সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
গত ৯ ডিসেম্বর ছিল জঙ্গি হামলায় নিহত বিজ্ঞান বিষয়ক মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায়ের বাবা বিশিষ্ট পদার্থ বিজ্ঞানী ও সমাজহিতৈষী অজয় রায়ের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। ছেলে জঙ্গিদের হাতে নৃশংসভাবে হত্যার পর মন ভেঙে গিয়েছিল তাঁর। শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা, পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা অজয় রায় যে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন, ছেলে অভিজিৎ তার চেয়েও আরও এগিয়ে থাকা এক বাংলাদেশ চেয়েছিলেন। সেটা তারা পাননি।
অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের কথা আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু মনে করিয়ে দিলো যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৫ সালে ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায়কে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী বলে যাদের সন্দেহ করা হয় সেই 'মেজর জিয়া' নামে পরিচিত সৈয়দ জিয়াউল হক এবং আকরাম হোসেনের ব্যাপারে তথ্য দেবার জন্য ৫০ লাখ ডলার পর্যন্ত পুরস্কার ঘোষণা করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের রিওয়ার্ডস ফর জাস্টিস কর্মসূচির এক টুইট বার্তায় জিয়াউল হক ও আকরাম হোসেনের ব্যাপারে কোনও তথ্য জানা থাকলে তা টেক্সট করে পাঠাতে একটি ফোন নম্বর দেওয়া হয়।
রিওয়ার্ডস ফর জাস্টিস হচ্ছে সন্ত্রাস দমনের কাজে ভূমিকার জন্য পুরস্কার দেবার লক্ষ্যে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের একটি কর্মসূচি। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের বিচারের আওতায় আনা এবং যুক্তরাষ্ট্রের কোনও ব্যক্তি বা সম্পত্তির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রতিহত করা। এ কর্মসূচির অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমন কোনও তথ্যের জন্য কাউকে পুরস্কৃত করতে পারেন।
২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে নাগরিকদের শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ শুরু হলে বাংলাদেশে একের পর এক ব্লগার খুন হতে থাকেন। নিহত সবাই ছিলেন মুক্তমনা, ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের পক্ষের লোক৷ শুধু যুদ্ধাপরাধের বিচার নয়, শাহবাগের সেই মঞ্চ জনমনের আরও অনেক আকাঙ্ক্ষার কথা স্লোগানে স্লোগানে বলছিল। বিশেষ করে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গড়ার বিষয়টির গুরুত্ব ছিল এই আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য। বিপত্তির শুরুও সেখানেই৷ খুব দ্রুতই উগ্র ইসলামপন্থীদের নজর পড়ে ব্লগারদের ওপর৷ শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ সৃষ্টির কয়েক দিনের মাথায় খুন হতে শুরু করেন ব্লগার ও লেখকরা৷ কিছু কিছু প্রতিক্রিয়াশীল পত্রিকা মুক্তমনাদের নাস্তিক হিসেবে চিহ্নিত করে ছবি প্রকাশ করতে শুরু করে৷ পাল্টা রাজপথে নামে উগ্র ইসলামপন্থীরা, দাবি তোলে নাস্তিক ব্লগারদের সর্বোচ্চ শাস্তির এবং খুনও হতে থাকেন ব্লগাররা।
বাংলাদেশে একের পর এক ব্লগার হত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিক স্তরে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছিল তখন থেকেই। অভিজিৎ ছিলেন মার্কিন নাগরিক। জুলহাস মান্নান ছিলেন মার্কিন দূতাবাসের কর্মী। অভিজিতের স্ত্রীও মার্কিন নাগরিক এবং তিনি সেখানে এই হত্যার বিচারের দাবিতে সোচ্চার। যুক্তরাষ্ট্র নিজেও জঙ্গিবাদ ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে বহু বছর ধরে সক্রিয়।
অভিজিৎসহ সব ব্লগার হত্যা ও হলি আর্টিজান হামলার মূল পরিকল্পনাকারী বলে বারবারই উঠে আসছে সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকের নাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে দেশে একের পর এক ব্লগার, প্রকাশক ও লেখকদের হত্যাকাণ্ড সাধারণ মানুষের বুকে কাঁপন ধরিয়েছিল। নড়েচড়ে বসেছিল সরকারও। সেই তিন বছরে রাজধানীতে সাতটি জঙ্গি হামলায় আট জন খুন হন। আলোচিত এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে মাত্র একটির রায় হয়েছে। বাকি ছয়টি মামলার বিচারকাজ চলছে। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারে ধীরগতিতে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ বিচারপ্রার্থী স্বজনেরা ও সাধারণ মানুষ।
আলোচিত এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ না হওয়াটা নিঃসন্দেহে খারাপ দৃষ্টান্ত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার কার্যে সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি দেখবেন। কিন্তু এমনিতেও ধর্ম দিয়ে হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করার একটা বড় প্রবণতা আছে আমাদের ভেতর, যেটা ভয়ংকর। কোনও ব্লগারকে হত্যার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক হারে প্রচার করা হয় খুন হওয়া ব্লগার নাস্তিক ছিলেন এবং ইসলাম, মহানবীকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন৷ এই প্রচারণা সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে৷ ফলে রাজপথে প্রতিবাদে খুব কম লোককে অংশ নিতে দেখা যায়৷ এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমাজে প্রতিষ্ঠিত মানুষরাও আকারে, ইঙ্গিত খুন হওয়া ব্লগারের সমালোচনা করেন৷ রাজনৈতিক কর্মীরাও সক্রিয় হন না। এসব খুনের নিন্দা করা হলে উগ্র ইসলামপন্থীরা ক্ষুব্ধ হতে পারে, এমন এক ভয়ে সবাই প্রায় চুপ করে থাকছে।
এসব হত্যাকাণ্ডসহ সব খুনের ঘটনারই ন্যায্য বিচার মানুষের কাম্য। নাগরিক জীবন কীভাবে চলবে তা নিশ্চয়ই কিছু উগ্রবাদীর অঙ্গুলি হেলনে হবে না। কিন্তু সমস্যা হলো, আমাদের বৃহৎ মনোজগতে যে পরিবর্তন ঘটেছে সেটা নিয়ে ভাবা দরকার। নাস্তিক আখ্যা দিয়ে খুন করা যায়- সমাজ এই বেয়াদবি ও জঘন্য অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্রয়দাতাই নয়, তার প্রতি সমর্থনও দৃশ্যমান। পরিস্থিতি এমনই যে কেউ একজন ন্যায্যভাবে কথা বললেও তার ওপর ইন্টারনেটে সদলবলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে জঙ্গিগোষ্ঠী। রাষ্ট্রের নিকট মতামত বা মতাদর্শ-নির্বিশেষে নাগরিকের বা প্রতিষ্ঠানের যে নিরাপত্তা প্রাপ্য, সেটা পাওয়া যাবে না এই নাগরিক মনস্তত্ত্ব বদলাতে না পারলে।
সামগ্রিকভাবেই একটা ঘৃণার চর্চা সর্বত্র চলছে। সংগঠিতভাবে যে ঘৃণা, বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা ছড়ানো হয়, তারা স্বেচ্ছায় তার বাহক হয়ে ওঠে। উগ্রবাদীরা যা ভাবে, সেটা সমর্থন করার জন্য আছে এক ট্রল-বাহিনী। ভিন্ন মত, ভিন্ন রুচি, ভিন্ন আদর্শের সঙ্গে যে বৈরী ছাড়াও সম্পর্ক হতে পারে, সেটা আমরা আর ভাবতে পারছি না। বিপরীত মতের সঙ্গে আলোচনা হওয়া জরুরি বিপ্রতীপ অবস্থানটিকে বুঝতে পারার জন্য। আমাদের সেই শিক্ষাই যেন লোপ পেয়েছে। এবং আমরা সবাই হয়তো নানা স্তরে, নানাভাবে অসহিষ্ণুতার চর্চা করে এই বর্বরতাকে নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছি।
লেখক: সাংবাদিক, প্রধান সম্পাদক, জিটিভি
সান নিউজ/এফএইচপি