মোহাম্মদ এ. আরাফাত
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের বিপক্ষে কিছু কিছু রাজাকার শাবকের পাকিস্তান দলকে সমর্থন করার বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। আমি এ নিয়ে দুঃখিত হলেও মোটেও অবাক হইনি। কারণ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে তো এ দেশেরই কিছু মানুষ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। একাত্তরে এ দেশেরই কিছু মানুষ রাজাকার ছিল–এটি যেমন সত্যি, তেমনই পরবর্তী সময়েও রাজাকার শাবকের জন্ম হয়েছে এ দেশে, এটিও সত্যি।
যারা ১৯৭১ সালে রাজাকারি করেছিল, ৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেই রাজাকারদের এ দেশেই পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। রাজাকারদের পুনর্বাসনের মূল কাজটি করেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। পর্যায়ক্রমে এই রাজাকার গোষ্ঠী আবারও শিকড় গেড়ে শক্ত অবস্থান তৈরি করে বাংলাদেশে। রাজাকাররা তাদের পরবর্তী একটি প্রজন্ম তৈরি করে, যারা মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে জন্মের কারণে মুক্তিযুদ্ধে রাজাকারি করার সুযোগ না পেলেও একই পাকপন্থী-রাজাকারি আদর্শ মনেপ্রাণে ধারণ করে বেড়ে ওঠে এই স্বাধীন বাংলাদেশে। রাজাকার গোষ্ঠী বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের এই অংশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বিচ্যুত করে এবং ধর্মের অপব্যাখ্যার জালে বিভ্রান্তি সৃষ্টির মাধ্যমে গড়ে তোলে রাজাকার শাবক গোষ্ঠী। স্বাধীন বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে আনা ছিল তাদের মূল লক্ষ্য।
এদের সংখ্যা কিন্তু বেশি নয়। সব মিলিয়ে ১৭ কোটি মানুষের দেশে এই রাজাকার শাবকের সংখ্যা হবে ৫০ লাখ। কিন্তু এদের লম্ফঝম্ফ অনেক বেশি এবং এরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুবই সংঘবদ্ধ ও সক্রিয়। যে কারণে এদের সংখ্যা অনেক বেশি বলে মনে হয়। এরাই যুক্তির পরিবর্তে গালাগালি করে, হা-হা রিয়েক্ট দেয়। এরা একটি সুনির্দিষ্ট উগ্রবাদী রাজনৈতিক মতাদর্শ ধারণ করে এবং তাদের কাছাকাছি মতাদর্শের ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমর্থন দেয়। এরাই মামুনুল হকসহ সকল ভণ্ড মোল্লার সমর্থক, এরাই রাজাকার সাঈদীর সমর্থক, এরাই যুদ্ধপরাধের বিচারের বিরোধী, এরাই সাম্প্রদায়িক উসকানি দেয়, এরাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ‘চেতনা-ফেতনা’ বলে তাচ্ছিল্য করে, সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীদের ‘চেতনাবাজ’ বলে তকমা দেয় এবং এরাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে ভারতের দালাল বলে।
এরা ভারত বিরোধিতা করে দেশপ্রেম থেকে নয়, পাকিস্তান প্রেম থেকে। এর প্রমাণ হলো, বাংলাদেশের বিপক্ষেও এরা সমর্থন করে পাকিস্তানকে। এদের আদর্শিক পিতা ও পিতামহরাই বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিস্তানের পক্ষে রাজাকারি করেছিল ১৯৭১ সালে। এই গোষ্ঠীটাই রাজাকার শাবক গোষ্ঠী। এই রাজাকার শাবক গোষ্ঠীরই একাংশ স্টেডিয়ামে গিয়েছিল পাকিস্তানের পতাকা হাতে এবং এদেরই অন্য অংশটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রতি তাদের নির্লজ্জ দালালিকে বিভিন্ন কুযুক্তি ও কুতর্ক দিয়ে ডিফেন্ড করার অপচেষ্টা চালিয়েছে।
এই রাজাকার শাবক গোষ্ঠী মানসিকতায় বাংলাদেশি নয়, এরা মানসিকতায় পাকিস্তানি। বাংলাদেশের সঙ্গে যে পাকিস্তানের একটি আলাদা ইকুয়েশন আছে এটা তারা মানেই না। যে কারণে তারা বাংলাদেশ-পাকিস্তান ইকুয়েশনের মধ্যে সবসময় ভারতকে টেনে আনে। পাকিস্তানি আমলে, বাংলার মানুষের মুক্তির কথা বলা হলেই পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীও একইভাবে ভারতকে সেই ইকুয়েশনে টেনে আনতো, বাংলার জনগণের অধিকারের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য। এটা তাদের কৌশল ছিল। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকেও ভারতের ষড়যন্ত্র হিসেবে ব্যাখ্যা করতো।
এই রাজাকার শাবক গোষ্ঠী এখনও পাকিস্তানের চশমা পরে আছে। বাংলাদেশের একজন মানুষ পাকিস্তানবিরোধী হতে পারে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কারণেই, ভারতের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই; রাজাকার শাবকগুলো তা মানতেই পারে না। কারণ তাদের মস্তিষ্কে বাংলাদেশ নেই, আছে পাকিস্তান। একজন প্রকৃত বাংলাদেশি অবশ্যই ভারতবিরোধী হতে পারে, কিন্তু কখনও বাংলাদেশবিরোধী হতে পারে না, কখনও পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়াতে পারে না।
১৯৭১-এ পরাজিত পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী ‘আইয়ুব খান-ইয়াহিয়া খান’ ও তাদের দালাল রাজাকার-গোলাম আজমরা স্বাধীনতার সময় থেকেই এ দেশের মুক্তিকামী মানুষদের বিতর্কিত করার জন্য আওয়ামী লীগকে রুশ-ভারতের দালাল বলে আখ্যা দিতো। এরই ধারাবাহিকতায় এখনও এই পাকিস্তানি প্রেতাত্মা রাজাকার শাবক গোষ্ঠীর চোখে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ‘ভারতের দালাল’। কারণ পাকিস্তান ও তাদের এ দেশীয় দালালরা মনে করে ভারতের ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।
একটি বাস্তব উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি আরেকটু পরিষ্কার করি। বাংলাদেশ যেদিন পাকিস্তানের কাছে হেরে গেলো, তার পরের দিন একজন রাজাকার শাবক আমার ফেসবুকের ওয়ালে এসে মন্তব্য করেছে, ‘গতকাল কেমন লাগছিল বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় গুপ্তচরের এজেন্ট ভাই? গতকাল বাঁশটা কেমন দিয়েছিল পাকিস্তান?’
খেয়াল করে দেখুন, খেলা ছিল কিন্তু বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের মধ্যে। বাংলাদেশ হেরেছে এবং তার ব্যাখ্যা এই রাজাকার শাবকের কাছে হলো, সে মনে করে বাংলাদেশকে হারিয়ে ভারতীয় এজেন্টদের বাঁশ দিয়েছে পাকিস্তান। এবার বুঝলেন তো, ইকুয়েশনটা কী? বাংলাদেশের অস্তিত্বই নেই এদের মগজে। অর্থাৎ, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি তথা বাংলাদেশপন্থীরাই এদের কাছে ভারতীয় এজেন্ট। ঠিক যেমন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কাছে মুক্তিযোদ্ধারা ছিল ভারতের এজেন্ট, তেমনই। এদেরকেই আমি রাজাকার শাবক বলি।
এই রাজাকার শাবক গোষ্ঠীকে বছরের পর বছর ধরে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। সেই পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতেই একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম, ‘রাজাকার শাবক কারা? কীভাবে চিনবেন?’ এই নিবন্ধে ১৭টি পয়েন্ট উল্লেখ করে তাদের চরিত্র ব্যাখ্যা করেছিলাম। সেই ১৭টি পয়েন্টের মধ্যে একটি পয়েন্ট ছিল, ‘যে বা যারা বাংলাদেশের বিপক্ষে ক্রিকেট খেলায় পাকিস্তানকে সমর্থন করে, সে এবং তারা রাজাকার শাবক।’
অনেকেই অবাক হয়েছিলেন, আমি এটা কী বললাম? এরকম কেউ আছে নাকি? আমার পর্যবেক্ষণে আগেই জানতাম, এরকম বেশকিছু রাজাকার শাবক আছে বাংলাদেশে। তাই রাজাকার শাবকদের বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিস্তান দলকে সমর্থন করার বিষয়টি নিয়ে মোটেও অবাক হইনি। কারণ এই রাজাকার শাবক গোষ্ঠী তাদের অন্যান্য কর্মকাণ্ড ও বক্তব্যের মাধ্যমে তাদের আসল চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়, যা আমি বুঝতে পারি। এবার তারা একটু পরিষ্কারভাবে তাদের চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে ফেলেছে বলেই আমাদের অনেকে হয়তো একটু বেশিই অবাক হচ্ছি। বিশ্বাস করুন; আজ যদি মুক্তিযুদ্ধ হয়, এই রাজাকার শাবক গোষ্ঠীও মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতের দালাল বলে পাকিস্তানের পক্ষে এ দেশে গণহত্যা চালাবে, এ দেশের নারীদের তুলে দেবে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। এটাই বাস্তবতা।
সরকারের সব সমালোচকই কিন্তু রাজাকার বা রাজাকার শাবক নয়। কিন্তু সকল রাজাকার শাবকই আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচক ও নিন্দুক। এরাই সরকারবিরোধী গুজব ছড়ায়। আরেকটি বাস্তবতা হলো, জামায়াতের সমর্থক সবাই রাজাকার শাবক। বিএনপির সমর্থক সবাই রাজাকার শাবক না হলেও রাজাকার শাবকদের সবাই বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল।
লেখক: অধ্যাপক; চেয়ারম্যান, সুচিন্তা ফাউন্ডেশন
সান নিউজ/এফএইচপি