আনিস আলমগীর
সাম্প্রতিক সময়ে ১৯৭২ সালের সংবিধান বা বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা খুব বলা হচ্ছে। এই নিয়ে একজন প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনার ঝড় তুলেছে। তিনি চান বঙ্গবন্ধু সরকার প্রণীত ওই সংবিধানে ফিরে যেতে এবং প্রয়োজনে সংসদে প্রস্তাব আনতে। তবে এটি তার নিজের ইচ্ছায় নাকি দলীয় সিদ্ধান্ত, সে বিষয়ে তার বক্তব্য পরিষ্কার নয় বা তিনি কায়দা করে এটি এড়িয়ে গেছেন।
বাহাত্তরের সংবিধানে আমাদের ফিরে যাওয়ার সুযোগ এবং পরিকল্পনা কতটা আছে সেই বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে ’৭২-এর সংবিধানের মূল চেতনার বিষয়ে কিছু কথা বলতে চাই। বাহাত্তরের সংবিধানের সবচেয়ে বড় বিষয়টি হচ্ছে অসাম্প্রদায়িকতা।
ভারত উপমহাদেশ থেকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জন্ম পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প দেখতে দেখতে এই অঞ্চলের মানুষ বড় হয়েছে। তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিল, যেটি হবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। যেখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই সমান অধিকার ভোগ করবে। বাঙালি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান- সবাই এক হয়ে দেশ গড়বে। কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষা বারবার ব্যর্থ হয়েছে। এই স্বাধীন বাংলাদেশেও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প কখনও থেমে থাকেনি।
গত ১৩ অক্টোবর ২০২১ কুমিল্লায় একটি পূজামণ্ডপে কোরআন পাওয়ার পর ওই ঘটনার জের ধরে ঢাকা, কুমিল্লা, ফেনী, কিশোরগঞ্জ, চাঁদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলা ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এমন দেশটি কারও কাঙ্ক্ষিত ছিল না। বাহাত্তরের চেতনার সঙ্গে তা যায় না। পুলিশ জানিয়েছে, গত ১৩ অক্টোবর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন্দির, স্থাপনা ও বাড়িঘরে হামলার যেসব ঘটনা ঘটেছে, তাতে ৭১টি মামলা হয়েছে এবং ১৮ অক্টোবর রাত পর্যন্ত এসব মামলায় ৪৫০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মুসলিম মৌলবাদীরাই এসব করেছে তাতে সন্দেহ নেই।
রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা সন্তোষজনক না হলেও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সমাজের নানা শ্রেণির ব্যক্তিরা এসব কলঙ্কজনক ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে। ওদিকে, ঘোলা পানিতে মাছ ধরায় ব্যস্ত ভারতীয় হিন্দু মৌলবাদীরা।
বিবিসি বাংলা রিপোর্ট করেছে, ‘কুমিল্লার পূজামণ্ডপে কোরআন পাওয়া এবং সেটিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি মন্দিরে হামলা ও পুলিশের সঙ্গে হামলাকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ে ভারতের সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে রক্ষার দাবি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা রকম পোস্ট এবং কমেন্ট করা হচ্ছে। ভারতের সামাজিক মাধ্যমে শুধু যে বাংলা ভাষাভাষীরা প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন তা নয়। অনেক পোস্ট দেখা যাচ্ছে হিন্দি এবং ইংরেজিতে লেখা। বেশিরভাগ মানুষের পোস্ট বা টুইট দেখে বোঝাই যাচ্ছে তারা হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্ত এবং পরিকল্পনা মাফিক পোস্ট করছেন। বিশেষত যেগুলো হিন্দি বা ইংরেজিতে লেখা সেখানে সরাসরি মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেওয়া হচ্ছে।’
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর থেকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন কয়েকগুণ বেড়েছে। আবার এই নির্যাতনকে কেন্দ্র করে ভারতেও বাড়ছে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর নির্যাতন। ২০০২ সালে গুজরাট গণহত্যা এবং ২০২০ সালে দিল্লি গণহত্যায় মুসলমানদের প্রাণ দিতে হয়েছে হিন্দু জঙ্গিদের হাতে, যদিও এগুলোকে দাঙ্গা বলা হচ্ছে। তারপরও বাংলাদেশকে উদাহরণ দিয়ে ভারতীয় হিন্দু মৌলবাদীরা এসব বেশি প্রচার করছে তাদের হত্যা নির্যাতন জায়েজ করতে। এমনকি এই ঘটনাকে ক্যাশ করে আসন্ন উপনির্বাচনে জিতবে সেটাও প্রকাশ্যে বলছে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির মৌলবাদী নেতৃত্ব।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর যে নির্যাতন হচ্ছে তা ধর্মীয় আবরণে ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটিস আর ভারতে বিজেপি সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ভোটের বাজারে বক্তৃতা দিচ্ছে, যেন সংখ্যালঘুরা ভিন দেশি নাগরিক। তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মর্যাদা দিতেও আপত্তি বিজেপি সরকারের। বাংলাদেশেও সংখ্যালঘুদের ভিন দেশি নাগরিক হিসেবে দেখা হচ্ছে, কিন্তু সেটা মগজে মৌলবাদ, হিংসা লালন করা ব্যক্তি বিশেষের কাজ, রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা নয়।
সম্ভবত এসব কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে ভারতকে সতর্ক করেছেন। ১৩ অক্টোবর হিন্দু নেতাদের পূজার শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় দেওয়া বিবৃতিতে তিনি যেভাবে সরাসরি ভারতের প্রসঙ্গ টেনেছেন, তার নজির বিরল। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে ভারতকেও সচেতন হতে হবে। ‘সেখানেও (ভারতে) এমন কিছু যেন না করা হয় যার প্রভাব আমাদের দেশে এসে পড়ে, আর আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আঘাত আসে।’
বাংলাদেশের সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রকাশ্যে ভারতের অভ্যন্তরীণ স্পর্শকাতর কোনও বিষয় নিয়ে আপত্তি-অস্বস্তির কথা বলার নজির বিরল, যদিও বাংলাদেশে সংখ্যালঘু প্রশ্নে পান থেকে চুন খসলে ভারতের তরফ থেকে প্রকাশ্যে নসিহত করা হয়। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে আগে ভারতের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসীর প্রসঙ্গ টেনে তাদের উইপোকার সঙ্গে তুলনা করলেও সরকারের তরফ থেকে অন্তত প্রকাশ্যে তা নিয়ে ভারতের কাছে কোনও প্রতিবাদ জানানো হয়নি।
যাহোক, অসাম্প্রদায়িকতার পাশাপাশি বাহাত্তরের সংবিধানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র। আমরা মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজার এমনভাবে খুলে দিয়েছি যে সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্র বাজারকে এতটা নিয়ন্ত্রণহীন করে দেওয়া ঠিক না।
একটি রাস্তায় যদি ট্রাক-বাস-গাড়ি-রিকশা যে যেভাবে পারে চলে তাহলে সেখানে চলাচল অসম্ভব। সেই কারণে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ট্রাফিক পুলিশকে তদারকির দায়িত্ব দেওয়া আছে। এই তদারকি ছাড়া রাস্তায় যেমন যান চলাচল সম্ভব না, তেমনি ব্যবসার ওপর রাষ্ট্রের তদারকি না থাকলে বাণিজ্য বাজারে স্থিতিশীলতা আসবে না। বাজারের ওপর যে সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই সেটা তো নিত্যপণ্যের বাজারে গেলেই দেখা যাচ্ছে।
ইভ্যালির মতো ভুঁইফোড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের হাজার কোটি টাকা মেরে দেওয়ার মধ্যেও তা প্রমাণিত। ডেসটিনি, যুবকের মতো প্রতিষ্ঠান একের পর এক জনগণের টাকা মেরে দিচ্ছে। রাষ্ট্র দেখে যাচ্ছে শুধু।
মাহবুবুল কবীর মিলন নামে সরকারের একজন অতিরিক্ত সচিব ইভ্যালির ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন প্রকাশ্যে, কিন্তু রাষ্ট্র তার কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আব্দুন নূর তুষার ইভ্যালিসহ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতারণা সম্পর্কে প্রতিদিন সরকারকে সতর্ক করেছেন, সেখানেও রাষ্ট্র কোনও মাথা ঘামায়নি। তাতে মনে হচ্ছে সরকারের মধ্যে এই ভীতি কাজ করছে যে ব্যবসায়ীরা ক্ষেপে গেলে তাদের বিপদ হতে পারে। সরকার ব্যাংক লোন আদায় করতে পারছে না তাদের কাছ থেকে।
বাহাত্তরের সংবিধানে আমরা যদি ফিরে তাকাই তাহলে দেখি যে সেখানে ব্যবসায়ীদের এই লুটেরার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ ছিল না। ব্যবসায়ীদের সম্মানজনক পরিচয়ও ছিল না। সোসাইটি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষকে সম্মান করতো, সমাজে ব্যবসায়ী নয়, পেশাজীবীদের সম্মান ছিল। বঙ্গবন্ধু তার কন্যাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য একজন বিজ্ঞানীকে পছন্দ করেছিলেন। আজকের দিনে বিয়ের বাজারে বিজ্ঞানীর দাম ব্যবসায়ী থেকে বেশি নয় বলেই তো এখন আর বিজ্ঞান পড়ার শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছে না।
বাহাত্তরের সংবিধানে রাষ্ট্রকে ওয়েলফেয়ার রাষ্ট্র হিসেবে দেখা হয়েছিল, যা ইউরোপে এখনও বিরাজমান। সেই সামাজিক আদর্শ ধারণ করলে সমাজে আজ এই বৈষম্য সৃষ্টি হতো না। গরিব আর ধনীর মাঝখানের ব্যবধান এত বেশি দেখা যেত না। মধ্যবিত্ত নিষ্পেষিত হতো না।
জাতীয় সংসদ চলে গেছে ব্যবসায়ীদের হাতে। সচিবালয়ও ব্যবসায়ীদের হাতে। ব্যবসায়ী বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেই বলছেন তিনি কী ব্যবসায়ী না মন্ত্রী মাঝে মাঝে সেটা ভুলে যান। ‘ক্ল্যাস অব ইন্টারেস্ট’ দেখা হচ্ছে না মন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রে। আগে একজন ব্যবসায়ী একজন উপ-সচিবের রুমে ঢুকতে অনুমতির অপেক্ষায় থাকতেন। এখন সেই ব্যবসায়ী, ব্যবসায়ী-মন্ত্রীর বন্ধু বলে উপ-সচিবকে মন্ত্রী তার রুমে ডেকে ব্যবসায়ী বন্ধুকে দেখিয়ে বলেন, উনার কী সমস্যা ওই সোফায় বসে ঝামেলা শেষ করে ফেলেন।
বিচার ব্যবস্থা আজ এত ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে যে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বাহাত্তরের সংবিধানে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন করতে বলা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগে আইন করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তার কোনোটারই প্রতিফলন নেই। বিচারপতি নিয়োগের কোনও যোগ্যতার মাপকাঠি লিপিবদ্ধ নেই। নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত হতে যোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারণ করা নেই।
এমনকি সংস্কৃতির জগতেও এই ব্যবসায়ীরা প্রভাব ফেলেছে।
শেষ করার আগে বলতে চাই, ‘৭২-এর মূল সংবিধান এত কাটাছেঁড়া করার পর হুবহু ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। ওই সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা একটা রাজনৈতিক বুলি মাত্র। কিন্তু আমরা যেটি করতে পারি সেটা হচ্ছে, বাহাত্তরের সংবিধানের মূল লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, সকল প্রকার বৈষম্যহীন রাষ্ট্রে আমাদের ফেরত যাওয়ার অফুরান সুযোগ রয়েছে। আমরা সেই আদর্শ, লক্ষ্যকে ফিরিয়ে আনতে পারি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
সান নিউজ/এফএইচপি