অদিতি ফাল্গুনী: খ্যাতনামা লেখক গৌরকিশোর ঘোষের অতল সংবেদী, মর্মস্পর্শী উপন্যাস ‘প্রেম নেই‘ দেশভাগ বা ১৯৪৭-এর আগের অবিভক্ত বাংলায় হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক এবং এই আন্তঃসম্পর্কের ক্ষেত্রে দুই সম্প্রদায়ের ‘এই রোদ এই বৃষ্টির মতো’ এই মৈত্রী এই বৈরীতা, এই বন্ধুত্ব আবার এই সংঘাতের টানটান উত্তেজনা নিপুণ কুশলতায় ধরা হয়েছে
বারো ক্লাসে পড়ার সময় উপন্যাসটি প্রথম আমার হাতে এসেছিল। উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদ ‘আওরতে হাসিনা (সুন্দরী মহিলা)‘-য় যশোরের এক গ্রামের বিশ্বাস বাড়ির মেয়ে টগর ও হাজি বাড়ির মেয়ে বিলকিসের অনাবিল সখীত্বের সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে। কিশোরী এই দুই মেয়ে পুকুরঘাটে নাইতে নেমেছে। তারা দু’জন দু‘জনের ‘গোলাপ ফুল‘ সই। টগর নিজের হাতে বিলকিসের চুলে সুগন্ধি সাবান ঘষে দেয়। দুই বান্ধবী কত না মনের কথা পরস্পরকে বলে! কিন্তু অবগাহন শেষে পুকুর থেকে ওঠার সময় ভুল করে বিলকিস টগরের ঘড়ায় ভরা পূজার জন্য তোলা জল ছুঁয়ে দিলে টগরকে ফেলে দিতে হয় ঘড়ার জল আর বিলকিসের চোখ জলে ভরে ওঠে। গৌরকিশোরের ভাষায়, ‘টগর কাঁখ থেকেই ঘড়া উপুড় করে ঘড়ার জল ফেলে দিতে লাগল। বিলকিস করুণ চোখে দেখতে লাগল টগরের ঘড়ার জল গড়গড় করে গড়িয়ে এসে ওদের দু‘জনের মাঝখানে কেমন একটা মোটা দাগ টেনে নদীর দিকেই নেমে যাচ্ছে।‘
ইতিহাসের পাতায় দৃষ্টি মেললে দেখা যায় ১২০৩ সালে রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে ইখতিয়ার উদ্দিন বিন বখতিয়ার খলজীর গৌড়ের রাজধানী নবদ্বীপ জয়ের মাধ্যমে বাংলায় ইসলামের আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপের শুরু। আজ ২০২১ সালে এসে দুই বাংলা মিলিয়ে (আসাম ও ত্রিপুরায় বাংলাভাষী জনসংখ্যা এখানে ধরা হচ্ছে না) বাংলাদেশের ১৬ কোটি ও পশ্চিম বাংলার ৯ কোটি তথা ২৫ কোটি বাঙালির ভেতর এপার-ওপার মিলিয়ে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের কাছাকাছি এবং হিন্দু জনসংখ্যা সব মিলিয়ে এক-তৃতীয়াংশের মতো। আট শতাব্দী-কালজুড়ে বাংলাভাষী জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠের এই ধর্মান্তরকে হিন্দু ইতিহাসবেত্তারা ইসলামের ‘বলপ্রয়োগ বা তরবারির জোরে ধর্মান্তর‘ আর মুসলিম ঐতিহাসিকেরা হিন্দু বর্ণাশ্রমে নিষ্পেষিত কোটি কোটি শূদ্র, অস্পৃশ্য তথা নিম্নবর্গের মানুষের আত্ম-মর্যাদা ও মুক্তি লাভের জন্য সূফী সাধকদের কাছে এসে স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হওয়া বা ‘স্যালভেশন থিয়োরি‘র আলোয় ব্যাখ্যা করেছেন।
হালে রিচার্ড ইটনের ‘দ্য রাইজ অব ইসলাম অ্যান্ড দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার, ১২০৪-১৭৬০‘ গ্রন্থে আবার ‘তরবারির জোরে ধর্মান্তর‘ ও ‘অস্পৃশ্যতা ঘোঁচাতে স্বেচ্ছায় ধর্মান্তর‘ এই দু‘টো তত্ত্ব নাকচ করে ইটন দেখিয়েছেন যে, বাংলার বিস্তীর্ণ সব অরণ্যাঞ্চল সাফ করে আবাদী জমি তৈরির সময় মূলত হিন্দু বর্ণাশ্রমও বাংলায় তত দিনেও সমাজের সর্বস্তরে পাকা-পোক্তভাবে না থাকায় এক ধরনের সর্বপ্রাণবাদী আচার-আচরণে অভ্যস্ত বাঙালি কীভাবে পাঠান বা মোগল শাসক ও তাঁদের আধ্যাত্মিক নেতা বা সূফীদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে ধীরে ধীরে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছেন।
ইটন তাঁর মতবাদের পক্ষে ইতিহাসের নানা দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে প্রচুর তথ্য-উপাত্ত হাজির করেছেন। ইটন আরো বলেন যে, তরবারির জোর অথবা বর্ণাশ্রমের নিগড় ঘোঁচাতে ধর্মান্তরের তত্ত্বই সত্য হলে দু‘টো ক্ষেত্রেই উত্তর ভারত থেকে বিহার অবধি মানুষ অনেক বেশি ধর্মান্তরিত হতে পারত। যেহেতু উপমহাদেশে দীর্ঘ মুসলিম শাসনের কেন্দ্র-বিন্দু বহু শতক ধরেই ছিল দিল্লিতে আর উত্তর ভারত থেকে বিহার অবধি বর্ণাশ্রমের কঠোরতা চিরদিনই বাংলার চেয়ে বহু গুণ বেশি ছিল বা আজো আছে।
যাহোক, ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ১৮৭১ সালের ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সেন্সাস‘-এ প্রথম দেখা যায় যে বাংলায় মুসলিম জনসংখ্যা হিন্দু জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। এদিকে ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধোত্তর বাংলায় সুতানুটি-কলকাতা-গোবিন্দপুর নামের তিনটি গ্রাম কিনে নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠা এবং ১৭৭২ থেকে ১৯১১ সাল অবধি ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হিসেবে কলকাতার অবস্থানকালীন পর্বে বাংলার মুসলিম সম্প্রদায় ইংরেজি শিক্ষা কিছু দেরিতে গ্রহণ করায় চাকরি-বাকরিসহ অর্থনৈতিক নানা কর্মকাণ্ডে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল। পিছিয়ে ছিল হিন্দু বর্ণাশ্রমের অবহেলিত সম্প্রদায়গুলোও।
এ নিয়ে ক্রমাগত ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠা বাংলার মুসলিম সম্প্রদায় মূলত ১৮৭১ সালের জনগণনার পরেই তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবিধার দিক বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠে। ১৯০৬ সালে ‘ইন্ডিয়ান মুসলিম লীগ‘ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৩০ সালে প্রখ্যাত কবি স্যার সৈয়দ ইকবাল কর্তৃক ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের জন্য যে যে প্রদেশগুলোয় মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেসব প্রদেশ নিয়েই একটি পৃথক রাষ্ট্র ‘পাকিস্তান‘ বা ‘পবিত্র ভূমি‘ গঠনের প্রস্তাব দিলে পাঞ্জাব, সিন্ধু, লাহোর বা বালুচিস্তানের চেয়েও যে জনপদের মুসলিমরা সবচেয়ে বেশি পাকিস্তান প্রস্তাবের পক্ষে চঞ্চল হয়ে ওঠে, তারা ছিল বাংলার মুসলিম।
গৌরকিশোর ঘোষের ‘প্রেম নেই‘-এ দেখা যাচ্ছে যে কিভাবে মুসলিম লীগের প্রচারকরা প্রচার করছেন যে ‘ডাক্তার হিন্দু, রোগী মুসলিম। শিক্ষক হিন্দু, ছাত্র মুসলিম। উকিল হিন্দু, মক্কেল মুসলিম‘ ইত্যাদি ইত্যাদি। এই প্রেক্ষাপটে সদ্য ইংরেজি শিক্ষার সংস্পর্শে আসতে থাকা পূর্ব বাংলার তপশিলী সম্প্রদায়ও যোগেন মন্ডলের নেতৃত্বে পাকিস্তান প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলে বাংলা ভাগ অনিবার্য নিয়তি হয়ে ওঠে এবং পূর্ব বাংলা থেকে কোটি কোটি হিন্দুকে দেশত্যাগ করতে হয় যার ধারাবাহিকতা আজো চলছে।
পাকিস্তান হবার পরপরই সে দেশের ‘কায়েদে আযম‘ বা ‘জাতির পিতা‘ ব্যারিস্টার মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ অবশ্য ‘টু নেশন থিয়োরি‘ বা দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগের প্রধান নেতা হলেও পাকিস্তান ‘সব জাতি ও ধর্মের মানুষের জন্য সমান অধিকারের রাষ্ট্র‘ হবে ঘোষণা দেন। তবে, সে ঘোষণা কাগজ-কলমেই ছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি তার জন্ম মুহূর্ত থেকেই সামরিক শাসন ও রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ইসলামের প্রবল ব্যবহারের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। স্বয়ং যোগেন মন্ডলকে পদত্যাগ পত্র দাখিল করে ভারতে পালাতে হয়।
পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূচনা: কতটা জাতীয়তাবাদী আবেগ ও কতটা অর্থনৈতিক বাস্তবতা?
সাধারণত প্রচলিত ইতিহাস বইয়ে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনকে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূচনা‘ ও তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ইসলাম বা সংখ্যাগুরুর ধর্মভিত্তিক আবেগের পরিবর্তে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী আবেগ বা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির উত্থান বলে মনে করা হলেও ডাচ নৃ-তাত্ত্বিক ভেলাম ভ্যান শেন্ডেল তাঁর ‘আ হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ‘ বইয়ের ১০৭ নম্বর পাতায় যথার্থই উল্লেখ করেছেন যে ‘এটা (ভাষা আন্দোলন) শুধুই আঞ্চলিক গর্ব, সাংস্কৃতিক সত্তা বা গণতান্ত্রিক নীতির জন্য লড়াই ছিল না, বরং হতাশ কর্ম অভিলাষের একটি প্রতিফলনও এতে ছিল। রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রে উর্দূভাষীদের অগ্রাধিকার দেয়া হতো বা অধিকতর পছন্দ করা হতো যা কিনা পূর্ব পাকিস্তানে স্থানীয়দের বলতে গেলে সব পর্যায়ে বা স্তরেই ছেঁটে ফেলেছিল (পূর্ব পাকিস্তানে এক শতাংশেরও কম মানুষ উর্দূ বলত, যেহেতু এটি ছিল তাদের জন্য একটি দ্বিতীয় ভাষা) এবং উত্তর ভারত থেকে আসা অভিবাসীদেরই বাঙালিদের তুলনায় পছন্দ করা হতো।’
যেহেতু সীমিত পরিসরে শেন্দেলের বই থেকে বিস্তারিত উদ্ধৃতি দেয়া বা আলোচনা করা সম্ভব নয়, তবু একথা বলাই যায় যে ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল অবধি বাঙালি জাতীয়তাবাদের আবেগ দৃশ্যত তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে বিস্তার লাভ করলেও আসলে এই আবেগের মোড়কের নিচে লুকনো ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য। স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী‘ পড়লেই আমরা দেখতে পাবো কি অপরিসীম স্বপ্ন ও ভালোবাসা নিয়ে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে নেমেছিলেন। ‘প্রেম নেই‘ উপন্যাসের মুসলিম কিশোরী বিলকিস যেমন বান্ধবী টগর তার ছোঁয়া লাগা কলসের জল ফেলে দিলে মলিন ও সংকুচিত হয়ে পড়ে, কিশোর মুজিবও একবার এক হিন্দু বন্ধুর বাসায় যাওয়ার ‘অপরাধে‘ সেই বন্ধুর কাকী পরে পুরো ঘর ধুয়ে ফেলেন। পরবর্তীকালে মুজিব হয়ে ওঠেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একনিষ্ঠ ভক্ত ও সমর্থক। তবু, স্বপ্নভূমি পাকিস্তানে উর্দূ ভাষী মুসলিমদের নানা বৈষম্যে ব্যথিত হতে হতে এক সময়ের প্রবল পাকিস্তান আন্দোলনকারী মুজিবই হয়ে উঠলেন পাকিস্তান সরকারের কারাগারের এক নম্বর অতিথি!
বারো বছর কারাভোগের পাশাপাশি নানা আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নেবার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন এ দেশের মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। অবশেষে এলো একাত্তরের সেই পরম ক্ষণ। ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলমান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান‘ শ্লোগানে অসংখ্য বাঙালি মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লেও আজ কিন্তু নতুন ভাবে প্রশ্ন উঠছে এবং নির্মোহ বিশ্লেষণের খাতিরে এই প্রশ্ন আমাদের নিজেদের করতেই হবে যে- সত্যিই কি আমরা ধর্মীয় আবেগের উর্ধ্বে উঠে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আবেগ থেকেই এসব করেছিলাম নাকি পশ্চিম পাকিস্তানীদের সঙ্গে চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যে পেরে না ওঠা সংখ্যাগুরু বাঙালি মুসলমান হাঁপিয়ে উঠেছিল? যেমন সে হাঁপিয়ে উঠেছিল ঠিক ২৪ বছর আগে শিক্ষা-দীক্ষা, চাকরি-ব্যবসায় এগিয়ে থাকা একই ভাষার ভিন্নধর্মী, পড়শি সম্প্রদায়ের সঙ্গে।
একদিকে বাঙালি মুসলিম ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে‘ যোগ দেয় মুখ্যত পাকিস্তান রাষ্ট্রে তার প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক অর্জন সম্ভবপর হয় না বলে, অন্যদিকে এ দেশে থেকে যাওয়া অবশিষ্ট বাঙালি হিন্দু নিরঙ্কুশভাবে এই নয়া জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যোগ দেয় শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে পাকিস্তান রাষ্ট্রে তার দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক পরিচয় মুছে সে সমতা অর্জন করতে পারবে এই আশায়।
১৯৭৫-১৯৯১: রাষ্ট্রের ক্রমাগত ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সময়
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। শুধু বিদেশে থাকায় দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যান। সৌদি আরবসহ অসংখ্য ইসলামী রাষ্ট্র মুজিব হত্যার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। জেনারেল জিয়ার সময়ে বা ১৯৭৯ সালে সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ (সর্বশক্তিমান ও পরম করুণাময় আল্লাহ তা‘য়ালার নামে শুরু করছি) যুক্ত করা হয় এবং তখনো এ দেশে ২০ শতাংশ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ছিল। ১৯৮৮ সালে জেনারেল এরশাদ সংবিধানে অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্মকে ইসলাম হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৯৯১ সালে এরশাদ শাহীর পতনের পর প্রথম সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয় এবং খালেদা জিয়ার সেই প্রথম শাসনামলে রোজার মাসে ঢাকা ভার্সিটির একমাত্র সংখ্যালঘু ডরমিটরি জগন্নাথ হলে ছাত্ররা খাবার অপরাধে পুলিশ ডাইনীং রুমে ঢুকে পা দিয়ে বা লাঠি দিয়ে খাবারের পাত্র উল্টে ফেলে ছাত্রদের লাঠিপেটা করে এবং রোজার মাসে খাবার অপরাধে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলেও ২০০১ সালে পুনরায় বিএনপি ক্ষমতায় আসে এবং ২০০১-এর অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হবার পর সারাদেশে অসংখ্য মন্দিরে আক্রমণ, সম্পত্তি লুট ও প্রায় আট হাজার নারী ধর্ষিত হন। এই আট হাজার ধর্ষণের ভেতরে শুধু পূর্ণিমা শীলের ঘটনাটি মিডিয়ায় প্রচুর প্রচারের কারণে আদালতে উঠেছে এবং তার বিচারও হয়েছে। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে ২০১২ সালে রামুর বৌদ্ধপল্লীতে হামলা, ২০১৬ সালে নাসিরনগরের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর সহিংসতা, ২০১৩ সালে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলায় স্থানীয় হিন্দুদের প্রতি নৃশংসতা এবং ২০১৯ সালে ভোলার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলার পরিপ্রেক্ষিতে দায়ের করা ৩৩টি মামলার কোনোটিরই বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি (মতামত, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ১৬ই অক্টোবর ২০২১)।
বাংলাদেশে আজ সংখ্যালঘু জনসংখ্যার শতাংশ হার কমতে কমতে ৮ বা মতান্তরে ৬-৭ শতাংশে এসে পৌঁছেছে। ‘ইউনিভার্সেল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস‘ বা ‘জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা-১৯৪৮‘সহ পৃথিবীর যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার দলিল বা বাংলাদেশের সংবিধানেও সব মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলা আছে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে সম্পূর্ণ অন্য কথা। গত বছর অক্টোবরে আমি চীনের ধর্ম পালনের অধিকার বঞ্চিত উইঘুর মুসলিম কবিদের কয়েকটি কবিতা অনুবাদ করেছিলাম যাদের চীন সরকার রোজা-নামাজ-হজ্ব পালনের অধিকার দেয় না। আজ কি বাংলাদেশ তেমন কোনো অতল পাতালের দিকে ধাবিত হচ্ছে? সুত্রঃ রাইজিংবিডিডটকম
সান নিউজ/এনকে