আনিস আলমগীর
গত ১৮ নভেম্বর বাসে অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। ২৪ নভেম্বর গাড়িচাপায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের মৃত্যুর পর তা রূপ নেয় নিরাপদ সড়কের ৯ দফা দাবির আন্দোলনে। এর মধ্যে ২৯ নভেম্বর রাতে রামপুরায় বাসের চাপায় নিহত হয় এসএসসির ফলপ্রত্যাশী মাঈনুদ্দিন ইসলাম। শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের এই দাবি ১১ দফায় রূপ নিয়েছে।
গাড়িভাড়া বাড়ার পর বাস মালিকরা প্রথমে বললেন শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়া হবে না। শিক্ষার্থীরা শুধু হাফ ভাড়া নয়, সড়কে নৈরাজ্য দমনের দাবি নিয়ে রাস্তায় নামে। এরপর ৩০ নভেম্বর বাস মালিকরা ঘোষণা করলো ঢাকায় গণপরিবহনে ‘হাফ ভাড়া’ কার্যকর হবে ১ ডিসেম্বর থেকে। কিন্তু নানা শর্তে। আবার ঢাকার বাইরের শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো ঘোষণা নেই।
আমাদের শিক্ষা জীবনে, আমাদের বড় ভাইদের আমলে, স্বাধীনতার আগে-পরে এই হাফ ভাড়ার সুযোগ আমরা কে পায়নি? মন্ত্রী-এমপি-রাজনৈতিক নেতা-আমলা-ব্যবয়ায়ী-সবাই পেয়েছিল। মন্ত্রী-আমলা কি তা ভুলে গেছেন? এইসব আংশিক প্যাঁচ লাগিয়ে পরিস্থিতি যে ঘোলাটে করা হচ্ছে তারা কি সেটা জানেন না?
একদিকে শিক্ষার্থীরা হাফ পাসের দাবিতে আন্দোলন করছে, অন্যদিকে নিরাপদ সড়কের দাবিতেও সোচ্চার তারা। তাদের প্রধান দুটি দাবিই যৌক্তিক দাবি। সড়কে এক নৈরাজ্য চলছে বেশ কয়েক বছর ধরে। সেই নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে ছাত্র-ছাত্রীরা যখন রাস্তায় নামলো আইনও পাস করা হলো। কিন্তু তার কোনো বাস্তবায়ন নেই তিন বছর ধরে। সড়ক এখন আরও অস্থিতিশীল। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে করোনার কারণে প্রায় দুই বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এই বন্ধের পর যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে, তখন তাদের শ্রেণিকক্ষে থাকার কথা ছিল। কিন্তু তারা রাস্তায় আন্দোলন করছে, যাদের সিংহভাগ এখনো করোনা টিকাও পায়নি।
তাদের রাস্তায় নামাটা দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। কিন্তু ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত থেকে এখন পর্যন্ত যা কিছু হচ্ছে, সড়কে যে বিশৃঙ্খল অবস্থা চলছে- সব দেখে বোঝার উপায় নেই সড়ক মন্ত্রণালয় বলে কিছু আছে। ভাড়া বাড়ানোর মতো জনগণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে আমলারা। মন্ত্রিসভায় কোনো আলোচনা নেই, পার্লামেন্ট চলমান ছিল কিন্তু সেখানেও কোনো কথা নেই। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ছাত্রদের হাফ ভাড়ার দাবি মেনে নিলেও বলছে সেটা শুধু ঢাকা শহরের জন্য। পুরোটাই যেন তামাশা।
পরিবহন মালিকদের নেতা খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ হাফ ভাড়ার ঘোষণা দিতে গিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, হাফ ভাড়া দেয়ার সময় নিজ প্রতিষ্ঠানের ছবিযুক্ত আইডি কার্ড থাকতে হবে এবং সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এটি কার্যকর থাকবে। তবে সাপ্তাহিক ও মৌসুমি ছুটির সময় হাফ ভাড়া কার্যকর থাকবে না এবং হাফ ভাড়ার এ সিদ্ধান্ত ঢাকার বাইরে প্রযোজ্য হবে না।
আইডি কার্ডের বিষয়টি অবশ্যই গ্রহণযোগ্য কথা কিন্তু আমাদের ছাত্রছাত্রীরা সবাই কি তাহলে ঢাকায় বা রাজধানীতে থাকে? শুধু ঢাকা সিটির শিক্ষার্থীরাই ছাত্রছাত্রী? সারাদেশের স্কুল-কলেজপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা শিক্ষার্থী না? কার উদ্ভট মস্তিষ্ক থেকে অমার্জনীয়, বৈষম্যপূর্ণ সিদ্ধান্তটি এলো! সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা মানে কি? ছুটির দিন মানে কি- ওই সময়ে সে শিক্ষার্থী নয়?
আমাদের শিক্ষাজীবনে, আমাদের বড় ভাইদের আমলে, স্বাধীনতার আগে-পরে এই হাফ ভাড়ার সুযোগ আমরা কে পাইনি? মন্ত্রী-এমপি-রাজনৈতিক নেতা-আমলা-ব্যবয়ায়ী-সবাই পেয়েছিলেন। মন্ত্রী-আমলা কি তা ভুলে গেছেন? এসব আংশিক প্যাঁচ লাগিয়ে পরিস্থিতি যে ঘোলাটে করা হচ্ছে তারা কি সেটা জানেন না?
মিডিয়া রিপোর্টে দেখলাম, প্রথম দিনই অবশ্য হাফ ভাড়া নিয়ে পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার চেয়ে আরও জটিল হয়েছে। কোথাও ৪০ টাকার হাফ ৩০ টাকা, কোথাও কথাকাটাকাটিতে শিক্ষার্থীদের নামিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আশপাশের জেলা থেকে ঢাকায় পড়তে আসা শিক্ষার্থীরা বিপাকে পড়েছে।
শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ৩০ নভেম্বর রাজধানীতে বাসে অর্ধেক ভাড়ার দাবি মেনে নেওয়ার যে ঘোষণা পরিবহন মালিকরা দিয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীরা বলছে, নিরাপদ সড়কের জন্য তাদের দাবিগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে অর্ধেক ভাড়া কার্যকর করা। বাকি দাবিগুলো না মানা পর্যন্ত তারা রাজপথ ছাড়বেন না। আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। এছাড়া অর্ধেক ভাড়ার যে ঘোষণা, সেটা কেবল রাজধানীর জন্য। সারাদেশে কার্যকর করার দাবিও রয়েছে। শিক্ষার্থীদের নতুন দাবিগুলোর প্রধান তিনটি হলো—
১.সড়কে নির্মম কাঠামোগত হত্যার শিকার নাঈম ও মাঈনুদ্দিনের হত্যার বিচার করতে হবে। তাদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। গুলিস্তান ও রামপুরা ব্রিজসংলগ্ন এলাকায় পথচারী পারাপারের জন্য পথচারী-সেতু নির্মাণ করতে হবে।
২. সারাদেশে সব গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের হাফ পাস সরকারি প্রজ্ঞাপন দিয়ে নিশ্চিত করতে হবে। হাফ পাসের জন্য কোনো সময় বা দিন নির্ধারণ করে দেওয়া যাবে না। বর্ধিত বাসভাড়া প্রত্যাহার করতে হবে। সব রুটে বিআরটিসির বাসের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।
৩. গণপরিবহনে ছাত্রছাত্রী এবং নারীদের অবাধ যাত্রা ও সৌজন্যমূলক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বাকি দাবিগুলো নিরাপদ পরিবহন ও সংশ্লিষ্ট সেক্টরের শ্রমিকসহ সবার স্বার্থসংশ্লিষ্ট।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরই মধ্যে গাড়ি ভাঙার নৈরাজ্য নিয়ে মুখ খুলেছেন। ১ ডিসেম্বর এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘রাস্তায় নেমে গাড়ি ভাঙা ছাত্রদের কাজ নয়, এটা কেউ করবেন না। দয়া করে যার যার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যান, লেখাপড়া করেন। আর যারা দোষী, তাদের খুঁজে বের করে অবশ্যই শাস্তি দেওয়া হবে, সেটা আমরা করব।’
খুব দুঃখজনক যে, ২০১৮ সালে প্রণীত সড়ক পরিবহন আইনের বিরুদ্ধে মালিক ও শ্রমিক এককাট্টা। তারা কিছুতেই আইন বাস্তবায়ন করতে দিতে চাইছেন না। কিন্তু সরকার তো দুর্বল সরকার নয়, ঝুলন্ত পার্লামেন্ট নেই দেশে। কোন ভয়ে আইন বাস্তবায়নের বাধাগুলো দূর করতে পারছে না তারা?
মনে পড়ছে যে ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীরা যখন রাস্তায় নেমে এসেছিল তাতে ঘি ঢালার জন্য তৃতীয় পক্ষের আমদানি হয়েছিল। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে হাইজ্যাক করতে চেয়েছিল ইসলামি ছাত্রশিবিরসহ জঙ্গিরা। এখনও রাজপথ থেকে যেন ছাত্রছাত্রীরা ঘরে ফিরে না যায় সেই পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছে। ঢাকার দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলে যাচ্ছে ঢাকার বাইরে। ইতিমধ্যে তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। শুধু ঢাকায় নয় ঢাকার বাইরেও শিক্ষার্থীদের গাড়ি চাপা দিয়ে মৃত্যুর ঘটনায় শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামছে। রাস্তা অবরোধ করে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিচ্ছে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
সান নিউজ/এফএইচপি