ড. মিল্টন বিশ্বাস
পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, আইন ও তথ্যসহ বাংলাদেশ সরকারের সকল মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তটি অযৌক্তিক। অভিযোগের তীর ‘র্যাব’ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দিকে নিক্ষেপ করা হয়েছে যা সত্যিই অবান্তর। কারণ শেখ হাসিনা সরকারের সময় ‘র্যাব’ সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চলেছে এবং ‘মাদক পাচারের’ বিরুদ্ধে জড়িতদের আইনের অধীনে এনেছে। যা মার্কিন প্রশাসনেরও অন্যতম লক্ষ্য। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হল অবৈধ মানবপাচার এবং অপরাধমূলক কার্যকলাপ বন্ধ করা। ‘র্যাব’ প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকেই বাংলাদেশে কার্যকর করে তুলছে।
আমরা জানি, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং উত্তম প্রশিক্ষিত নিরাপত্তা বাহিনী থাকা স্বত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ৬ লাখের বেশি লোক নিখোঁজ হয়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র তাদের পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়। অথচ FBI, CIA, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ইত্যাদির মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংস্থার প্রধানদের মানুষ নিখোঁজের জন্য শাস্তি দেওয়া হয় না। কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘন, ছয়’শত জন নিখোঁজ ইত্যাদির জন্য বাংলাদেশে ‘র্যাব’ দায়ী বলে মিথ্যা অভিযোগে কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ তারা মানবাধিকার রক্ষায় ও নির্ভয়ে একটি সুস্থ জীবনযাপনের অধিকার সমুন্নত রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন। আসলে র্যাবের কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান প্রধানকে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী হিসেবে চিহ্নিত করে, মার্কিন প্রশাসন অপরাধী এবং সন্ত্রাসীদের উৎসাহিত করছে যা তাদের মানবাধিকার রক্ষার লক্ষ্যের বিপরীত।
শেখ হাসিনা সরকার মানবাধিকার নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সকল সমালোচনা মোকাবেলা করে সরকার এক্ষেত্রে আরো কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। এজন্য ‘র্যাব’-এর মতো সংস্থাটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ অযৌক্তিক। বরং মানবাধিকারের উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের অগ্রগতি তারা বিবেচনা করবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
২.
১০ ডিসেম্বর (২০২১) আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট (রাজস্ব বিভাগ) ও পররাষ্ট্র দপ্তর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সাবেক ও বর্তমান ছয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা কর্মকর্তাদের মধ্যে র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ রয়েছেন। তিনি এখন বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি)। বেনজীর আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের নিষেধাজ্ঞার আওতায়ও পড়েছেন তিনি। এ ছাড়া র্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) তোফায়েল মোস্তাফা সরোয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) মো. জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) মো. আনোয়ার লতিফ খানের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগের বৈদেশিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণ দপ্তর সরকারের এক নির্বাহী আদেশের (নম্বর ১৩৮১৮) আওতায় এ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এ আদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন বা দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত ব্যক্তির সম্পদ বাজেয়াপ্তের কথা বলা হয়েছে। রাজস্ব বিভাগের বিজ্ঞপ্তিতে র্যাবকে একটি বিদেশি সংস্থা হিসেবে মার্কিন সরকারের নির্বাহী আদেশের অধীনে রাখা হয়েছে। এর ফলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে র্যাবও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগের সংবাদ বিজ্ঞপ্তির তথ্য অনুযায়ী, মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য বিভিন্ন দেশের ১৫ ব্যক্তি এবং ১০ প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়াও চীন, মিয়ানমার ও উত্তর কোরিয়ার কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। চীনের চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে জিনজিয়াংয়ে উইঘুরসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের কারণে। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, যারা নিপীড়ন চালাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করবে, তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র কথা বলবে।
৩.
যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ নিয়ে মানবাধিকারের চিন্তা পুরোটাই হাস্যকর। কারণ তাদের নিজেদের দেশেই রয়েছে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ। ২০২০ সালের জুন মাসে আমেরিকার মিনিয়াপোলিসে পুলিশের নির্মমতায় প্রাণ হারানো কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু ছিল সেদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘৃণ্য ঘটনা। সেসময় যখন দেশটির নানা জায়গায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ চলছে, তখন সেসব বিক্ষোভের সময়ও পুলিশি নির্মমতার বেশ কিছু ভিডিও মানুষকে স্তম্ভিত করেছে। মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও পাকিস্তানের মতো জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের রয়েছে নিবিড় যোগাযোগ। আর আমেরিকার বন্দিদের প্রতি আচরণের কথা তো বিশ্ববাসী জানে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূ-খণ্ডের বাইরে কিউবার দক্ষিণ-পূর্ব পাশে ক্যারিবীয় সাগরে স্থাপিত (২০০২) গুয়ানতানামো কারাগার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কারাগার যা বন্দীদের ওপর অমানুষিক নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত। এই কারাগারে বন্দীদের বিনাবিচারে আটক রাখা হয় এবং তথ্য আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে বন্দীদের ওপর যৌন অত্যাচার, 'ওয়াটার বোর্ডিং'-সহ বিবিধ আইনবহির্ভূত উপায়ে নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের প্রকার ও মাত্রা এতই বেশি যে এই কারাগারকে ‘মর্ত্যের নরক’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ সত্ত্বেও এই কারাগারটিকে অব্যাহতভাবে নির্যাতনের জন্য ব্যবহার করতে থাকায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে একে মার্কিনীদের ‘লজ্জা’ হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বা এইচআরডব্লিউ মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর সমালোচনা করে চলেছে প্রতিনিয়ত। এক প্রতিবেদনে তারা বলেছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গ উভয় বর্ণের মানুষ সমপরিমাণে মাদক সংক্রান্ত অপরাধে জড়িত রয়েছে। এ সত্ত্বেও মাদক সংক্রান্ত অপরাধের দায়ে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকহারে আটক এবং বিচার করা হয়। আমেরিকার জনসংখ্যার মাত্র ১২ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী হলেও মাদক সংক্রান্ত অপরাধের দায়ে আটক ব্যক্তিদের ২৯ শতাংশই কৃষ্ণাঙ্গ। আমেরিকায় সাদাদের তুলনায় কালো মানুষদের ছয় গুণ বেশি আটকের ঘটনা ঘটে। পুলিশের হাতে অধিক হারে নিরস্ত্র আফ্রিকান-আমেরিকান হত্যার বিষয়টিও যুক্তরাষ্ট্রের জঘন্য ঘটনা।
আসলে নানা অপকর্মর জন্য মার্কিনীদের ‘লজ্জা’ থাকলেও তারা অপর দেশের সমস্যা নিয়ে বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করে হরহামেশায়। ১০ ডিসেম্বরে(২০২১) তারা আসলে মানবাধিকারের কথা বলতে গিয়ে ‘র্যাব’কে টার্গেট করেছে। মনে রাখা দরকার যুক্তরাষ্ট্র এর আগেও বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাব নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে বিশ্ববাসীকে ভুল বার্তা দিতে চেয়েছিল। যেমন, ১৯ জানুয়ারি ২০১৭ সালে নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার রায়ের পর বাংলাদেশ সরকারের ‘র্যাব’ বিলুপ্ত করা উচিত বলে মন্তব্য করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। র্যাবকে তারা ‘ইন হাউজ ডেথ স্কোয়াড’ বলেছিল এবং বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন ও গুমের ঘটনায় তাদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে সরকারের ভূমিকারও সমালোচনা করেছিল। অথচ নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের দায়ে এই বাহিনীর ২৫ সদস্য শাস্তি পেয়েছে। তাদের মধ্যে ১৬ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং নয় সদস্যের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়েছে। ফলে ১২ বছরে অর্জিত র্যাব-এর বিভিন্ন সাফল্যকে ছোট করে দেখার প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছিল। কিন্তু এই সংস্থাটির ব্যর্থতার পাল্লার চেয়ে সাফল্যের দৃষ্টান্ত বেশি। এজন্য র্যাব একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা।
কারণ র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন ‘র্যাব’ বাংলাদেশ পুলিশেরই অপরাধ ও সন্ত্রাস বিরোধী ‘এলিট ইউনিট’ হিসেবে ইতোমধ্যে দেশের জনগণের আস্থাশীল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ গঠিত র্যাবের সদস্য হিসেবে সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীসহ পুলিশ, আনসার, বর্ডার গার্ড (বিজিবি) নিযুক্ত করা হয়। একই বছর ১৪ এপ্রিল থেকে কার্যক্রম শুরু করে র্যাব শেখ হাসিনা সরকারের আমলে দেশের আইনশৃঙ্খলাসহ আমাদের নিরাপত্তার সামগ্রিক দায়িত্বে প্রশংসনীয় অনেক অবদান রেখেছে। আমেরিকা, জার্মান, চীন, ইসরাইল প্রভৃতি দেশের তৈরি আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত র্যাব সদস্যরা ব্যাটনও ব্যবহার করে থাকেন উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজনে। অভ্যন্তরীণ ৯টি বিভাগ নিয়ে র্যাবের প্রধান দপ্তর তাদের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। ডগ স্কোয়াড, বোমা নিষ্ক্রিয় ইউনিটসহ গোয়েন্দা শাখাগুলো রাষ্ট্র ও সাধারণ মানুষের প্রয়োজনে সর্বদা তৎপর। ‘লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং’ জনগণকে তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত করে; অপারেশনের বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা দিয়ে থাকে। র্যাব সদস্যদের সন্ত্রাস প্রতিরোধে ট্রেনিং গ্রহণ বাধ্যতামূলক। তাদের ইন্টেলিজেন্স ও ইনভেস্টিগেশন কোর্সের বেসিক পাঠ, প্রাথমিক ড্রাইভিং, কম্পিউটার ও নেটওয়ার্কিং-এর জ্ঞান অর্জন করতে হয়।
এছাড়া ফরেনসিক বিভাগ তাদের তদন্ত প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করে। দেশজুড়ে র্যাবের ১২টি ব্যাটেলিয়নের মধ্যে ৫টিরই অবস্থান রাজধানীতে। মূলত র্যাব দেশের সকল এলাকা থেকে অপরাধীদের তথ্য সংগ্রহ করে। প্রাপ্ত তথ্য তাদের ইন্টেলিজেন্স উইং নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই ও নিশ্চিত করার পর দ্রুত অভিযান পরিচালনা করে। র্যাবের দায়িত্ব ও কর্তব্য দিন দিন আরও বাড়ছে। কারণ ধর্মীয় জঙ্গিবাদ দমনে র্যাবের সাফল্যের পাশেই রয়েছে নতুন নতুন সন্ত্রাসী তৎপরতা। আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের সঙ্গে দেশীয় জঙ্গিদের সম্পর্কের বিষয়ে সাইবার-ক্রাইম সংঘটিত হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, স্থান ও ব্যাটলিয়নসমূহের দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় তাদের নিয়মিত টহল ডিউটি রয়েছে। এই টহল আরও বিস্তৃত করার সময় এসেছে। কারণ তাদের ওপর সরকারসহ সাধারণ জনগণের আস্থা রয়েছে। এমনকি সন্ত্রাসী গ্রেপ্তারের অভিযানে গোলাগুলির মধ্যে পড়ে গত ১৭ বছরে অনেক র্যাব সদস্য নিহত এবং পাঁচ’শরও বেশি মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ বিষয়ে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক খান মোহাম্মদ (কেএম) আজাদ বলেছেন, ‘আমরা কখনো মানবাধিকার লঙ্ঘন করি না। সব সময় মানবাধিকার রক্ষা করি। তিনি বলেন, যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, খুন করে ধর্ষণ করে মাদক ব্যবসা চালায়, দেশ এবং জনগণের স্বার্থেই আমরা তাদের আইনের আওতায় আনি। অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়ে থাকে, তাহলে দেশের স্বার্থে এই মানবাধিকার লঙ্ঘন করতে আমাদের আপত্তি নেই।’
৪.
‘র্যাবের কাজ আইনশৃঙ্খলার বিধান বলবৎ ও কার্যকর করা। দেশের বিচারব্যবস্থার কাছে অপরাধীকে তুলে দেওয়া। দেশকে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের কবল থেকে মুক্ত রাখা। সাইবার-ক্রাইম রোধ করা। সহিংসতা রোধে মানুষের জানমালের নিরাপত্তায় তাদের সব সময় আইনের পথে পরিচালিত হতে হয়। বলা হয়ে থাকে, দোষী ব্যক্তিকে আইনের মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করলে অপরাধ কমে যাবে; নির্মূল হবে অরাজকতা। আইন-কানুনের বৈধতা দিয়ে অপরাধীকে কারারুদ্ধ করলে সমাজ থেকে অপরাধ ক্রমান্বয়ে অপসৃত হবে। র্যাবের ভিশন হলো সকল নাগরিককে বসবাস ও কাজের সুন্দর এবং নিরাপদ আঙিনা তৈরি করে দেওয়া। এ কাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা, নাগরিকদের নিরাপত্তা ও জানমাল রক্ষা করা, অপরাধ রোধ করা, অপরাধীকে বিচারের সম্মুখীন করা তাদের প্রধান কাজ। জনজীবনে শান্তি ও সুখ আনয়নে এ সমস্ত ব্যবস্থাকে সর্বদা গুরুত্ব দিতে বাধ্য তারা। মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে হলে আইনশৃঙ্খলা ভালো হতে হবে সেই ব্যবস্থা বহাল রাখার জন্য র্যাবের ভূমিকা অনন্য। দুর্ধর্ষ অভিযানে গিয়ে সন্ত্রাসী মারা পড়লে কিংবা বোমা ও বিস্ফোরক উদ্ধারে জীবন বাজি রেখে অপারেশন চালালে তার প্রশংসা পান না তারা। অথচ র্যাব সদস্যরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তথ্যপ্রযুক্তি অপরাধীদের শনাক্ত করতে সক্ষম হচ্ছেন। সমাজে স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখার জন্য তাদের কৃতিত্ব অনেক বেশি। অপরাধ দমন করে মানুষকে নিরাপদ জীবন নির্বাহ করার অক্লান্ত পরিশ্রম সার্থক হবে তাদের প্রতি আস্থার জায়গাটি চির জাগরুক থাকলে।
এজন্যই র্যাব ও তার ছয় কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। কারণ এদেশের র্যাব-পুলিশ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত না। লেখাবাহুল্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বস্তুনিষ্ঠভাবে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। তারা অতিরঞ্জিত সংবাদের ওপর ভিত্তি করে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কারণ এদেশের পুলিশ কখনো কাউকে ক্রসফায়ার বা বিচার বহির্ভূত হত্যা করে না। বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা চ্যালেঞ্জিং। তবু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সুন্দরভাবেই সেই দায়িত্ব পালন করছে। তাঁর মতে, এদেশে অপরাধীদের মৃত্যুর বড় একটা কারণ, যখন সন্ত্রাসীদের ধরতে যাওয়া হয় তখন তারা সারেন্ডার করে না। তখন আত্মরক্ষার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলি ছুঁড়তেই হয়। তারপরও পুলিশ গুলি ছুঁড়লে সেটার তদন্তভার একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে দেয়া হয়। তদন্তে কোনো গাফিলতি ধরা পড়লে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়। বাংলাদেশ পুলিশ আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ আইন মেনে নিজেদের পরিচালনা করে আসছে। নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তির বিরুদ্ধে ১৯৮৪ সালের জাতিসংঘ কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী হিসেবে, বাংলাদেশ তার দেশীয় আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করেছে। কনভেনশনের অধীনে তার বাধ্যবাধকতা। এক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনে আইন প্রয়োগকারী কর্মীদের জড়িত থাকা প্রমাণিত হলে, আইন নিজস্ব গতিপথ গ্রহণ করে এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
আসলে পুলিশ এবং এলিট ফোর্স র্যাবের দীর্ঘ অর্জিত ইমেজ ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ করতে শুরু হয়েছে নানামুখী ষড়যন্ত্র। ইতোমধ্যেই সেই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের নকশায় র্যাবের বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর কথিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বানোয়াট এক অভিযোগ তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র।
৫.
মার্কিনিদের মানবাধিকারের বুলিকে ফুৎকারে উড়িয়ে রীতিমতোন তাদের ধুয়ে দেওয়া হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াতে। বলা হচ্ছে, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পুলিশ নির্বিচারে সাধারণ মানুষ এবং শিশুদের হত্যা করছে। জাতিগত বৈষম্য, ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা, এবং পররাষ্ট্রনীতিসহ নানা ক্ষেত্রে আমেরিকায় মানবাধিকার লঙ্ঘন স্পষ্ট। দেশটির পুলিশের হাতে আফ্রিকান-আমেরিকানদের হত্যা এবং আটক করার ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘন ওপেন সিক্রেট। এমন দেশটির মুখে মানবাধিকারের ‘ছবক’ একেবারেই বেমানান। ইতোপূর্বে চীনও মানবাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভণ্ডামির অভিযোগ তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয়, বর্তমান সরকারের সঠিক দিক-নির্দেশনায় দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এবং জাতির সংকটকালীন আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখায় র্যাবের অবদান আজ অনস্বীকার্য। কারণ অস্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আমাদের উন্নতির পথে অন্যতম বাধা। এজন্য অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, অবৈধ অস্ত্র-গোলাবারুদ, বিস্ফোরক এবং এই ধরনের ক্ষতিকারক দ্রব্য উদ্ধার, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষায় অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা প্রদান, যে কোনো সংঘটিত অপরাধ ও অপরাধীদের সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য প্রদান, সরকারি আদেশ অনুসারে অপরাধের তদন্ত করাসহ অন্যান্য সরকারি দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে ‘র্যাব’ সর্বদা নিয়োজিত।
বস্তুত আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সাহসিকতা, বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা ও জনসেবার জন্য স্বাধীনতা পুরস্কারসহ নানা স্বীকৃতি পেয়েছে ‘র্যাব’। র্যাবের কর্মকর্তাগণ পেয়েছেন নানান পদক। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। এজন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সমুন্নত রাখা। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যার জন্ম তার জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। দেশটি বারবার মানবাধিকার রক্ষায় তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। গত ১২ বছরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করতে আইনের শাসন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের উন্নতিতে এদেশ অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় আমাদের দরজা খোলার মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে মানবাধিকারের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার প্রমাণিত হয়েছে। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে যুক্তরাষ্ট্র পক্ষপাতমূলক আচরণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। অথচ শেখ হাসিনা সরকার মানবাধিকার নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সকল সমালোচনা মোকাবেলা করে সরকার এক্ষেত্রে আরো কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। এজন্য ‘র্যাব’-এর মতো সংস্থাটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ অযৌক্তিক। বরং মানবাধিকারের উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের অগ্রগতি তারা বিবেচনা করবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : ইউজিসি পোস্ট ডক্টোরাল ফেলো, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
সান নিউজ/এফএইচপি