ন হলো, এক প্লেট ডাল-ভাতের দাম আসলেই কি চারশো টাকা নেওয়া হয়েছিল? যদি নিয়ে থাকে তাহলে সেখানে ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষ, ট্যুরিস্ট পুলিশ বা স্থানীয় প্রশাসন এবং কক্সবাজারের পর্যটন ব্যবসায়ীদের সংগঠন কি এর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিয়েছে?
প্রশ্ন হলো, বয়কট কি কোনও সমাধান? কক্সবাজারকে বয়কট করলে কার লাভ? বরং দেশের মানুষের স্বার্থেই কক্সবাজারকে নিয়ে যাতে বিতর্ক না হয়, সে বিষয়ে ব্যবসায়ী, স্থানীয় জনগোষ্ঠী, প্রশাসন, ট্যুরিস্ট পুলিশ এবং সর্বোপরি স্থানীয় সাংবাদিকদের সতর্ক থাকা দরকার। কোনও একটি অভিযোগ পেলেই বা কোনও একজন লোক এসে একটা অভিযোগ করলেই সেটাকে রঙচঙ মেখে সংবাদ প্রকাশ না করে বরং সংশ্লিষ্ট সবার সাথে কথা বলে, ঘটনাটি আসলেই কী ঘটেছিল, তা অনুসন্ধান করে সংবাদ প্রকাশ করা উচিত। বেশি ভিউ আর ভাইরাল হওয়ার লোভ সামলানো দরকার। মনে রাখা দরকার, সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষ যা খুশি তা-ই লিখতে পারে। কারণ এখানে কোনও সম্পাদক বা গেটকিপার নেই। কিন্তু কোনও সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল বা ইন্টারনেটভিত্তিক কোনও টেলিভিশন যদি নিজেদেরকে গণমাধ্যম বলে দাবি করে, তাহলে তারা যা খুশি তাই প্রকাশ বা প্রচার করতে পারে না। চটকদার শিরোনাম দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতার পরিপন্থী। ঘটনাকে রাবারের মতো টেনে অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে গল্প-গুজব তৈরি করে সংবাদকে ‘সং’-এ পরিণত করা কোনও দায়িত্বশীল সংবাদমাধ্যমের কাজ নয়। সুতরাং, মানুষকে যেহেতু কক্সবাজারসহ অন্যান্য পর্যটন স্পটগুলোয় ঘুরতে যেতেই হবে এবং এইসব পর্যটন স্পটে ব্যবসা করে লাখ লাখ মানুষের জীবিকা নির্বাহ হবে এবং দেশের অর্থনীতি সচল থাকবে, সুতরাং দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার বিকল্প নেই এবং সাধারণ মানুষেরও উচিত কোনও কিছু শুনলেই তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া গরম করে ফেলার আগে একটু যাচাই-বাছাই করা যে, আসলেই কী ঘটেছে?
সবচেয়ে বড় দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসনের। অপরাধের অভিযোগ উঠলে তাদের কথাবার্তা এমনভাবে বলা উচিত যাতে মনে না হয় যে তারা অপরাধ বা অপরাধীদের আড়াল করছেন। মানুষ যেন তাদের কাছে গিয়ে আশ্রয় ও ভরসা পায়—সেটি নিশ্চিত করা দরকার। আর সত্যি সত্যিই বেশি পর্যটকের সুযোগ নিয়ে কোনও ব্যবসায়ী যাতে পণ্য বা সেবার দাম কয়েক গুণ বেশি নিতে না পারেন, সেজন্য তাদের নিজেদেরকেই সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এরকম একটি ঘটনাও যদি ঘটে এবং তার কারণে যদি কোনও মৌসুমে কক্সবাজারে একশো পর্যটকও কম যান, তাহলে সেটি ব্যবসায়ীদেরই ক্ষতি। ব্যবসা তো একদিন বা এক মৌসুমের জন্য নয়।
মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশে যেসব কারণে পর্যটন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিকশিত হয় না বা হলেও সেটি জনবান্ধব হয় না, তার পেছনে একটি বড় কারণ পর্যটন এলাকার মানুষের কালচার এবং ব্যবসায়ীদের এই অতিলোভ। মুক্তবাজার অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী চাহিদা বেড়ে গেলে পণ্য বা সেবার মান যেরকম খুশি বাড়িয়ে ভোক্তাকে ঠকানো এখন একটি অতি সাধারণ প্রবণতা।
স্থানীয় মানুষ যদি সহায়তা না করে, তাহলে রাষ্ট্রের কোনও বাহিনী গিয়ে সেখানে পর্যটনের বিকাশ ঘটাতে পারবে না। তাছাড়া পর্যটন এলাকায় ছোট বড় মাঝারি নানা রকমের ব্যবসা-বাণিজ্য করে সেই কমিউনিটির মানুষেরাই স্বাবলম্বী হতে পারে। কিন্তু বাস্ততা হলো, বাংলাদেশের মানুষ অতিথিপরায়ণ হলেও কেন যেন পর্যটন সম্ভাবনা দেখলেই তারা অসাধু ব্যবসায়ী হয়ে ওঠে। একজন সিনিয়র সাংবাদিক অবশ্য ফেসবুকে লিখেছেন, কক্সবাজারের অসাধু ব্যবসায়ীরা কেউই স্থানীয় কমিউনিটির নয়। তারা সবাই অন্য জেলার।
তবে এ প্রশ্নও তোলা যায় যে, একসঙ্গে একটি পর্যটন স্পটে সর্বোচ্চ কত লোক যেতে পারবেন, তার কি একটা সীমারেখা থাকা উচিত নয়? টানা তিন দিন ছুটি পেলেই একসাথে কয়েক লাখ মানুষ যে কক্সবাজারের মতো একটি পরিবেশগত স্পর্শকাতর এলাকায় গিয়ে হামলে পড়ে, এটিও তো নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।
সংবিধান অনুযায়ী (অনুচ্ছেদ ৩৬) মানুষের চলাচলের স্বাধীনতা থাকলেও রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে; পরিবেশ-প্রকৃতি এবং মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে এই স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণযোগ্য। এমনিতেই কক্সবাজার যেখানে সব সময়ই অসংখ্য পর্যটকের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের ফলে পরিবেশ ঝুঁকির মধ্যে থাকে, সেখানে এরকম টানা তিন চার দিনের ছুটি পেলেই যে লাখ লাখ মানুষ সেখানে ছুটে যায়, এটি নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
শুধু কক্সবাজার নয়, প্রতিটি পর্যটন এলাকাতেই প্রতিদিন সর্বোচ্চ কত লোক যেতে পারবে, তার একটা সীমারেখা ঠিক করে দেওয়া দরকার। মুশকিল হলো, আমাদের দেশে পকেটে পয়সা থাকলেই মানুষ যা খুশি করতে পারে। একটি পরিবারে তিন-চারটি গাড়ি থাকতে পারে। অথচ এই অনিয়ন্ত্রিত প্রাইভেট কারগুলো যেমন ঢাকার রাস্তায় যানজট সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে বড় অন্তরায়, তেমনি মানুষ চাইলেই যে দল বেঁধে, লাখ লাখ মানুষ একসাথে কক্সবাজারের মতো অত্যন্ত সংবেদনশীল সমুদ্রসৈকতে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, তাতে একদিকে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম এই সমুদ্র সৈকতের প্রাণপ্রকৃতি যেমন হুমকিতে পড়ে, তেমনি পর্যটকদের হয়রানি, ভোগান্তি ও ঠকার শঙ্কাও বেড়ে যায়। অতএব মানুষের ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার নিয়ন্ত্রণ করা যেমন রাষ্ট্রের দায়িত্ব, তেমনি পর্যটন এলাকার সুরক্ষা এবং পর্যটনের নামে লোভী মানুষের জিহ্বা টেনে ধরার কাজটিও তাকে করতে হয়। পর্যটন এলাকায় যে একজন লোক চাইলেই তার খুশিমতো ভাড়া বা বিল নিতে পারেন না এবং নিলে যে এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ, সেই বার্তাটি সবার মধ্যে সুস্পষ্টভাবে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে সেটি দৃশ্যমান করা দরকার।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের ওয়েবসাইটে তাদের ভিশন লেখা হয়েছে: ‘দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশকে অন্যতম প্রধান পর্যটন গন্তব্য হিসেবে গড়ে তোলা।’ আর তাদের মিশন বলা হয়েছে: ১. সুপরিকল্পিত ও টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে বিশ্বমানের পর্যটন পণ্য ও সেবার উন্নয়ন; ২. কার্যকরী প্রচার ও বিপণনের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পর্যটন পণ্য ও সেবার বিপণন।
এখন প্রশ্ন তোলা দরকার, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশকে অন্যতম প্রধান পর্যটন গন্তব্য হিসেবে গড়ে তোলার যে ভিশনের কথা বলছে ট্যুরিজম বোর্ড—তারা কি জানে দক্ষিণ এশিয়ায় পর্যটনের জন্য খ্যাত নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর চেয়েও বাংলাদেশের জেলা শহর কক্সবাজারের হোটেল ভাড়া, খাওয়ার খরচ এবং বিমান ও বাসের ভাড়া অনেক বেশি?
ট্যুরিজম বোর্ড কি জানে বিশ্বমানের পর্যটন শিল্প গড়ে তোলার অন্যতম পূর্ব শর্ত হচ্ছে পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা? অথচ হোটেলে রুম না পেয়ে কক্সবাজারে খোলা আকাশের নিচে পর্যটকদের রাত্রিযাপন করতে হয়। তার মানে কোথাও যে কোনও পরিকল্পনা এবং সমন্বয় নেই; কোথাও যে কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই, তা স্পষ্ট। সুতরাং, বিশ্ব মানের দূরে থাক, এশিয়া এমনকি দক্ষিণ এশিয়া মানের পর্যটন গড়ে তোলাও এখানে কঠিন। মানুষের অতিমাত্রায় লোভ, মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তার কাছ থেকে পণ্য ও সেবার বিমিনয়ে কয়েক গুণ টাকা আদায় করার প্রবণতা শুধু যে পর্যটন বিকাশের পথেই বাধা তা-ই নয়, বরং এটা জাতি হিসেবে আমাদের নিচুতা, আমাদের সাংস্কৃতিক মান, আমাদের মানবিকতা এবং রুচি ও বোধেরও পরিচায়ক।
লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।
সান নিউজ/এফএইচপি