আনিস আলমগীর
উপমহাদেশে ক্রিকেটের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা লুকিয়ে আছে অনেক দিন ধরে। এটা মূলত ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট। বাংলাদেশ যখন ক্রিকেট বিশ্বে নগণ্য ছিল বাংলাদেশিরাও এতে অংশীদার হয়েছে। এখন নিজেরা ক্রিকেটে গণ্যমান্য হওয়ার পর আগের মতো বিদেশি টিমের সমর্থক না থাকলেও, ভারত-পাকিস্তান প্রশ্নে সাম্প্রদায়িক মনোভাবটা দূর করতে পেরেছে বলা যায় না। ক্রিকেটপ্রেমীদের একদলের লিটন দাস, সৌম্য সরকারকে ধর্মীয় দিক থেকে গালাগালি, অন্য দলের ভারতের হারে গণহারে মনোকষ্ট পাওয়া তারই প্রমাণ বহন করে।
অবশ্য ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশিদের মধ্যেও সুক্ষ্মভাবে সাম্প্রদায়িকতা লুকিয়ে আছে এটা কেউ স্বীকার করতে চায় না। সাধুজনরা এটিকে প্রগতি আর ধর্মান্ধতা বলে চালিয়েছিলেন অনেক দিন। কিন্তু ভারতে যখন ধর্মান্ধরা শাসন করছে তখন ভারতকে সমর্থন দেওয়া প্রগতিশীলতা বলে আর চালানো যাচ্ছে না। অনেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সঙ্গেও এই সমর্থনকে সমার্থক করতে চেয়েছেন। ভারতকে সমর্থন করার যুক্তি দেয় ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল, আর পাকিস্তানকে সমর্থন করা যায় না কারণ তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রু ছিল। কিন্তু এত সহজভাবে এ তত্ত্ব হজম করানো যাচ্ছে না এখন।
ধর্মীয় পরিচয় বিবেচনা করলে ভারতকে সমর্থনের দিকে বাংলাদেশের দুই প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকই আছে। একদল একেবারেই ধর্মীয় নৈকট্যের কারণে ভারতকে সমর্থন করে। অংকের হিসাবে বলা যায়, ভারত-পাকিস্তান দুই দলের মধ্যে বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থক হিন্দুদের প্রায় পুরো অংশ ভারতের সমর্থক। তাদের কেউ কেউ হয়তো পাকিস্তানকেও সমর্থন করে তবে আমার সঙ্গে এমন কারও দেখা হয়নি।
সে তুলনায় মুসলমানরা বিভক্ত হয়ে দুই দেশকেই সমর্থন করে। তবে আমার ধারণা ভারতের প্রতি সমর্থনটা ঠিক আগের মতো নেই। পাকিস্তানের দিকে পাল্লাটা দিন দিন ভারী হচ্ছে। উগ্রভাবে হচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশকে হেয় করে ‘মওকা মওকা’ বিজ্ঞাপন বানানো, ২০১৬ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কলকাতার ইডেনে ৭০-৮০ হাজার ভারতীয় দর্শকের বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ পাকিস্তানকে গলা ফাটিয়ে সমর্থন করা, বাংলাদেশের সঙ্গে জয়ী হলেই নানা সময়ে বিদ্রুপ করাটা এর অন্যতম কারণ। এই বিদ্রুপের শুরু ২০০৭ সালে ভারত বাংলাদেশের কাছে হেরে বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে ব্যর্থ হওয়া থেকে।
তবে বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেট সমর্থকদের মধ্যে বিরোধ চূড়ান্তরূপ ধারণ করে ২০১৫ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে বাংলাদেশ-ভারত কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ ঘিরে। সে ম্যাচে ভারতের পক্ষে আম্পায়ারের দেওয়া কয়েকটি রায় প্রচণ্ডভাবে বাংলাদেশিদের ক্ষিপ্ত করে তোলে। বাংলাদেশি সমর্থকদের ধারণা এটি ইন্ডিয়া করিয়েছে। কারণ আইসিসি কন্ট্রোল করে ভারত এবং সেই পাকিস্তানি আম্পায়াার ভারতের আশীর্বাদপুষ্ট। আইপিএলের খেলায় আমন্ত্রণ পায় সে। আইসিসির প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের আ হ ম মুস্তফা কামাল আম্পায়ারের পক্ষপাতিত্বের প্রতিবাদ করেছিলেন এবং পরে তার হাত দিয়ে চ্যাম্পিয়ন দলকে ট্রফি না দিতে দেওয়ায় পদত্যাগও করেছিলেন।
বিরাট কোহলি একবার জয়ের পর বিশ্রি করে জিহ্বা প্রদর্শন করেছিল। সেই ক্ষোভও বাংলাদেশিরা ভুলতে পারছে না। সেই কারণে ক্রিকেটে ভারত পরাজিত হলেই বাংলাদেশিরা আনন্দ পায়, বিরাট কোহলিকে নিয়ে ট্রল করে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
ইদানীং দেখা যাচ্ছে, আমাদের একটা শ্রেণি যেন পণ করেছে পাকিস্তান যতই ভালো খেলুক তাকে সমর্থন করা যাবে না, করলে তারা রাজাকার। গত ২৪ অক্টোবর ২০২১ রাতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের খেলায় বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে যাওয়ার পর ভারত-পাকিস্তানের খেলায় ভারত হারলে অনেক ক্রিকেটপ্রেমী খুশি হয়েছেন। শুধু বাংলাদেশে নয়, বাইরেও এটা দেখা গেছে। এর প্রধান কারণ বিশ্বকাপে ভারতের কাছে বরাবর পাকিস্তান হেরে আসছে। ১৩তম মোকাবিলায় গিয়ে শুধু তারা জিতেছে তা নয়, পাকিস্তানের একটি উইকেটও ফেলতে পারেনি ভারত। মানে ১০ ইউকেটে পাকিস্তানের জয়লাভ। এটি ছিল সবার কাছে অভাবনীয়।
কিন্তু ক্রিকেটকে যারা সাম্প্রদায়িকতার দিক থেকে দেখে তারা এই জয়কে দুইভাবে নিয়েছে। আমাদের কিছু মুসলমান এটাকে মুসলমানের বিজয়, হিন্দুরাষ্ট্র ভারতের পরাজয় হিসেবে দেখেছে এবং পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্ট্যাটাস দিয়েছে। অন্যদিকে কিছু হিন্দু পাকিস্তানের কাছে ভারতের গোহারায় যেসব বাংলাদেশি খুশি হয়েছে তাদের পাকিস্তানি বলে ব্যঙ্গ করেছে। তারা যদি পাকিস্তানি মনা হয় বা পাকিস্তানি হয়; ভারতের হারে যারা দুঃখ পেল তারা তবে কী? ভারতীয় দালাল?
আমি বুঝি না যারা চুপা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে লুকিয়ে খেলার সঙ্গে ১৯৭১ সালকে টেনে আনে, ধর্ম-জন্ম পরিচয় টানে, তারা পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি তোলে না কেন! পাকিস্তান একটি স্বাধীন দেশ। ভারতও একটি স্বাধীন দেশ। প্রতিবেশী হিসেবে আমাদের তো কাউকে ঘৃণা প্রকাশ করার দরকার নেই। আমরা নিজেকে স্বাধীন দেশের নাগরিক মনে করলে প্রতিবেশির প্রতি ঘৃণার সংস্কৃতি লালন করি কীভাবে? যে নিজের দেশকে ভালোবাসে না সে তো অসুস্থ মানুষ। অসুস্থ মানুষই শুধু তার প্রতিবেশীদের ঘৃণা করে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিও- সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়।
বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো ভারতকে হারানোর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানি উন্মাদ সমর্থকরা নিজ দেশে এলোপাতাড়ি গুলি করে ১২ জনকে গুলিবিদ্ধ করেছে। ভারতের সমর্থকরা নিজ দেশে ভাঙচুর করেছে আর নিরীহ কাশ্মিরি মুসলমান শিক্ষার্থীদের বিভিন্নস্থানে ধরে ধরে পিটিয়েছে। বিশেষ করে পাঞ্জাবে এক মেডিকেল ছাত্রকে হোস্টেলে পেটানো, তার রুম ভাঙচুরের দৃশ্য বড় খবর হয়েছে। আর কাশ্মিরের একটি ছাত্রী হোস্টেলের ছাত্রীদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা করা হয়েছে কারণ তারা নাকি পাকিস্তান দলকে সমর্থন করেছে। খেলায় নিজ দেশের বাইরে কোনো দেশকে সমর্থন করা যাবে না এমন আইন আছে কিনা আমার জানা নেই। ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের খেলায় ওই দুই দেশকে সমর্থন করেছে এমন বাংলাদেশিও আমি দেখেছি।
বিশ্বকাপের মঞ্চে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের কাছে হারায় ভারতজুড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোহলিবাহিনীর মুণ্ডুপাতও চলছে। সমর্থকদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন ভারতের বহু ম্যাচ জেতানো পেসার মোহাম্মদ শামি। তাকে নিয়ে চলছে ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপ। এমনকি ভারতীয় এই ডানহাতি পেসারকে একশ্রেণির উগ্র হিন্দুত্ববাদী সমর্থক 'পাকিস্তানি' এবং 'দেশদ্রোহী' আখ্যা দিতেও ছাড়েনি।
ভারতীয় বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে খরুচে ছিলেন মোহাম্মদ শামি। ৩.৫ ওভারে ৪৩ রান দিয়েছেন। সে অজুহাতে শামির ওপর ক্ষিপ্ত ভারতের উগ্র সমর্থকরা। শামির ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে গিয়ে একজন লিখেছেন 'পাকিস্তানের দ্বাদশ খেলোয়াড়'। আরেকজন লিখেছেন, 'বিশ্বাসঘাতক, নিজের ক্ষমতা দেখিয়ে দিলে। 'আরেক সমর্থক লেখেন 'ভারতীয় দলের পাকিস্তানি ক্রিকেটার।' প্রকাশের অযোগ্য ভাষায়ই আক্রমণ হয়েছে বেশি। অনেকেই শামির ধর্মীয় দিকেও ইঙ্গিত করে খোঁচা মেরেছেন। এক সমর্থক যেমন বলেছেন, 'পাকিস্তানে চলে যাও। সেখানে গেলে তুমিও শান্তি পাবে, আমরাও পাবো।’
ওই মাত্রায় না হলেও একই ঘটনা বাংলাদেশেও ঘটছে। লিটন দাস শ্রীলঙ্কার সঙ্গে হারের দিন দুটি ক্যাচ মিস করেছে। তার কারণে মূলত সেদিন বাংলাদেশ হেরেছে বলে অনেকে মনে করছেন। অনেকদিন থেকে লিটন ভালো ফর্মে নেই। অথচ সে ওপেনিং ব্যাটসম্যান। দেশি-বিদেশি ক্রিকেট বোদ্ধারাও বলছে সে দলে আছে কেন! কিন্তু কিছু লোক তাকে জায়েজ করতে চাচ্ছে সে হিন্দু বলেই, প্রশ্ন তুলছে অন্যরাওতো খারাপ খেলছে। ধর্মীয় কারণে ফ্লপ প্লেয়ারকে সমর্থন করাও সাম্প্রদায়িকতা।
আবার কিছু লোক তাকে তীব্র আক্রমণ করছে ধর্মের কারণে। হাস্যকর হলেও এরা বিশ্বাস করে যে নরেন্দ্র মোদির সুপারিশে লিটন বাংলাদেশ দলে টিকে আছে। আরেক খেলোয়াড় সৌম্যকেও ধর্মীয় কারণে বিরূপ মন্তব্য শুনতে হয়। এর সবই সাম্প্রদায়িকতা।
আমরা খেলাকে খেলা হিসেবে যতদিন দেখবো না, খেলার সঙ্গে ধর্ম এবং রাজনীতিকে যতদিন জড়িয়ে রাখবো, ক্রিকেট থেকে সাম্প্রদায়িকতা কোনোদিনও যাবে না। তবে এটাও ঠিক এ ধরনের সমালোচনা, ধর্মীয় আক্রমণ, সাম্প্রদায়িকতা কমে যাবে যদি আমাদের খেলোয়াড়রা আরও ভালো খেলে, বেটার টিম হতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
সান নিউজ/এফএইচপি