মো. জাকির হোসেন
১৯১৯ সালে রবার্ট রিপলি (Robert Ripley) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি মার্কিন ফ্র্যানচাইজি রিপলি’স বিলিভ ইট অর নট। এটি উদ্ভট, অস্বাভাবিক, অবিশ্বাস্য, কৌতূহলোদ্দীপক সত্য ঘটনাবলি জনসমক্ষে তুলে ধরে। যেমন, ১৮৫৩ সালে জন কফি নামের এক ব্যক্তি আয়ারল্যান্ডের ডানডকে কারাগার নির্মাণ করেন। শেষমেশ তিনিই ওই কারাগারের প্রথম বন্দি হিসেবে ঢোকেন ঋণ পরিশোধ করতে না পারায়! যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউজে প্রথম টেলিফোন বসানো হয় ১৮৭৭ সালে এবং ফোন নম্বরটি ছিল এক সংখ্যার – ‘১’!
রিপলি’স বিলিভ ইট অর নট-এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বাংলাদেশি শিশু ওয়াসিক ফারহান রূপকথা। ৬ বছর বয়সী অসাধারণ মেধার অধিকারী এই রূপকথাকে বিশ্বের সবচেয়ে কম বয়সী কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে অভিহিত করে ‘বিস্ময়কর বালক’ স্বীকৃতি দিয়ে একটি বিশেষ ছবি প্রকাশ করেছে রিপলি’স বিলিভ ইট অর নট। আমাদের বিচার বিভাগ শত সীমাবদ্ধতার মাঝেও যেভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তাতে এটি রিপলি’স বিলিভ ইট অর নট-এ ঠাঁই করে নিলে অবাক হবো না। যুক্তরাষ্ট্রে ৩২ কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে যেখানে ৮৬ হাজার বিচারক রয়েছেন, সেখানে ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশে অনুমোদিত বিচারকের পদই আছে মাত্র এক হাজার ৬৫৫টি। এই পদের মধ্যে কয়েক’শ আবার শূন্য। কর্মরত বিচারকদের মধ্যে আবার শতাধিক বিচারক বিচারকাজের বাইরে প্রেষণে রয়েছেন।
সময়ের পরিক্রমায় রাষ্ট্র ও সমাজের চাহিদা অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করে নতুন নতুন বিষয়কে বিচারিক কার্যক্রমের আওতাভুক্ত করা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ জন্য পর্যাপ্ত আদালত তৈরি করা হয়নি। বিদ্যমান আদালতের ওপর তা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সাইবার ক্রাইম, মানবপাচার, পরিবেশ, ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের কার্যাবলির বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। এ ছাড়া সময়ে সময়ে একটি উপজেলা ভেঙে একাধিক উপজেলা ঘোষণা করে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, ওসি, এএসপি ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি করা হলেও এসব নবসৃষ্ট উপজেলার জন্য বিচারকের পদ সৃষ্টি করা হয়নি। ফলে এক উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারককে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে একাধিক উপজেলার বিচারকের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। ধর্ষণ-নির্যাতনের এক লাখ ৭০ হাজার মামলার বিপরীতে ১০১টি ট্রাইব্যুনাল আছে। তার মানে প্রতি বিচারককে এক হাজার ৬৮৪টি মামলার দ্রুত বিচার করতে হবে। এ মামলার বিচার চলাকালে যুক্ত হবে আরও নতুন মামলা।
অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালের বিচারককে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের অধীনে মামলার বিচার ছাড়াও শিশু আইনের অধীনেও বিচারিক দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। আর এ প্রক্রিয়ায় মামলাজট ফুলেফেঁপে উঠছে দিন, মাস, বছর গড়িয়ে। এ অবস্থায় বিচারকের সংখ্যা বাড়ানোর বিকল্প নেই। কিন্তু সমস্যা হলো অধিক সংখ্যক বিচারক নিয়োগ হলে এজলাস কোথায় পাওয়া যাবে?
বিচার বিভাগ তো ভয়ংকর ভৌত অবকাঠামো সমস্যায় জর্জরিত। দেড়শ’ বছরের পুরাতন বাঁশের বেড়া, কাঠের খুঁটি ও টিনের ছাউনিযুক্ত পটিয়া আদালত ঘর। আদালত ভবন বললে এর বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ প্রকাশ পায় না, এটি প্রায় কুঁড়েঘর। বহুকাল আগে থেকে জং ধরা টিনের চালা মাটির মতো ঝুরঝুরে হয়ে কোনও এক অজানা রহস্যে ভর করে এখনও বসে আছে, মেরামত করতে ওপরে ওঠা যায় না, পায়ের সামান্য চাপেই ফেটে ও ভেঙে যায়। বৃষ্টি এলে আদালতের কাজ বন্ধ করে জজ সাহেবদের দৌড়াতে দেখেছি বিচারের নথিপত্র ও জনগণের ধন-সম্পত্তির অতি মূল্যবান দলিলপত্র বাঁচানোর জন্য। যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজসহ সাতটি আদালত রয়েছে পটিয়ায়। কিন্তু বিচারকদের জন্য নেই কোনও বাসস্থান।
ব্রিটিশরা বিচারকদের জন্য তিনটি ‘মুন্সেফ কোয়ার্টার’ তৈরি করলেও সময়ের পরিক্রমায় বিচারকদের বাসস্থান ‘মুন্সেফ কোয়ার্টার’-এর কোনও চিহ্ন নেই। ঘন ঝোপঝাড়ে পোকামাকড় আর সাপের ঘর-বসতি ওইসব ‘মুন্সেফ কোয়ার্টার’। বিচারকগণ থাকেন ভাড়া বাসায়। বিচারক পেশার মানুষদের অপেক্ষাকৃত বেশি ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও পটিয়ার বিচারকগণ পায়ে হেঁটে বা রিকশায় আসেন আদালতে। অনেক জেলায়ই বর্তমান বিচারকদের একই এজলাস ভাগাভাগি করে বিচারকাজ চালাতে হচ্ছে। দিনের এক অংশে একজন বিচারক এজলাসে বসছেন আর দিনের অপর অংশে আরেকজন বিচারক সেই এজলাসে বসে বিচারিক কাজ করছেন। ফলে বিচারক তাঁর দায়িত্বের পুরোটা পালন করতে পারছেন না কেবল এজলাসের অভাবে। এভাবে বিচারকের অব্যবহৃত সময় ও সম্ভাবনা মামলাজটে ভূমিকা রাখছে।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০ হাজার নাগরিকের বিপরীতে একজন ও ভারতে ৬৭ হাজার নাগরিকের বিপরীতে একজন করে বিচারক কর্মরত। আর বাংলাদেশে প্রায় দেড় লাখ নাগরিকের বিপরীতে কর্মরত বিচারকের সংখ্যা মাত্র একজন। এক গবেষণায় প্রকাশ, যে হারে মামলা নিষ্পত্তি ও নতুন মামলা দায়ের হচ্ছে এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে আগামী কয়েক’শ বছরেও মামলাজট নিরসন সম্ভব নয়। বিচারব্যবস্থার পদ্ধতিগত ভয়ানক ত্রুটির সংস্কার না করে বিচারকের সংখ্যা বাড়ালেই মামলাজট নিরসন ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতা থেকে রেহাই মিলবে জোর দিয়ে বলার উপায় নেই।
উদাহরণস্বরূপ, একটি দেওয়ানি মামলা দায়েরের পর বিবাদীর ওপর সমন জারি ও বিবাদীর লিখিত জবাব দাখিল হতে বছরের পর বছর চলে যায়। এখানে সমন জারির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কারসাজি বন্ধে ও বিবাদীর জবাব দাখিলের ক্ষেত্রে আইনের সংস্কার করা না হলে বিচারকের সংখ্যা বাড়িয়ে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
সব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অধিকাংশ বিচারক তাঁদের সবটুকু মেধা, শ্রম, নিষ্ঠা ও সততা দিয়ে চেষ্টা করছেন দায়িত্ব পালন করতে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে। তবে কিছু বিচারকের দায়িত্বহীনতা ও কর্মকাণ্ড দেখলে আপনি নিশ্চিতভাবেই বিস্মিত হবেন, ক্ষুব্ধ হবেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু বিচারক ডিজিটাল সুরক্ষা আইন লঙ্ঘন করে অপরের সম্মানহানি করছে, ভয়ংকর মিথ্যাচার করছে। আবার কারও বিচারের রায় আইন ও সংবিধানের সীমাকে লঙ্ঘন করছে।
সম্প্রতি বহুল আলোচিত রেইন্ট্রি হোটেল ধর্ষণ মামলার রায়ে পাঁচ আসামিকেই খালাস দিয়েছেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোছাম্মাত কামরুন্নাহার। রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেছেন, (পত্রপত্রিকার বিবরণ অনুযায়ী), ‘মামলার দুই ভিকটিম বিশ্বাসযোগ্য নয়। ভিকটিম দুজনই আগে থেকেই সেক্সুয়াল কাজে অভ্যস্ত, হাসপাতাল রিপোর্ট তাই বলে। অহেতুক তদন্ত কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছেন। এতে আদালতের ৯৪ কার্যদিবস নষ্ট হয়েছে। এরপর থেকে পুলিশকে এ বিষয় সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছি। এছাড়া এখন থেকে ধর্ষণের ৭২ ঘণ্টা পর যদি কেউ মামলা করতে যায়, তা না নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুই ভিকটিম স্বেচ্ছায় রেইনট্রি হোটেলে যান। সেখানে উভয়ের সম্মতিতে তারা সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেন। তাদের ভয়ভীতি বা মারধর করে ধর্ষণ করা হয়নি। ঘটনার ৩৮ দিন পর আসামি সাফাত আহমেদের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার প্ররোচনায় মামলা করা হয়। ধর্ষণের উপাদান না পাওয়ার পরও পুলিশ মামলাটি তদন্ত করে অহেতুক ট্রায়ালে পাঠায়।’
বিচারকের পর্যবেক্ষণ বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে –
এক. নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোছাম্মাত কামরুন্নাহার জেলা ও দায়রা জজের পদমর্যাদাসম্পন্ন। এই অবস্থায় আসতে তিনি কম-বেশি ২০ বছর বিচারিক কাজ করেছেন। তিনি কি জানেন না নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করার কোনও সময় বেঁধে দেওয়া নেই? আর সংবিধান ভিকটিমকে বিচার চাওয়ার অধিকার দিয়েছে?
দুই. বিচারক বলেছেন, মেডিক্যাল রিপোর্ট ও ডিএনএ টেস্টে ধর্ষণের প্রমাণ মেলেনি। তিনি এর আগেও ধর্ষণ মামলার বিচার করেছেন। সহকর্মীদের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়েছেন। শুধু মেডিক্যাল রিপোর্টই ধর্ষণ মামলার বিচারের একমাত্র সাক্ষ্য প্রমাণ নয়।
২০১০ সালে Utpal Das and another vs. State of West Bengal মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেন, ‘ধর্ষিতার মেডিক্যাল পরীক্ষায় তার গোপনাঙ্গে কিংবা শরীরে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি - আসামিপক্ষের আইনজীবীর এ যুক্তির কারণে ধর্ষিতার মামলাকে অবিশ্বাস করার কারণ নেই।’
অপরাধ শনাক্ত করতে ফোনকল, এসএমএস, সিসিটিভি ও ভিডিও ফুটেজ, গতিবিধি নজর রাখা ও পারিপার্শ্বিক তথ্য-প্রমাণসহ অনেক পদ্ধতি রয়েছে, যার দ্বারা অপরাধ প্রমাণ করা যায়। আমাদের উচ্চ আদালত ও ভারতের উচ্চ আদালতের স্পষ্ট নির্দেশনা আছে, শুধু ভিকটিমের সাক্ষ্যের ভিত্তিতেও বিচার করা যাবে। পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য এবং আলামতের ভিত্তিতেও বিচার করা যাবে। ২০১৫ সালে মুম্বাই হাইকোর্ট এক মামলায় শুধু ধর্ষিতা স্কুলছাত্রীর বক্তব্যের ভিত্তিতে আসামিকে সাজা দিয়ে বলেন, ‘If the statement of a rape victim is trustworthy and reliable, further corroboration is not needed.’
ধর্ষিতার বক্তব্য যাচাই করার জন্য যদি সাক্ষ্যের প্রয়োজন হয়, তবে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যকে (Evidence of Circumstance) বিবেচনায় নেওয়া উচিত। ২০১২ সালে কাটোয়া-আমোদপুর লাইনের ট্রেন থেকে একজন নারীকে নামিয়ে নিয়ে ধর্ষণের মামলায় বলা হয়েছে, একজন মহিলাকে যখন একাধিক পুরুষ জবরদস্তি ট্রেন থেকে নামিয়ে নিয়ে যায় তখন তাদের উদ্দেশ্যকেই তদন্তে ও বিচারে ‘পাখির চোখ’ করা উচিত। স্কুলছাত্রীকে তার যাওয়া-আসার পথে মিথ্যা বলে ধর্ষকের নিজের বাড়ি বা কোথাও নিয়ে যাওয়াকেই পারিপার্শ্বিক প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
তিন. রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, ‘মামলার দুই ভিকটিম বিশ্বাসযোগ্য নয়। ভিকটিম দুজনই আগে থেকেই সেক্সুয়াল কাজে অভ্যস্ত, হাসপাতাল রিপোর্ট তাই বলে। একজন সেক্সুয়াল কাজে অভ্যস্ত হলেই তিনি মিথ্যুক এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে? আর সেক্সুয়াল কাজে অভ্যস্ত এটি ডাক্তারি রিপোর্টের ভিত্তিতে চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়?
আমাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষায় কত ভুল রিপোর্ট আসে। পত্রিকায় দেখেছি পুরুষের মূত্র পরীক্ষায় প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ এসেছে। একই ব্যক্তির রক্তের গ্রুপ তিন ল্যাবে তিন রকম এসেছে। ক্যানসার, হৃদরোগ নির্ণয় হওয়ার পর বিদেশে গিয়ে দেখা গিয়েছে এসব কিছুই হয়নি রোগীর। আসামিরা নিজেরাই স্বীকার করেছেন তারা সেক্সুয়াল কাজে অভ্যস্ত। আসামি নাঈম আশরাফ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। সেই সূত্রে তাঁর সঙ্গে বেশ কিছু মডেলের পরিচয় ছিল। তারা সুযোগ পেলে ইচ্ছেমতো এই নারীদের ব্যবহার করতেন। জন্মদিনের অনুষ্ঠানেও বিকেল থেকে দু’জন মডেল ছিলেন। পরে তাদের অনুরোধে আরও একজন বাড্ডা থেকে যোগ দেন। আসামিদের সেক্সুয়াল কাজে অভ্যস্ততার বিষয়ে কোনও পর্যবেক্ষণ নেই কেন?
চার. দুই ভিকটিম স্বেচ্ছায় রেইনট্রি হোটেলে যান। সেখানে উভয়ের সম্মতিতে তারা সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেন। একজন মানুষ মুক্তভাবে এবং উৎসাহের সঙ্গে সম্মতি দিয়েছেন কিনা সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
যদি মুক্তভাবে এবং উৎসাহের সঙ্গে সম্মতি দিয়ে থাকেন তাহলে তারা কেন মামলা করলেন সেই ব্যাখ্যা কী?
পাঁচ. আসামিরা ধর্ষণের স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। কিন্তু আদালত প্রশ্ন তুলেছেন এটি ধর্ষণ কিনা? আমাদের হাইকোর্ট স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, ‘কেউ যদি আদালতে দেওয়া জবানবন্দি পরে প্রত্যাহার করার আবেদনও করেন, তাতে জবানবন্দি অগ্রহণযোগ্য হয় না।’ পাঁচ জন আসামির চার জনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেও তাদের মারপিট করে জবানবন্দি নেওয়ার কথা বলেছেন বিচারক। বিচারক কী করে নিশ্চিত হলেন মারপিট করে জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে?
আসামিরা যে পরিমাণ প্রভাবশালী তাতে তাদের মারপিট করা হবে এটি কি বিশ্বাসযোগ্য?
ছয়. আদালত বলেছেন, ‘ধর্ষণের শিকার হলে ভিকটিমদের কাজ ছিল থানায় যাওয়া। তারা তা না করে আগেই তাদের বন্ধু শাহরিয়ার আহমেদ এবং স্নেহার সঙ্গে দেখা করেন।’ থানায় না গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার কারণে মামলা বিশ্বাসযোগ্যতা হারায় কি?
সাত. তদন্ত কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছেন। এতে আদালতের ৯৪ কার্যদিবস নষ্ট হয়েছে। এজন্য তদন্ত কর্মকর্তাকে ভর্ৎসনাও করেন বিচারক৷ একটি গবেষণায় প্রকাশ, সারাদেশে বিচারের জন্য ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের দেড় লক্ষাধিক মামলা ঝুলে আছে। এসব মামলার বিচার চলছে ঢিমেতালে৷ বছরে নিষ্পত্তি হচ্ছে মাত্র ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ মামলা। আর সাজা পাচ্ছে হাজারে মাত্র সাড়ে ৪ জন। সাজার হার ০.৪৫ শতাংশ। আরেক গবেষণায় দেখা যায়, সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে মাত্র ৩ শতাংশ অপরাধী শাস্তি পেয়েছে।
আমি যে প্রশ্নগুলো উত্থাপন করেছি তার উত্তর আমার চেয়ে ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোছাম্মাত কামরুন্নাহার ভালো করে জানেন। তাহলে কেন তিন এমন পর্যবেক্ষণ দিলেন?
করোনার এই দুঃসময়ে তাঁর কি শারীরিক বা মানসিক কোনও সীমাবদ্ধতা ছিল, নাকি অন্য কোনও বিষয় ছিল এর পেছনে? অথবা বিচার বিষয়ে তাঁর কি কোনও বিশেষ দর্শন ছিল? যেমন, তিন বন্ধু বনে গিয়ে দেখলেন একটি বাঘ শিকার ধরার জন্য একটি হরিণকে তাড়া করেছে। হরিণটি কোনোমতে বেঁচে গেলেও বাঘের থাবায় মারাত্মকভাবে জখম হলো। বাঘও শিকার হারিয়ে ব্যর্থ মনোরথে গুহায় ফিরে এলো। একই ঘটনায় তিন বন্ধুর মূল্যায়ন ভিন্ন – একজন বললেন, ‘জঙ্গলে চরম খাদ্য সংকট! বিপন্ন বাঘ।’ দ্বিতীয়জন বললো, ‘জঙ্গলে বাঘের উপদ্রব! বিপন্ন হরিণ।’
তৃতীয়জনের মূল্যায়নে ঘটনাটি হলো, ‘বাঘে-হরিণে তুমুল লড়াই!’ একজন অতি অভিজ্ঞ বিচারক কেন এমন নজির সৃষ্টি করলেন যাতে সমাজ বিক্ষুব্ধ হলো সেই রহস্য উন্মোচিত হোক, একজন আইনের ছাত্র হিসেবে এটি আমার একান্ত প্রত্যাশা। বিচারিক ক্ষমতা প্রত্যাহার কিংবা কর্মস্থল পরিবর্তন সমস্যার সমাধান নয়।
লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সান নিউজ/এফএইচপি