ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলেছে আত্মহত্যা। কিন্তু মিলছে না এর সমাধান। উদঘাটন হচ্ছে না যে এই আত্মহত্যার মূল কারণ কি বা কেন এই নিকৃষ্টতম কাজের মাধ্যমে নিজেকে বিনাশ করা। সমাজের একদম নিন্মশ্রেণি থেকে উচ্চশ্রেণি এবং সাত বছর বয়সী শিশু থেকে সত্তর বছর বয়সীসহ সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে যারা অবস্থান করছেন তাদের কেউই বাদ নন এই আত্মহত্যা নামক জঘন্যতম কাজ থেকে। যা একটি সমাজ, একটি দেশ বা একটি জাতির জন্য লজ্জা, হতাশাজনক। আত্মহত্যা প্রবণতা থেকে রক্ষার জন্য পালন করা হয় বিশ্ব আত্মহত্যা বিরোধী দিবস। বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বিশ্বের অনেক দেশে ২০০৩ সাল থেকে দিবসটি পালন করা হয়। এই দিবসটি পালন করতে আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংস্থার সাথে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বৈশ্বিক মানসিক স্বাস্থ্য ফেডারেশন একসাথে কাজ করে। ২০১১ সালে অনুমনিক ৪০টি দেশ এই দিবসটি উদযাপন করে।কিন্তু কি লাভ হচ্ছে আমাদের তাতে!
গত ১০ সেপ্টেম্বর আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস ছিল কিন্তু আমরা সচেতন হচ্ছি না। ক্রমেই বেড়ে চলেছে এই প্রবণতা। আত্মহত্যা বিরোধী দিবস থেকে কি শিক্ষা পেয়েছি আমরা? প্রশ্ন থেকে যায় মনে। কিন্তু প্রতিবছর আমরা আত্মহত্যা বিরোধী দিবস পালন করছি ঠিকই কিন্তু কি শিক্ষা গ্রহণ করছি তা কেউ জানিনা, ২০১৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার করা মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বের নিম্ন আয়ের কোন দেশেই আত্মহত্যা প্রতিরোধে কোন কৌশল বা কর্মপন্থা ঠিক করা নেই যেখানে নিম্ন মধ্য আয়ের দেশসমূহের ১০% এবং উচ্চ আয়ের সব দেশেই এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা রয়েছে। এবং সচেতনতা তৈরির একটি পন্থা যেখানে কেউ কেউ ভালোবাসা সাইন প্রদর্শন করে। কিন্তু তারপরও থেমে নেই আত্মহত্যা।
আমাদের সকলের উচিত আমাদের পারিবারিক, সামাজিক বন্ধনটা আরো শক্ত করা। একে অপরের খোঁজ খবর রাখা। সমাজের সকলকে সচেতন করে তোলা। তাহলে ধীরে ধীরে আত্মহত্যার প্রবণতা কমে আসবে। তাই আসুন নিজে সচেতন হই, নিজের পরিবারকে সচেতন করি। পারিবারিকভাবে শুরু থেকেই শিশুদের এই নিকৃষ্টতম কাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার করে তুলি। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার আদর্শে গড়ে তুলি আমাদের পরিবার, আমাদের সমাজ, আমাদের দেশ।
আমরা একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পারি যে বর্তমানে আত্মহত্যার পরিমাণটা অনেকগুণ বেড় গেছে এবং যেটার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এই নিকৃষ্টতম কাজের সাথে যুক্ত হচ্ছে। বর্তমান সময়ে আত্মহত্যার,যেনো কোন বাছ-বিচার নাই। সব থেকে খারাপ লাগে তখন, যখন একটা শিক্ষিত সমাজের মানুষ বা একটা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থী এটার সামিল হয়। করোনাভাইরাসের এই মহামারির মধ্যে শিক্ষার্থী ভিতর যেনো এই প্রবণতাটা বেড়ে গেছে। ধৈর্য বা মানসিক শক্তি যেনো একেবারেই নেই।
করোনার এই সময়ে সরকারি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের ৫৭ জন শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। গত বছরের মার্চ থেকে চলতি বছরের ২ অক্টোবর পর্যন্ত যারা এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছেন। এবং সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ মাসে ৪ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। বেসরকারি সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন গত ৪ জুন পর্যন্ত করোনার ১৫ মাসে আত্মহত্যার যে হিসাব দিয়েছে, তাতে ৪২ জন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী। কালের কণ্ঠ ৪ জুন থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত আত্মহত্যার খবর পর্যালোচনা করেছে। তাতে আরো আটজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর আত্মহননের তথ্য পাওয়া গেছে। আঁচলের হিসাবে গত ৪ জুন পর্যন্ত সারা দেশে অন্তত ১৫১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে ৭৩ জন স্কুল শিক্ষার্থী, ২৭ জন কলেজ শিক্ষার্থী ও ২৯ জন মাদরাসার শিক্ষার্থী রয়েছেন। উপরোক্ত আত্মহত্যার চিত্র গুলো খুবই সামান্য। কিন্তু এর আড়ালে রয়ে গেছে হাজারো আত্মহত্যার ঘটনা। যেখানে খুব সহজেই সমাপ্তি ঘটে একটি জীবনের।
প্রত্যেকটা মানুষের আত্মহত্যার পিছে কিছু না কিছু কারণ থেকে যায়। যা আমরা বাইরে থেকে দেখতে পেলেও আত্মহত্যার মূল কারণ কখনও জানতে পারিনা বা তার সাথে কি এমন ঘটেছিলো যে, সে তাকে শেষ করে দিতে দ্বিধাবোধ করলো না। মানুষের জীবনে প্রত্যহ নানারকম ঘটনা ঘটতেই আছে। কখনও সুখ কখনও বা দুঃখ। এই নিয়েই ছুটে চলা অবিরাম। কিন্তু তাই বলে মৃত্যুই সব কিছুর সমাধান হতে পারে না। কেননা আপনার জীবনটার সাথে সংযুক্ত আরো কয়েকটি জীবন। আপনার সাথে জড়িয়ে আছে একটা পরিবার, আপনার সমাজ। আপনি আত্মহত্যা করে সব থেকে কঠিন অবস্থায় ফেলে গেলেন আপনার পরিবারকে। কোন আত্মহত্যাকারী কখনও তার পরিবারের কথা তার বাবা-মায়ের কথা চিন্তা করেনা। যদি তাই করতো তাহলে তাদের দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিতো না।
এমন তো না যে আত্মহত্যা করলে সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। সব কিছুর সমাধান হবে! তাহলে কেন আত্মহত্যা! মানুষ মানসিকভাবে যখন বিকারগ্রস্ত হয় তখন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। যখন তার হিতাহিত জ্ঞান শূন্যের কোটায় নেমে আসে কিন্তু এটা ভাবতে অবাক লাগে যে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কেনো অল্পতেই ভেঙ্গে পড়বে। একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার জন্য যে পরিশ্রম করে যে পরিমাণ ধৈর্য ধারণ করে তা কল্পনাতীত। সেই কঠিন সময়টা পার করে এসে যখন সোনালী দিন পার করে তখন সে আত্মহত্যা করে বিষয়টা ভাবিয়ে তোলে সাধারণ মানুষকে।
কেননা একটি পরিবার, একটি সমাজ দেশ ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে নিয়ে ভাবে। তার কাছে কিছু চাওয়া পাওয়া থাকে এই সমাজের। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই আত্মহত্যা যদি বন্ধ না করা যায় এই মুহূর্তে তবে এটি ট্রেন্ড হবে উঠবে। একটা সময়ে অভিভাবকরা ভয় পাবে তার সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে কারণ, সে ভাববে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করে। শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রবণতা দূর করতে আমাদেরকে আরো সচেতন হতে হবে। শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিং করতে হবে। তাদের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে এবং তার সুষ্ঠ সমাধানে সুফল আসবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাইরেও রয়েছে আত্মহত্যার ভয়াবহ চিত্র। আত্নহত্যা সম্পর্কিত বা আত্নহত্যাকে কেন্দ্র করে সরকারি-বেসরকারী ও বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রতি বছরেই জরিপ চলছে। যেমন,সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ পরিচালিত ওই জরিপটির শিরোনাম ‘বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভে ২০১৬’। এই জরিপ অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা, পানিতে ডুবে মৃত্যু, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু, ভবন থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যুসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনায় শিকার হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় শীর্ষে রয়েছে আত্মহত্যা। দেশের ১৬টি জেলায় পরিচালিত জরিপ থেকে এ তথ্য জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে বিষয়টি নিয়ে তারা আরও গবেষণা করতে চায়।
জরিপের তথ্য থেকে জানা গেছে, ২০১৬ সালে ১৭ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল প্রতিদিন গড়ে ৩০। ২০০৩ সালে একই সংস্থার জরিপে এই সংখ্যা ছিল ৬ জন। সেই হিসাবে ১৩ বছরের ব্যবধানে ওই বয়সী শিশু-কিশোরদের আত্মহত্যার সংখ্যা বছরে ২,২১৮ জন থেকে বেড়ে হয়েছে ১০,৯২১ জন। জরিপ অনুযায়ী, ২০১৬ সালে পূর্ণবয়স্কদের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল প্রতিদিন ৩৬ জন। এ হিসাবে সারাবছরে আত্মহত্যার মোট সংখ্যা ছিল ১৩,২২৬ জন। এছাড়াও, গত বছর আত্মহত্যার চেষ্টা করে ১৫,৯৮১ জন। জরিপ থেকে জানা যায়, যেকোনও বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা প্রতি লাখে ১৪ জন। পুরুষদের মধ্যে এই হার ৮ জন, নারীদের মধ্যে ২১ জন।
এদিকে, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও পুলিশ সদর দফতরের হিসাব অনুযায়ী দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন আত্মহত্যা করেন। সে হিসাবে প্রতিবছর দেশে প্রায় ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যার পরিসংখ্যান আত্মহত্যার ওপর বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চল, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো এবং জাপানে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। গত ৫০ বছরে সারা পৃথিবীতে, মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আত্মহত্যার হার শতকরা ৬০ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশে পরিচালিত এক গবেষণায় পারিবারিক সমস্যা (৪১.২%), পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া (১১.৮%), বৈবাহিক সমস্যা (১১.৮%), ভালোবাসায় কষ্ট পাওয়া (১১.৮%), বিবাহবহির্ভূত গর্ভধারণ ও যৌন সম্পর্ক (১১.৮%), স্বামীর নির্যাতন (৫.৯%) এবং অর্থকষ্ট (৫.৯%) থেকে রেহাই পেতে আত্মহত্যার চেষ্টা করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ বলছে, প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা জনিত কারণে মারা যান। যা নির্দেশ করে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৪০ জনের মৃত্যু হয় আত্মহত্যার কারণে।পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই মৃত্যুর প্রথম ১০ টি কারণের মধ্যে এবং ১৫-৩৫ বছর বয়সীদের মধ্যে প্রথম তিনটি কারণের একটি হলো আত্মহত্যা।এবং ২০১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বিবিসির এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় আত্মহত্যার জরিপে বিশ্বের দশম স্থানে আছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের আত্মহত্যা ঘটনা ঘটার পিছে কিছু কারণ আছে। যেমন পারিবারিক কলহ,স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া। প্রেমে বাধা, আশানুরূপ ফল না পাওয়া, চাকরি না পাওয়া অভাব-অনটন,যৌতুক,সামাজিকতার নির্যাতন,বাবা-মায়ের অতিরিক্ত শাসন, বেশি আবেগী ইত্যাদি। এবং যারা আত্মহত্যার করে তাদের ভিতরে কিছু লক্ষণ দেখা যায় যেমন- হতাশা, এলোমেলো কথাবার্তা, সবার কাছে মাফ চাওয়া। সব সময় রেগে থাকা ইত্যাদি। তাই আমাদের সকলের উচিত আমাদের পারিবারিক, সামাজিক বন্ধনটা আরো শক্ত করা। একে অপরের খোঁজ খবর রাখা। সমাজের সকলকে সচেতন করে তোলা। তাহলে ধীরে ধীরে আত্মহত্যার প্রবণতা কমে আসবে। তাই আসুন নিজে সচেতন হই, নিজের পরিবারকে সচেতন করি। পারিবারিকভাবে শুরু থেকেই শিশুদের এই নিকৃষ্টতম কাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার করে তুলি। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার আদর্শে গড়ে তুলি আমাদের পরিবার, আমাদের সমাজ, আমাদের দেশ। বন্ধ হোক আত্মহত্যা ।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।
সূত্রঃ জাগোনিউজ২৪ডটকম