শিক্ষার্থী বলতেই বাসওয়ালাদের নিত্য যাত্রী আর অন্যভাবে বললে নিত্য কাস্টমার। কারণ শিক্ষার্থীরা প্রতিদিনই কিন্তু বাসে আসা-যাওয়া করে আর করতে হয়। বাসওয়ালাদের সাথে নিত্য দেখা হওয়া যাত্রীর নাম শিক্ষার্থী। আর সেই শিক্ষার্থীদের সাথেই চলছে যত তাল-বাহানা আর বেতাল কর্মকাণ্ড।
বাসওয়ালারা এখন শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তোলা কিংবা গাল দেয়া নিত্য অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। গতকালও মিরপুর থেকে অফিসের অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করে একটি বাসে করে বাড্ডায় আসার পথে সেই বাসের হেলপারকে দেখলাম এক ছাত্রকে হাফ ভাড়া দেয়ার অপরাধে গালি দিতে। এইতো দু‘ একদিন আগেইতো শনির আখড়া থেকে বাসে উঠে বদরুন্নেসার এক শিক্ষার্থী হাফ ভাড়া দিতে গেলে ধর্ষণ করা হবে এমন হুমকিও পেয়েছিলো। এছাড়া ঘাঁড় ধাক্কা দেয়া, গালি দেয়া, চড়-থাপ্পড় মারাসহ নানাবিধ অশ্রাব্য ব্যবহার করা আর শিক্ষার্থীদের হজম করা যেন এখন নিত্যভাস।
অথচ আজকের এই স্বাধীন বাংলায় স্বাধীনভাবে চলতে পারার স্বাধীনতা অর্জনে তর্জন ছিলো ছাত্র সমাজের। ছাত্রদের আন্দোলনের তোপেই অর্জিত হয়েছে আজকের বাংলাদেশ। স্বাধীনতার বৃক্ষে যদিও ফল ধরেছে ১৯৭১ সালে তবে, এই বৃক্ষ ১৯৫২ সালে রোপণ করেছে ছাত্র সমাজ, যা বড় হতে শুরু করেছ ৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ছাত্রদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ১৯৬২ এবং ১৯৬৪ সালের শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন যেন ছিলো বৃক্ষে পানি ঢালার ন্যায়। ১৯৬৬ সালের আন্দোলন ছিলো বৃক্ষকে পরম যত্নে বাতাসের প্রবলে ভেঙে যাওয়া থেকে ধরে রাখা। এরপর ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান যেন এক যুগান্তকারী বিপ্লব যার ফলে বৃক্ষ আমাদের ফল দিয়েছে ১৯৭০ এর নির্বাচনে, যে ফলে আমরা আমরা শক্তি পেয়েছিলাম ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে। আর এসবের মধ্য দিয়েই মূলত আমাদের অর্জিত হয়েছে স্বাধীন এই দেশ, যার মূলে ছিলো ছাত্র সমাজ।
এই দেশে এমন কোন আন্দোলন সংগ্রাম নেই যার সাথে ছাত্ররা জড়িত না। ছাত্রদের বুকের তাজা রক্তের উপর অর্জিত হয়েছে এই বাংলার প্রতিটি টুকরো মাটি। আজও যারা সেই নাক আর কান নিয়ে গন্ধ শুঁকবে আর আওয়াজ নিবে দেখবে ছাত্রদের রক্তরে গন্ধ আর স্বাধীনতার পক্ষে মুখরিত স্লোগান। আর সেই রক্তদান আর স্লোগানের মূল্যে অর্জিত হয়েছে এই বাংলা।
অথচ এই বাংলা যাদের রক্তে অর্জিত হয়েছে আজ তারাই শুনতে হচ্ছে নিত্য হুমকি। রাস্তায় বের হলে ভয়ে আতংকে থাকতে হয় সেই ছাত্র সমাজকে। এখন এই ভয় আতংকের অন্য নাম যুক্ত হয়েছে বাসের হেলপার-ড্রাইভারসহ সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা। গণপরিবহনগুলো যেন দিন দিন শিক্ষার্থীদের জন্য হয়ে উঠছে ভয়ংকর একটি নাম। বাসে তুলে দিয়ে চিন্তিত থাকা লাগে বাসায় থাকা অভিভাকদের। বাসে হচ্ছে নিত্য টিজ। বাসের ভিতর যতটা ইভটিজিং এর শিকার নারিরা হচ্ছে তার বেশির ভাগ হচ্ছে ড্রাইভার আর হেলপারদার দ্বারা। বাসের ভিতরে ড্রাইভার-হেলপার দ্বারা ধর্ষণের বিষয়টা আজ না হয় নাইবা লিখলাম।
যেকথা বলছিলাম, বাসে করে সপ্তাহে নূন্যতম ছয়দিনের যাতায়াত থাকে শিক্ষার্থীদের। সেই সুবাদে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ পাস থাকাটা একেবারেই যৌক্তিক। অথচ এই যৌক্তিকতাকে অযৌক্তিক করে তুলছেন বাসের চালক-হেলপার আর সংশ্লিষ্টরা। তারও একটা কারণ বেরিয়ে এসেছে বদরুন্নেসার সেই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণেল হুমকি দেয়া চালক এব হেলাপারকে আটকের মধ্য দিয়ে। তারা র্যাবকে জানিয়েছেন, মূলত তারা স্টুডেন্টদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নিচ্ছেন না বাড়তি লাভের জন্য। তারা বলেন, আমরা বাসের মালিকের কাছ থেকে দৈনিক তিনহাজার টাকা জমা দেয়ার চুক্তিতে মূলত গাড়ি নিয়েছি। আর তার বেশি যা আমরা আয় করি তা আমরা(চালক-হেলপার) ভাগ করে নিয়ে থাকি। আর এই জন্য আমরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নিতে চাই না। এই চিত্রের ব্যাখ্যা আপনি আজ শুনলেও এটা হয়ে আসছে বহু আগ থেকেই। অতিরিক্ত লাভের আশায় এই চালক এবং হেলপাররা শিক্ষার্থীদের চলন্ত বাস থেকে ঘাঁড় ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়ার নজিরও শিক্ষার্থীদের রক্তে অর্জিত বাংলায় আছে আর আজ অবধি হচ্ছে।
বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দল প্রায় সবগুলোরই আছে ছাত্র রাজনীতি। এবং সেই ছাত্ররাজনীতির দলের নামের শুরুতে যুক্ত “ছাত্র” শব্দ। যা বহন করে দেশের সম্মুখ সারির এক চেতনা। কারণ সেই ১৯৫২ থেকে আজ অবধি যেভাবেই হোক পক্ষ আর বিপক্ষ সব মিলিয়ে এই রাজনৈতিক ছাত্র আন্দোলন ছিলো নেতৃত্বে। তাদের ছায়ায় কিংবা সাধারণ ছাত্রের ডাকা আন্দোলনের যৌক্তিক দাবিতে সহমত পোষণ করা অথবা সেই আন্দোলন করা শিক্ষার্থীদের পরে রাজনীতির সাথে জড়িত হওয়া, সব মিলিয়ে ইতিহাসের সাথে ছাত্র আর ছাত্র রাজনীতি এক অনবদ্য সূত্র।
কিন্তু দু:খের বিষয় যেই ছাত্রদের বাহুবলে অর্জিত বাংলাদেশ। যাদের অবদানে ভাষা অর্জন থেকে শুরু করে আজ বয়সের শেষ প্রান্তেও স্বস্তির নি:শ্বাস ছাড়া। আজ তাদেরকেই দেয়া হচ্ছে গালি আর ধর্ষণের হুমকি!! অথচ লজ্জার বিষয় সব দলই ছাত্রদের উপর ভর করেই মূলত চালিয়েছে আর চালাচ্ছে তাদের রাজনীতির মসনদ।
বড় সবগুলো দলের ছাত্র রাজনীতি থাকলেও আজ অবধি হাফ ভাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে সেই দলগুলো কোন যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে তার প্রমাণ নেই। এইতো সেদিনও বিআরটিএ‘তে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কারণে যাত্রীদের ভাড়া বাড়ালেও আলোচনায় রাখা হয়নি শিক্ষার্থীদের বিষয়।আগেরটা বাদই দিলাম, সেদিনই যদি আলোচনায় রেখে সমাধান টানতো হয়তো আজ কয়েকদিনের ভোগান্তি আর এমন আচরণের শিকার হতেন না শিক্ষার্থীরা।
তবে দু:খজনক হলেও সত্য যে, সেই শুরুতেও শিক্ষার্থীদের এই হাফ পাশে করতে হয়েছে আন্দোলন, যা চলছে আজ অবধি। এর সুরাহা হওয়া এখন সময়ের একান্ত দাবি। আর এই সুরাহা হওয়া চাই আইনিভাবে, রাষ্ট্রীয় ঘোষণায়। দেশের যেখানেই শিক্ষার্থীরা যাবে আর তাদের কার্ড দেখাবে হাফ পাস নিতেই হবে এমন যুগান্তকারী আইন হোক এখনকার কাম্য।
১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ যে ১১ দফা দাবিতে আন্দোলন করেছিল। যার প্রথম দাবিতেই বলা হয়েছে, বাস, ট্রেন, লঞ্চ, স্টিমার ইত্যাদিতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নিতে হবে। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পর পাকিস্তানের তৎকালীন সরকার গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার বিষয়টি মেনে নেয়। স্বাধীনতার পরও এটি চালু থাকলেও কালের আবর্তে আর বাস মালিকদের ক্ষমতার প্রলয়ে এটি হারিয়ে যায়।
শুধু তাই না,নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালে আন্দোলনে নেমেছিল শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলনে টনক নড়েছিল সব দল-মতের। এখানেও শিক্ষার্থীদের অন্যতম দাবি ছিলো হাফ পাস।তবে এখানেও সড়ক আইন হলেও শিক্ষার্থীদের অন্যতম প্রধান দাবি ‘হাফ পাস’টি উপেক্ষিতই থেকে যায়।
এমনকি সম্প্রতি বাসভাড়া বাড়ানোর আগে অনেক গণপরিবহন ঢাকা শহরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নিত। কিন্তু ভাড়া বাড়ানোর পর গণপরিবহনগুলো সেই সুবিধা কেড়ে নেয়, যা সম্পূর্ণ অন্যায়। তারা যুক্তি দেখায় যে সরকারের সঙ্গে বাসভাড়া বাড়ানো নিয়ে যখন চুক্তি হয়, তখন শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়ার কথা বলা হয়নি। এই যুক্তিকে কুপেঘাত করে চিরজীবনের জন্য দেশের সব প্রান্তে সব শিক্ষার্থী হাফ ভাড়া দিবে এমন আইন হোক আর হওয়া চাই।
আমাদের দেশের বেশির শিক্ষার্থীরা মধ্যবিত্ত আর নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে উঠে আসা। আর পড়া-লেখা চালিয়ে যেতে হলে প্রতিনিয়ত উঠা লাগে যানবাহনে, গুনতে হয় টাকা। অন্যদিকে করোনার দীর্ঘ ছোঁয়ায় নি:স্ব অনেক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। সেই পরিবারগুলোর সন্তানদের পড়া-লেখা যেখানে অনিশ্চিত হয়ে আছে সেখানে “মরার উপর খাঁড়ার ঘা” বেড়েছ বাস ভাড়া। আবার আগে টুকটাক হাফ ভাড়া কয়েকটা বাস নিলেও এখন একেবারেই নেয়া বন্ধ করে দেয়াতে অনেক শিক্ষার্থী নিয়মিত ক্লাসে না আসতে পারাটাই স্বাভাবিক। অতএব এসব দিক বিবেচনা আর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশ আর দেশের স্বকীয়তা রক্ষায় ছাত্রদের আন্দোলন সংগ্রামের সম্মানে এখনই উচিত হাফ পাসের সুরাহা রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা দেয়া।
সুলতান মাহমুদ আরিফ
শিক্ষার্থী এবং গণমাধ্যমকর্মী
সাননিউজ/জেআই