সোহেল রানা: আমেরিকায় চরম বিরক্ত তুরস্ক। তুর্কিদের এই বিরক্তি আর অরুচি ধরেছে ট্রাম্পের বেখেয়ালি আচরণে। ফলে একসময়কার অতি ঘনিষ্ঠ দুই দেশ এখন পরস্পরের শত্রু।
ফ্রান্সের সাথেও এরদোয়ানের এখন দা-কুমড়া সম্পর্ক। পুরনো শত্রুতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছে গ্রিসের সাথেও। অথচ পশ্চিমের সাথে তুর্কিনেতাদের ছিল গলায় গলায় ভাব। তুরস্ক পশ্চিমাদের এতটাই পছন্দের ছিল যে , মুসলিম দেশ হয়েও ন্যাটোর সদস্য হতে পারে দেশটি। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সে সম্পর্ক এখন অনেকটাই মলিন।
ন্যাটোর প্রধান পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুর্কিদের সম্পর্ক এখন একেবারেই তলানিতে। সেই ঠান্ডা সম্পর্ককে আরো বেশি বরফে ঢেকে দেয় রাশিয়ার তৈরি এস ফোর হানড্রেড মিসাইল। তুরস্ক এই অত্যাধুনিক এন্টি মিসাইল প্রযুক্তি কিনেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ওপর একরকম অভিমান করেই। অবশ্য তাকে এজন্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হয়েছে, বাজে অর্থনীতির মুখে পড়তে হয়েছে। যদিও পাশ্চাত্য অবরোধ তুরস্ককে সামরিকভাবে শক্তিশালীই করে চলেছে।
পশ্চিমারা ভেবেছিল তুরস্ক হয়তো আর কোন রুশ মিসাইল কিনবে না। কিন্তু তুরস্ক যে আগের অবস্থান থেকে একচুলও নড়েনি , তা জানা গেলো প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোয়ানের কাছ থেকেই। এই তুর্কি নেতা খোদ আমেরিকান গণমাধ্যমকেই বলে দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে রাশিয়ার কাছ থেকে আরেক দফায় এস ফোর হানড্রেড মিসাইল কেনার কথা ভাবছে তার দেশ। সিবিএস নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, তুরস্ক তার প্রতিরক্ষাব্যবস্থার বিষয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবে। এরদোয়ান এতটা ক্ষুব্ধ হলেন কেন? কেনই বা আমেরিকাকে আর তিনি পাত্তা দিচ্ছেন না?
যুক্তরাষ্ট্রের মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম- ‘প্যাট্রিয়ট’ কিনতে চেয়েছিল তুরস্ক। কিন্তু আমেরিকা তা বিক্রি করেনি। পৃথিবীতে যে তিনটি সর্বাধুনিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম বা এন্টি মিসাইল সিস্টেম রয়েছে তার মধ্যে প্যাট্রিয়ট একটি। দূরপাল্লার এই মিসাইল যেকোন উচ্চতায়, যেকোন আবহাওয়াতে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। যেকোন ব্যালিস্টিক মিসাইল, ক্রুজ মিসাইল ও উন্নত প্রযুক্তর বিমানকে ধরাশায়ী করতে এটি বেশ কার্যকর। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও তাদের বন্ধু রাষ্ট্র জার্মানি ,জাপান, কাতার, ইজরাইল, আরব আমিরাত ,দক্ষিণ কোরিয়া, পোল্যান্ড, সুইডেন, গ্রিস ও তাইওয়ানে এই মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করা আছে। ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধে এটি মোতায়েন করা হয়েছিল।
প্যাট্রিয়ট মিসাইলের বাইরে যে আরো দুটি সর্বাধুনিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম রয়েছে তার মধ্যে আছে এস-ফোর হানড্রেড মিসাইল। রাশিয়ার তৈরি এই মিসাইল সিস্টেম একসাথে ৭২ টার্গেটে আঘাত হানতে পারে। এই ক্ষেপণাস্ত্রটি স্থল থেকে বাতাসে নিক্ষেপনযোগ্য বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক অস্ত্র হিসাবে বিবেচিত হয়। এই সিস্টেম বিমান, ক্রুজ মিসাইল এবং এমনকি পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রকেও চারশ কিলোমিটার দূর থেকে ধ্বংস করতে পারে। মিসাইলটিতে তিনটি প্রধান জিনিস রয়েছে- মিসাইল লঞ্চার, শক্তিশালী র্যাডার এবং কমান্ড সেন্টার। এতে যে রাডারটি রয়েছে তার সর্বেোচ্চ পাল্লা ৬০০ কিলোমিটার। S-400 শত্রুর সমস্ত রকম এয়ার স্ট্রাইক ধ্বংস করতে পারে । সহজেই যে কোন ধরণের অতি আধুনিক ফাইটার প্লেনের মোকাবিলা করতে পারে। আর তৃতীয় যে শক্তিশালী মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম রয়েছে সেটা হলো আয়রন ডোম ; যা ইজরাইলের হাতে রয়েছে। তবে তিনটির মধ্যে সবচেয়ে সেরা এস-৪০০। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ ও কারিগরি সহায়তায় তৈরি করা হয় আয়রন ডোম।
যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম প্রজন্মের ফাইটার বিমান হলো- এফ-থার্টি ফাইভ স্টিলথ বিমান। যে কয়টি দেশ মিলে এই ফাইটার বিমান তৈরিতে চুক্তিবদ্ধ ছিল, তাদের একটি হলো তুরস্ক। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো ১৪০ কোটি মার্কিন ডলার অর্থ নিয়েও এফ-৩৫ স্টিলথ জেট বিমান তুর্কিদের কাছে হস্তান্তরে গড়িমসি করছে যুক্তরাষ্ট্র। তুরস্ক রাশিয়ার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ব্যবহার করুক, সে ব্যাপারে ঘোর আপত্তি আছে যুক্তরাষ্ট্রের। দেশটির কথায়, এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এফ–৩৫–এর জন্য হুমকি। তবে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি কানে তুলতে নারাজ। যার প্রমাণ এরদোয়ানের নতুন হুংকার।
সোহেল রানা: লেখক, সাংবাদিক ও রাজনোটিশ অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক।
সান নিউজ/এনএএম