জোবাইদা নাসরীন
বাংলাদেশের অনেক মানুষই একটি রায় মেনে নিতে পারছেন না। আর সেটি হলো– আলোচিত বনানীতে অবস্থিত রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার রায়ে পাঁচ আসামিকেই খালাস দিয়েছেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক। তবে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী এই বিচারকের বিরুদ্ধে নিজের উদ্যোগেই ব্যবস্থা নিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। বিষয়টি নিয়ে কিছুটা তৎপরতা লক্ষ করা গেছে আইনমন্ত্রীর মধ্যেও। তিনি নিজেও সুপ্রিম কোর্টে চিঠি পাঠিয়েছেন বলেও জানা গেছে। তবে তার আগেই রবিবার (১৪ নভেম্বর) সকালেই সেই বিচারক কামরুন্নাহারের বিচারিক ক্ষমতা প্রত্যাহার করা হয়েছে। তিনি আদালতে এসেছেন কিন্তু এজলাসে বসতে পারেননি।
গত ১১ নভেম্বর এই আলোচিত মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। এই বিচারক শুধু রায় দিয়েই ক্ষান্ত হননি, তিনি ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্র তার কিছু পর্যবেক্ষণও উপস্থাপন করেছেন। সেই রায় সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষণে তিনি বলেন, ‘৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না। পুলিশ যেন ৭২ ঘণ্টা পর কোনও ধর্ষণের মামলা না নেয়।’ এই রায়ের বিষয়ে তার আরও কয়েকটি যুক্তি এবং বক্তব্য আলোচনায় আসে, তার মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো, ‘ভিকটিম যৌনকর্মে অভ্যস্ত। মেডিক্যাল রিপোর্ট ও ডিএনএ টেস্টে ধর্ষণের প্রমাণ মেলেনি।’ এই রায় এবং বিচারকের পক্ষপাতমূলক পর্যবেক্ষণের প্রতিবাদে গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতেই নারীরা শাহবাগ থেকে সংসদ ভবন পর্যন্ত ‘শেকল ভাঙার পদযাত্রা’ করে এই মামলার রায়, বিচারকের পর্যবেক্ষণের প্রতিবাদ এবং তারা সাক্ষ্য আইনের ‘ধর্ষণবান্ধব’ ধারা বাতিলের দাবি তোলেন। বহুল আলোচিত এই মামলার রায় এবং এর সঙ্গে যুক্ত বিচারকের বিভিন্ন বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ব্যাপক সমালোচিত হয় এবং মানুষকে অনেকটাই ক্ষুব্ধ করেছে।
মামলাটির রায় হতে সময় লেগেছে সাড়ে চার বছরেরও বেশি। ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ একটি জন্মদিনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়ে অস্ত্রের মুখে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ৬ মে বনানী থানায় পাঁচ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল। পরে আসামিদের মধ্যে চার জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। তবে মামলার রায় প্রদানের দিন বিচারক জানান, আসামিদের মারপিট করে জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে এবং এই মামলার তদন্তেও ত্রুটি রয়েছে। যার কারণে ভর্ৎসনার শিকার হোন খোদ তদন্ত কর্মকর্তাও।
এই রায়েও অন্য সব ধর্ষণের মতো মেডিক্যাল পরীক্ষায় জোর দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে মেডিক্যাল পরীক্ষার সময় চিকিৎসকরা ধরেই নেন যে ধর্ষণ হবে রাতে। আর তা হবে অস্ত্রের মুখে, অপরিচিত মানুষ দ্বারা এবং সমাজের ‘কুমারী’ নারীর সঙ্গে।
ফলে যেকোনও কারণেই কোনও নারীর হাইমেন আগে ছিঁড়লে, মেডিক্যাল সাক্ষ্য-প্রমাণ হিসেবে ‘হাইমেন ওল্ড রেপচার’, ‘হেবিচুয়েট টু সেক্স’ এই বিশেষণগুলো ব্যবহার করা হয়। আর কোর্টে মেডিক্যাল পরীক্ষার এই ওল্ড রেপচার, হেবিচুয়েট টু সেক্স বিশেষণগুলো নারীর ধর্ষণ পূর্ব যৌন অভিজ্ঞতার ইতিহাসের বয়ান হাজির করা হয় ধর্ষণের মামলার সাক্ষ্য হিসেবে। আর যার মেডিক্যাল সনদে এই বিষয়গুলো লেখা থাকে তখন বিচারক এই সিদ্ধান্তে উপনীত হোন যে নারীটি আগেও যৌনকাজে লিপ্ত হয়েছে। অর্থাৎ মনোযোগ অন্য দিকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আর যদি কারও যৌন সম্পর্কের অভিজ্ঞতা আগে থেকেই থাকে তাহলে কি ধর্ষণ বৈধ?
তার মানেই কি এই রাষ্ট্রে বিবাহিত নারীকে ধর্ষণের বৈধতা মিললো? আর যৌনকর্মীদের ক্ষেত্রে তো তাহলে ধর্ষণ শব্দটিই ব্যবহার করা যাবে না। ‘ম্যারিটাল রেপ’ বলে আর কোনও কিছুর অস্তিত্ব থাকবে না। তাহলে ধরেই নেওয়া হচ্ছে যে পুরুষতান্ত্রিক এই আইনি অলিগলি নারীর ধর্ষণকেন্দ্রিক অসম্মতিকে একেবারেই আমলে নেওয়ার বিপরীতে কাজ করে। যার কারণে নারী বিবাহিত হলে ধর্ষণ প্রমাণ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে হাইমেন পরীক্ষা সাপেক্ষে ধর্ষণ প্রমাণ করা সম্ভবই হবে না। আর এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, ধর্ষণের সঙ্গে ‘হেবিচুয়েট টু সেক্স’ কিংবা নারীর যৌন অভিজ্ঞতার ইতিহাসের কী সম্পর্ক থাকতে পারে?
এখানে মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, ২০১৮ সালের ১২ এপ্রিল ধর্ষণের শিকার নারীর ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ পদ্ধতি নিষিদ্ধ করেছে হাইকোর্ট। এর পাশাপাশি আরও কয়েকটি বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছিল। তার মধ্যে অন্যতম ছিল ‘ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ যে সনদ দেবেন তাতে অভ্যাসগত যৌনতা বলে কোনও মন্তব্য করা যাবে না। পরীক্ষার পর ধর্ষণের শিকার নারীর যাবতীয় গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে। এছাড়া বিচারাধীন মামলায় নিম্ন আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণকালে নারীকে অমর্যাদাকর কোনও প্রশ্ন করা যাবে না।’
তাই রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে হাইকোর্টের নির্দেশনা ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। এবং তা করেছেন স্বয়ং একজন বিচারপতিই। এখানে মতাদর্শিক বোধটি হলো, কেন ধর্ষণ মামলার মেডিক্যাল সনদের সামগ্রিক পদ্ধতিগুলো ধর্ষণের শিকার নারীর প্রতি যৌন আক্রমণ, হয়রানি এবং নারীর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ইতিহাস নয়, বরং নারীর অতীত যৌন অভিজ্ঞতার ইতিহাস দেখতে আগ্রহী? কারণ, এই যৌন অভিজ্ঞতার ইতিহাসের মধ্য দিয়ে নারী ‘খারাপ’ এবং ‘খারাপ’ নারীকে ধর্ষণ করা বৈধ এই তরিকা প্রমাণ করাও সহজ হয়ে যায়। তাই ধর্ষণ পরীক্ষার ক্ষেত্রে যেখানে মেডিক্যাল টেস্টের নামে পুরুষালি গলিতে নারীর এতদিনকার অস্বস্তিকর এবং পুনরায় নিপীড়নভিত্তিক বাধ্যতামূলক অবস্থান থেকে মুক্তি পেতে আদালতের এই নির্দেশনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা। সেখানে তা না হয়ে উল্টোভাবে কাজ করছেন আদালত এবং আইন ব্যবস্থা। কেন এমন হচ্ছে সেটির কারণ জানাও অত্যন্ত জরুরি বিষয়।
আর ৭২ ঘণ্টার পর ধর্ষণ মামলা না নেওয়ার আর্জিও অত্যন্ত হাস্যকর। পৃথিবীতে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পরবর্তী যুদ্ধসমূহ এমনকি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নারী নিপীড়ন এবং ধর্ষণের বিচার চাচ্ছে, সেই সময়ে এসে বিচারকের এই ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম কতটা বেমানান এবং অগ্রহণযোগ্য তা বোধকরি বেশিরভাগ মানুষের কাছেই স্পষ্ট।
তাই অনাকাঙ্ক্ষিত বক্তব্য থেকে বিরত থেকে হাইকোর্টের নির্দেশনা মেনে দ্রুততম সময়ে ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা খুবই জরুরি।
লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সান নিউজ/এফএইচপি