তুষার আবদুল্লাহ
সকালে পথে নেমেছি। নেমেই নগর সেবকদের আবর্জনার গাড়ির মুখোমুখি। পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে-পেছনে বাহনের জট লেগে গেলো। ট্রাকের চালক দেখলাম না। চতুর্দিক থেকে হর্ন বাজছে। শব্দদূষণ অসহনীয় হয়ে উঠলো। বেশ কিছুক্ষণ পর একজন এলেন। তিনি ট্রাকটিকে যেভাবে নড়াতে-চড়াতে শুরু করলেন তা একরকম আতঙ্কেরই।
আগের রাতেও এমন হয়েছে। রিকশায় ধানমন্ডির হাসপাতাল এলাকায় ঘোরাঘুরি করতে হচ্ছিল; তখন যেভাবে গর্জন করে ট্রাক ছুটছিল, মনে হচ্ছিল–নটর ডেমের শিক্ষার্থী বা এনটিভি অনলাইনের সাবেক সংবাদকর্মীর মতো পরিণতি আমাদের যে কারোরই হতে পারে, যেকোনও মুহূর্তে।
পথে যে শুধু সিটি করপোরেশনের আবর্জনা বহনকারী ট্রাক বেপরোয়া তা নয়। ব্যক্তি, দফতর, প্রতিষ্ঠান সবার চলাচল বেসামাল। গত রাতেই ধানমন্ডিতে দেখলাম মোটরবাইক ও গাড়ি নিয়ে বীভৎস চিৎকারে উদ্দাম প্রতিযোগিতা চলছে। অথচ প্রতিদিনই এমন উদ্দাম প্রতিযোগিতায় তারুণ্যের মৃত্যুর খবর আসছে। কোনও মৃত্যুকেই আমরা পরোয়া করছি না। তার মানে এই যে আমরা চলছি, আমরা কি সংজ্ঞাহীন?
মানুষ, সমাজ কখন সংজ্ঞাহীন হয়? যখন সইতে না পারার চেয়ে বেশি কোনও কিছুর চাপ বা ভার তার ওপর চেপে বসে কিংবা প্রবেশ করে অথবা তৈরি হয় কোনও শূন্যতা। সেটি লবণ, পুষ্টি, খনিজ যাই হোক না কেন। আমরা দেখছি, মানুষ ও সমাজের একটি অংশ সচ্ছলতার অতিপুষ্টি ভোগের সুযোগ পাচ্ছে। অথচ এত সচ্ছলতা তার গঠন প্রক্রিয়াতেই ছিল না। এই সচ্ছলতা যেমন টাকার, তেমনই ক্ষমতারও। হঠাৎ ক্ষমতা ও টাকার সচ্ছলতা সইতে না পেরে আমরা একরকম ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছি। চলাচলে সংজ্ঞা হারানোর লক্ষণ।
সংজ্ঞা হারানোর আরেকটি কারণ হলো আমরা হারিয়েছি আমাদের মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ। যে কারণে আমরা দেখছি– সিটি করপোরেশনের অধিকর্তা যেমন জানেন না তার নিয়ন্ত্রণাধীন ময়লার ট্রাক সকালে চলাচল করে, তেমনই অভিভাবক হিসেবেও আমার কাছে অজানা সন্তান কোথায়, কেন সারা রাত কাটালো, তার বন্ধু কারা? দায়িত্বহীন বলেই অসময়ে তার হাতে তুলে দিচ্ছি গাড়ির চাবি।
সচ্ছলতার আস্ফালন। বেসামাল গতি নিয়ে বছরের পর বছর কথা বলে যাচ্ছি। লিখছি। আমাদের সন্তানরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮-তে পথে নামলো। কিন্তু সড়কে মৃত্যুর মিছিল বন্ধ হলো না। শিক্ষার্থীর মৃত্যুর খবরে প্রতিদিন কেঁপে উঠছে বুক। সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলো না কেন?
পরিবহনের গতি ও আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য যেটুকু আইন আছে, সেটুকুও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতি। প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতিগ্রস্ত বলেই, তাদের পরোয়া করার বিন্দু তাগিদ নেই পরিবহন মালিক, চালক, শ্রমিকদের।
শিক্ষার্থী, জনতার প্রতিরোধ, সরকারের নির্দেশনার পরও পরিবহন খাত আপন খেয়াল-খুশিতে চলছে। সড়কে তাদের চলাচল পথচারীদের তাচ্ছিল্য করে। এই দুঃসাহস তারা পান, পেশা বা পেশাজীবীদের রাজনীতিকরণে। যাত্রী পরিবহনের সরকারি-বেসরকারি খাত থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশনের ট্রাক চালক-শ্রমিকের শক্তি রাজনীতি। কোনও একটি সরকারকে নির্দিষ্ট করা যাবে না। সব সরকারের সময়েই এর সঙ্গে যুক্তরা সরকারকে বিব্রত করেছে। ফলে প্রাণ যতই ঝরে পড়ুক পথে, প্রতিবাদ হোক যত উচ্চকণ্ঠে, ফল– নিরাপদ সড়কের স্বপ্ন আকাশকুসুমই থেকে যাবে। ব্যক্তির নৈতিকতা না ফিরলে বেপরোয়া গতির তরুণরাও পথে বেসামাল রয়ে যাবে। বেঁচে থাকতে গোবেচারা যাত্রী আমরা জীবন হাতে নিয়ে চলবো। কারণ, তাদের সব সচ্ছলতার দায় যে আমাদেরই!
নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীরা, তাদের সহপাঠীকে হারানোর পর একটি দাবি তুলেছে– ‘সড়কে মানুষ তো দূরের কথা, একটি প্রাণী বা পাখির মৃতদেহ দেখতে চাই না। মানুষের মতো তাদেরও স্বজন আছে, অনুভূতি আছে’– এই দাবি হোক সবার।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
সান নিউজ/এফএইচপি