প্রভাষ আমিন
কোনও শিক্ষার্থী মারা গেলে বিশেষ করে সড়ক দুর্ঘটনা বা হত্যাকাণ্ডের শিকার হলে আমরা লিখি মেধাবী শিক্ষার্থীর মৃত্যু। কিন্তু আবরার ফাহাদ সত্যিই মেধাবী ছিলেন। দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরাই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটে পড়ার সুযোগ পায়, এ ব্যাপারে আশা করি কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন না। আবরার ফাহাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজেও সুযোগ পেয়েছিলেন। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তিও হয়েছিলেন। কিন্তু বুয়েটের টানে তিনি ছেড়ে আসেন ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন। তার সব স্বপ্ন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে দ্বিতীয় বর্ষে উঠতে না উঠতেই। আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনাটি বেশি দিন পুরনো নয়। আপনাদের সবার নিশ্চয়ই মনে আছে এখনও সেই নৃশংসতার কথা। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে আবরার ফাহাদকে তার কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা স্রেফ পিটিয়ে মেরে ফেলে। এখানেই আমার বিস্ময়। আবরারকে যারা পিটিয়েছে, তারাও বুয়েটেরই শিক্ষার্থী। তারাও তো মেধাবীই। কিন্তু এই মেধার ভেতরে এতটা নৃশংসতা কীভাবে লুকিয়ে থাকতে পারে, এই বিস্ময় আমার যায় না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সন্ত্রাস, হানাহানি নতুন কিছু নয়। দুই পক্ষের সংঘর্ষে হঠাৎ গুলিতে কারও মারা যাওয়া বা টার্গেট করে কাউকে হত্যা করা বা বেমক্কা এক ঘুষিতে মরে যাওয়া এক কথা। আর একজন সহপাঠীকে রাতভর পিটিয়ে পিটিয়ে রসিয়ে রসিয়ে হত্যা করা; সম্পূর্ণ আলাদা কথা। আবরারকে পেটাতে পেটাতে তারা রাতের খাবার খেয়েছে, খেলা দেখেছে। এই নৃশংসতার কোনও নজির নেই। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের এই নৃশংসতার তুলনা হতে পারে কেবল ছাত্রলীগের সঙ্গেই। ২০১২ সালে পুরান ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা কুপিয়ে হত্যা করেছিল বিশ্বজিৎ দাসকে। এ দুটি ঘটনায় কোনটি বেশি নৃশংস তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। অনেকেই বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডকেই শীর্ষে রাখবেন। কারণ, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল দিনের বেলায় সবার চোখের সামনে। সব টিভির ক্যামেরায় তার ছবি আছে। তবে সেটিও ক্ষণিকের উত্তেজনায়, অল্প সময়ের মধ্যে ঘটেছে। আর বিশ্বজিতকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতাকর্মীরা চিনতোও না। স্রেফ সন্দেহের ভিত্তিতে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আমার বিবেচনায় আবরার হত্যাকাণ্ডটিই নৃশংসতম। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে রুম থেকে ডেকে নিয়ে দলবেঁধে দফায় দফায় পিটিয়ে হত্যা করার মধ্যে ঠান্ডামাথায় নির্মমতার যে উদাহরণ, তার কোনও তুলনা নেই।
মাত্র দুই বছরের মাথায় আবরার হত্যা মামলার রায় হয়েছে। রায়ে ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। এ রায় অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক। তবে নিম্ন আদালতের এ রায় বাস্তবায়নের আগে আরও অনেক ধাপ পেরুতে হবে। হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট অনেক ধাপ রয়েছে সামনে। আমরা চাই, নিম্ন আদালতের রায়ের মতো পরবর্তী ধাপগুলোও যেন দ্রুতই সম্পন্ন হয়। আবরার হত্যা মামলার রায়টি অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক এবং নজিরবিহীন।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘দণ্ডিতের সঙ্গে দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমানে আঘাতে; সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।’ আবরার হত্যা মামলার রায়ের ক্ষেত্রে এই কথাটি প্রযোজ্য। এই ঘটনায় আবরার তো নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেনই; একই সঙ্গে ধ্বংস হয়ে গেছে আরও ২৫ মেধাবীর জীবনও। দণ্ডিত ২৫ জনই বুয়েটের শিক্ষার্থী। এমন মেধাবী ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৫ জনকে যাবজ্জীবন দিতে গিয়ে বিচারকের হৃদয়ও নিশ্চয়ই ক্ষণিকের জন্য হলেও কেঁদেছে। যতই কাঁদুক, খুনির বিচার ফাঁসি। এখানে ন্যূনতম অনুকম্পা দেখানোর কোনও সুযোগ নেই।
আবরার ফাহাদের অপরাধ ছিল, তিনি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তাকে পিটিয়ে বলে বেড়ায়, শিবির সন্দেহে আবরারকে পেটানো হয়েছে। যেন শিবির হলেই তাকে পেটানোর অধিকার আছে। জামায়াত-শিবিরকে আমি ঘৃণা করি। তাদের নিষিদ্ধ করার দাবিও করছি দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু এখনও বাংলাদেশে শিবির কোনও নিষিদ্ধ সংগঠন নয়। তাই কেউ শিবির করলেই তাকে পেটানো বৈধ নয়। আর শিবির হোক আর যেই হোক, কেউ বেআইনি কিছু করলে, সেটা দেখার জন্য সরকার আছে। ছাত্রলীগ যখন আইন হাতে তুলে নেয়, তখন বুঝতে হবে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর, আইনের শাসনের ওপর তাদের আস্থা নেই।
বলা হয় দৃষ্টান্তমূলক সাজা অপরাধ কমাবে। কিন্তু কমছে না তো। ক্ষমতার দম্ভে ছাত্রলীগ যেন আরও বেপরোয়া। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেআইনি কর্মকাণ্ড, হল দখল, গেস্টরুম, গণরুম- নানা প্রক্রিয়ায় তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চালায়। কুয়েটে তাদের নির্যাতন থেকে রক্ষা পায়নি শিক্ষকও। এমনকি তাদের নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বেও বিপর্যস্ত হয় শিক্ষার পরিবেশ। কারও জীবন গেলেই শুধু তা আলোচনায় আসে। এছাড়া প্রতিদিন ছাত্রলীগের নির্যাতনের শত খবর আড়ালেই থেকে যায়।
নিম্ন আদালতের রায়ে দণ্ডিত বুয়েট ছাত্রলীগের ২৫ নেতাকর্মী কিন্তু খুনি হিসেবে বুয়েটে ভর্তি হয়নি, মেধার ভিত্তিতেই ভর্তি হয়েছিল। একটা দুইটা আলোচিত মামলার রায়ে খুনি বানানোর এই প্রক্রিয়া বন্ধ হবে না। কারা তাদের খুনি বানায়, তাদেরও খুঁজে বের করতে হবে। আর শুধু রায়ের দৃষ্টান্তেই অপরাধ থামবে না। সে রায় কার্যকর করতে হবে। ৯ বছর পরও বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার রায় কার্যকর হয়নি। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই সমাজে।
আগেই যেমন বলেছি, ক্ষমতার দম্ভে বেপরোয়া হয়ে ওঠা সরকারি দলের নেতাকর্মীদের থামাতে উৎসের সন্ধান করতে হবে। লতিফ সিদ্দিকী বা জাহাঙ্গীর আলমের পরিণতিও নিবৃত্ত করতে পারেনি ডা. মুরাদ হাসানকে। চাঁদাবাজির অভিযোগে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের বহিষ্কারের পরও থামানো যায়নি ছাত্রলীগকে। তাই শুধু নিম্ন আদালতের রায়ের দৃষ্টান্ত হলেই হবে না, তা অনুসরণও করতে হবে। তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগ, পৃষ্ঠপোষকদেরও সাজা, দ্রুত বিচার, রায় কার্যকরই কেবল পারে এই প্রবণতা থামাতে। নইলে আওয়ামী লীগের অনেক অর্জন হারিয়ে যাবে, ছাত্রলীগের এমন অনেক অপকর্মে।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
সান নিউজ/এফএইচপি