আলিম আল রশিদ
বঙ্গভঙ্গ, ১৯০৫ লর্ড কার্জন ১৮৯৮-১৯০৫ সাল পর্যন্ত ভাইসরয় থাকাকালীন সময়ে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়। এটি আধুনিক বাংলার ইতিহাসে অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। বঙ্গভঙ্গের ধারণা কার্জনের স্বকীয় চিন্তা থেকে উদ্ভূত হয়নি। ১৭৬৫ সাল থেকে বিহার ও উড়িষ্যা সমন্বয়ে গঠিত বাংলা ব্রিটিশ ভারতের একটি একক প্রদেশ হিসেবে বেশ বড় আকার ধারণ করেছিলো।
এর ফলে প্রদেশটির প্রশাসনকার্য পরিচালনা নানাভাবে দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে এবং দুটি অংশের মধ্যে সুযোগ-সুবিধার প্রচণ্ড বৈষম্য দেখা দেয়। অনেক চিন্তাভাবনার পরে এজন্য এটিকে বিভক্ত করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরকে ১ লাখ ৮৯ হাজার বর্গ মাইল এলাকা শাসন করতে হতো এবং ১৯০৩ সাল নাগাদ প্রদেশটির জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৭ কোটি ৮৫ লক্ষে দাঁড়ায়।
এর ফলস্বরূপ পূর্ব বাংলার অনেকগুলি জেলা কার্যত বিচ্ছিন্ন এবং অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সাহায্য-সহযোগিতা উন্নয়ন এবং অবকাঠামো নির্মাণসহ নানাভাবে অবহেলিত ছিলো। ফলে এতদঞ্চলের সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। একমাত্র কলকাতা ও এর নিকটস্থ জেলাসমূহ সরকারের সকল কর্মশক্তি ও মনোযোগ আকৃষ্ট করে। অনুপস্থিত ভূস্বামীদের দাবি ও জোর করে আদায়কৃত খাজনার ভারে চাষিদের অবস্থা ছিল দুর্দশাগ্রস্ত; এবং ব্যবসায়, বাণিজ্য ও শিক্ষা ছিলো সবচেয়ে অবহেলিত।
প্রদেশের প্রশাসনিক যন্ত্রকে প্রয়োজন অপেক্ষা কমসংখ্যক কর্মচারী নিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে হতো। বিশেষত নদ-নদী ও খাঁড়িসমূহ দ্বারা অত্যধিক বিচ্ছিন্ন পূর্ববাংলার গ্রামাঞ্চলে পুলিশী কাজ চালানো অসুবিধাজনক হয়েছিলো।
এছাড়া উনিশ শতকের শেষ দশক পর্যন্ত সেখানে প্রশাসন এবং সরকারের কোনো প্রকার আলাদা মনোযোগ প্রদান করা হয়নি। জলপথে সংঘবদ্ধ জলদস্যুতার অত্যাচার নির্যাতন-নিপীড়ন লুণ্ঠন, হত্যা অন্তত এক শতাব্দীকাল বিদ্যমান ছিলো।
প্রশাসনিক প্রতিবন্ধতাসমূহের পাশাপাশি দুর্ভিক্ষ, প্রতিরক্ষা অথবা ভাষাগত সমস্যাবলি সরকারকে প্রশাসনিক সীমানা নতুন করে নির্ধারণের ব্যাপারে বিবেচনা করে দেখতে প্রণোদিত করে।
বাংলার প্রশাসনিক এককসমূহকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করার প্রচেষ্টা মাঝে মধ্যে নেওয়া হয়েছিলো। ১৮৩৬ সালে উত্তরাঞ্চলের প্রদেশগুলিকে বাংলা থেকে পৃথক করে একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে ন্যস্ত করা হয়।
১৮৫৪ সালে সপরিষদ গভর্নর জেনারেলকে সরাসরি বাংলার প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং প্রদেশটির শাসনভার একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের ওপর অর্পণ করা হয়।
১৮৭৪ সালে চিফ কমিশনারশিপ গঠনের মানসে (সিলেটসহ) বাংলা থেকে আসাম বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং ১৮৯৮ সালে লুসাই পাহাড়কে এর সাথে যোগ করা হয়।
বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবসমূহ ১৯০৩ সালে প্রথম বিবেচনা করা হয়।
কার্জনের প্রারম্ভিক কর্ম-পরিকল্পনা প্রশাসনিক কার্যকারিতার ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো। মূল বিভক্তি-পরিকল্পনার বিরুদ্ধে উচ্চৈঃস্বরে প্রতিবাদ ও প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া চলাকালীন সময়ই সম্ভবত বাংলায় এরূপ ব্যবস্থা গ্রহণের সম্ভাব্য সুবিধাদির ব্যাপারটি কর্মকর্তাবৃন্দ প্রথমে মনশ্চক্ষে প্রত্যক্ষ করেন।
আদিতে প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িকতা নয় বরং ভৌগোলিক ভিত্তিতে বাংলাকে বিভক্ত করা হয়। এ ব্যাপারে ‘রাজনৈতিক বিবেচনাসমূহ’ ছিলো বোধ হয় ‘অনুচিন্তা’। সরকারের তরফ থেকে যুক্তি ছিলো যে, বঙ্গভঙ্গ ছিলো তিনটি প্রধান উদ্দেশ্যসম্বলিত অধিমিশ্রভাবে গৃহীত একটি প্রশাসনিক কার্যসাধনের উপায়।
প্রথমত, এর উদ্দেশ্য ছিলো বাংলা সরকারের প্রশাসনিক দায়িত্বের কিয়দংশ উপশম এবং প্রত্যন্ত জেলাসমূহে অধিক দক্ষ প্রশাসন নিশ্চিত করা।
দ্বিতীয়ত, অনগ্রসর আসামকে (চিফ কমিশনার কর্তৃক শাসিত) যাতে সাগরে নির্গমপথ প্রদান করা যায় এরূপভাবে এক্তিয়ার বৃদ্ধি করার মাধ্যমে তার উন্নতি বিধান করা।
তৃতীয়ত, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত উড়িয়া-ভাষাভাষী জনগণকে একক প্রশাসনের অধীনে একত্রিত করা। অধিকন্তু, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাগুলিকে বাংলা থেকে পৃথক এবং আসামের সাথে সংযুক্ত করার প্রস্তাবও ছিলো। অনুরূপভাবে ছোট নাগপুরকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে মধ্যপ্রদেশের সাথে যুক্ত করার কথা বলা হয়েছিলো।
সরকারের প্রস্তাবসমূহ ১৯০৪ সালের জানুয়ারি মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয় এবং তার ওপর জনমত নিরূপণের উদ্দেশ্যে কার্জন ১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ব বাংলার জেলাগুলি সফর করেন। তিনি বিভিন্ন জেলার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে আলোচনা করেন।
বিভক্তির ব্যাপারে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে বিশাল জনসমাবেশে বক্তৃতা দেন। এ সফরকালেই তিনি একটি বিস্তৃত কর্ম-পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।
এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে আইন পরিষদ, স্বতন্ত্র রাজস্ব কর্তৃত্ব ও একটি পরিপূর্ণরূপে সজ্জিত প্রশাসনকে ন্যায্য প্রতিপন্ন করতে পারে এমন ভূখণ্ড নিয়ে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ নতুন প্রদেশ সৃষ্টি।
সম্প্রসারিত কর্ম-পরিকল্পনাটি আসাম ও বাংলা সরকারদ্বয়ের সম্মতি লাভ করে। নতুন প্রদেশটি গঠিত হবে পার্বত্য ত্রিপুরা রাজ্য, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও রাজশাহী (দার্জিলিং বাদে) বিভাগসমূহ এবং মালদা জেলাকে আসামের সাথে একত্র করে।
বাংলাকে যে শুধু পূর্বদিকে এ বৃহৎ ভূখণ্ডসমূহ ছেড়ে দিতে হবে তাই নয়, তাকে হিন্দি-ভাষাভাষী পাঁচটি রাজ্যও মধ্যপ্রদেশকে ছেড়ে দিতে হবে। পশ্চিম দিকে সম্বলপুর এবং মধ্যপ্রদেশ থেকে উড়িয়া-ভাষাভাষী পাঁচটি রাজ্যের সামান্য ভূখণ্ড বাংলা লাভ করবে।
বাংলার নিজের দখলে যে ভূখণ্ড থেকে যায় তার আয়তন ১ লাখ ৪১ হাজার ৫৮০ বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা পাঁচ কোটি চল্লিশ লক্ষ, যাদের মধ্যে চার কোটি বিশ লক্ষ হিন্দু বাকি মাত্র নব্বই লক্ষ মুসলমান।
নতুন প্রদেশটি অভিহিত হবে ‘পূর্ব বাংলা ও আসাম’ নামে, যার রাজধানী হবে ঢাকা এবং অনুষঙ্গী সদর দফতর চট্টগ্রামে। এর আয়তন হবে ১ লাখ ৬ হাজার ৫৪০ বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা হবে এক কোটি আশি লক্ষ মুসলমান ও এক কোটি বিশ লক্ষ হিন্দু সমবায়ে মোট তিন কোটি দশ লক্ষ।
এর প্রশাসন গঠিত হবে একটি আইন পরিষদ ও দুই সদস্যবিশিষ্ট একটি রাজস্ব বোর্ড নিয়ে। কলকাতা হাইকোর্টের এক্তিয়ারকে বজায় রাখা হয়। সরকার নির্দেশ করে দেয় যে, নতুন প্রদেশটির স্পষ্টরূপে চিহ্নিত পশ্চিম সীমানা। সঠিকভাবে নির্ধারিত ভৌগোলিক, জাতিগত, ভাষাগত ও সামাজিক বৈশিষ্ট্যাবলি থাকবে। নতুন প্রদেশটির সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো যে, এটা এর নিজস্ব চৌহদ্দির মধ্যে এ যাবৎ বাংলার তুচ্ছ ও অবহেলিত প্রতিনিধিত্বমূলক সমপ্রকৃতির মুসলমান জনগণের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিবে।
অধিকন্তু, সমগ্র চা শিল্প (দার্জিলিং বাদে) এবং পাট উৎপাদনকারী এলাকার বৃহদংশ একক প্রশাসনের অধীনে নিয়ে আসা হবে। ১৯০৫ সালের ১৯ জুলাই তারিখের একটি সিদ্ধান্তে ভারত সরকার তার চূড়ান্ত সঙ্কল্প ঘোষণা করে এবং ঐ একই বছরের ১৬ অক্টোবর তারিখে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়।
১৯০৩ সালের শেষ দিকে মূল প্রস্তাবাবলি প্রকাশিত হলে তা অভূতপূর্ব বিরোধিতার উদ্রেক করে, বিশেষত প্রভাবশালী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হিন্দুদের মাঝে। প্রস্তাবিত ভূখণ্ডগত বিন্যাস বিরাজমান স্বার্থযুক্ত দলসমূহের ওপর আঘাত হানে এবং ফলস্বরূপ তাদেরকে এর বিরোধিতায় প্ররোচিত করে।
কলকাতার আইনব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করে যে, নতুন প্রদেশ সৃষ্টির অর্থ হবে ঢাকায় আপিল কোর্টের প্রতিষ্ঠা এবং তাদের নিজস্ব হাইকোর্টের গুরুত্ব হ্রাস। সাংবাদিকদের ভয় ছিলো যে, স্থানীয় সংবাদপত্রসমূহ প্রকাশিত হলে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রগুলির প্রচার-সংখ্যা সীমিত হয়ে পড়বে।
কলকাতার ব্যবসায়ী সম্প্রদায় মনশ্চক্ষে অবলোকন করছিলো যে, তাদের ব্যবসায়-বাণিজ্য কলকাতা থেকে যৌক্তিকভাবে অধিকতর নিকটবর্তী ও সুলভ বন্দর চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত হবে।
পূর্ব ও পশ্চিম উভয় বাংলায় বিরাট ভূ-সম্পত্তির অধিকারী জমিদারগণ আগেভাগে বুঝতে পেরেছিলেন যে, ঢাকায় আলাদা জীবনযাত্রা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে, যার অর্থ অতিরিক্ত খরচের বোঝা বহন করতে হবে।
শিক্ষিত বাঙালি হিন্দুরা অনুভব করে যে, এটা ছিলো বাংলা-ভাষাভাষী জনগণের জাতীয় সচেতনতা ও ক্রমবর্ধমান সংহতির ওপর কার্জনের হানা সুচিন্তিত আঘাত। বাংলার অধিকাংশ বাণিজ্য ও বিভিন্ন পেশাজীবীদের নিয়ন্ত্রণকারী এবং গ্রাম্যসমাজে নেতৃত্ব দানকারী হিন্দুগণ মত প্রকাশ করে যে, বাঙালি জাতি বিভক্ত হয়ে যাবে। সম্পূর্ণ বিহার ও উড়িষ্যা অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে বাংলাপ্রদেশেও তারা সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে।
তারা অভিযোগ তোলে যে, এটা ছিলো বাংলায় জাতীয়তাবাদী চেতনাকে শ্বাসরূদ্ধ করতে কার্জনের গোপন প্রচেষ্টা। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করত যে, শিক্ষিত হিন্দু সম্প্রদায়ের অতি দ্রুত বর্ধনশীল শক্তিমত্তাকে ব্যাহত করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। যাতে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে পূর্ব বাংলার মুসলিম প্রভাব বাড়ানোকে উৎসাহিত করা সরকারের প্রধান লক্ষ্য ছিলো। তাই মুসলমানদের কোণঠাসা করে রাখতে এ বিভক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধকে তীব্রতর করতে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক স্বার্থসমূহ একত্রে জোট বেঁধেছিলো তখন।
শুরু থেকেই ভারতীয়, বিশেষত বাংলার, প্রচারযন্ত্র বিভক্তির পদক্ষেপের বিরোধিতা করে আসছিলো। ব্রিটিশ ও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান প্রচারযন্ত্র, এমনকি কিছুসংখ্যক সরকারি প্রশাসকও পরিকল্পিত বিধানটির বিরোধিতা করে। বিভক্তির বিষয়টি পশ্চিম বাংলায়, বিশেষত কলকাতায়, সকল বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে প্রচণ্ড প্রতিবাদ জাগিয়ে তোলে এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে নতুন প্রেরণা দান করে। অতঃপর ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের ওপর বর্তায়।
কংগ্রেস অস্বাভাবিক কর্মশক্তি ও দৃঢ়তা প্রদর্শন করে এবং মধ্যবিত্তশ্রেণীর চাপ প্রয়োগকারী সঙ্ঘ থেকে এটি দেশব্যাপী সাধারণ জনতার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ বঙ্গভঙ্গকে ‘বিভক্তিকরণের মাধ্যমে শাসন’-এর প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সোচ্চার আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করে। জাতীয় কংগ্রেস মনে করে স্পষ্টভাষী ‘ভদ্রলোক’ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি সরকারের প্রতিহিংসাপরায়ণ বিদ্বেষের প্রমাণ হিসেবে তা গণ্য করেছেন। মাতৃদেবীর পূজারী বাঙালি হিন্দুরা বিশ্বাস করত যে, বিভক্তি তাদের ‘মাতৃসম প্রদেশের’ অঙ্গব্যবচ্ছেদ সদৃশ।
এরপর ‘বন্দে মাতরম্’ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস-এর নিকট প্রায় জাতীয় সংগীতের রূপ পরিগ্রহ করে। বিভক্তিকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করা বাঙালি জাতীয়তাবাদের আশু লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। বিভক্তির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও একের পর এক সাধারণ জনতার বিশাল সমাবেশ, গ্রামাঞ্চলে উত্তেজনা এবং ব্রিটিশদের তৈরি জিনিসপত্র বর্জন আন্দোলনের মাধ্যমে তা একে একে প্রকাশ পায়। দেশী পণ্যের ব্যবহার ও বিদেশী দ্রব্য বর্জন ছিল এ জাতীয়তাবাদের দুটি অস্ত্র। এবং স্বরাজ অর্জন ছিলো এর প্রধান উদ্দেশ্য। স্বরাজের কথা প্রথমবারের মতো ১৯০৬ সালে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে দলের লক্ষ্য হিসেবে দাদাভাই নৌরোজীর সভাপতির ভাষণে উল্লিখিত হয়।
সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর মতো নেতৃবৃন্দ এবং তাঁদের সাথে সঞ্জীবনীর (১৩ জুলাই, ১৯০৫) সম্পাদক কৃষ্ণকুমার মিত্রের মতো সাংবাদিকগণ ব্রিটিশ জিনিসপত্র বর্জন, এমনকি শোক পালন ও সরকারি অঙ্গ-সংগঠনগুলির সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য জনগণকে উদ্দীপ্ত করেন। ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতায় অনুষ্ঠিত এক সভায় যতদিন পর্যন্ত ‘বিভক্তির সঙ্কল্প প্রত্যাহার করা না হয়’ ততদিন পর্যন্ত ব্রিটিশ দ্রব্যাদি ক্রয় করা থেকে বিরত থাকা সম্পর্কিত একটি সিদ্ধান্ত তুমুল করতালির মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়। এ জাতীয় চেতনাটিকে ডি.এল রায়, রজনীকান্ত সেন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর দেশাত্মবোধক গানের মাধ্যমে জনপ্রিয় করে তোলা হয়। ঐ সময়কার অন্যান্য রাজনৈতিক আন্দোলনের মতো এটিও ধর্মীয় আবেদন লাভ করে।
এ উপলক্ষটির সমারোহপূর্ণ সহজাত বৈশিষ্ট্যের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য বিশেষ পূজা-অর্চনার প্রচলন করা হয়। হিন্দুদের উৎসাহের আতিশয্য চরম আকার ধারণ করে ১৯০৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মহালয়ার দিন, অর্থাত পূজার পূর্বে নবচন্দ্রের দিন। হাজার হাজার হিন্দু কলকাতার কালী মন্দিরে সমবেত হয়। বাংলায় শিবের পত্নী কালীর উপাসনা সর্বদাই অত্যন্ত জনপ্রিয়। সৃষ্টিধর ও ধ্বংসাধনকারী এ উভয় সত্ত্বার মিশ্রণে তিনি দ্বৈত চরিত্রের অধিকারী বলে সুবিদিত। যুগপৎভাবে তিনি রক্তাক্ত বলিদানে অতিশয় আনন্দ পেতেন। কিন্তু বাংলাকে মাতৃভূমি হিসেবে কল্পনা করে বৃহৎ মাতা হিসেবে তাকে শ্রদ্ধা নিবেদনও করা হতো।
এ ধরনের কল্পনাপ্রসূত দৃষ্টিভঙ্গি তখন ধর্মীয় উন্মাদনাময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যাবলির প্রতি সমর্থন আদায় করতে শক্ত ভিত্তির জিগির তুলে আন্দোলনের রসদ জোগাত। কালীকে মাতৃভূমির প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে পুরোহিত স্বদেশী ব্রত পাঠ করাতেন। এ রকম ধর্মীয় উদ্দীপনা সাধারণ হিন্দু জনতাকে ব্যাপকভাবে নাড়া দিত। কিন্তু এর বিপরীতে ঐ উন্মাদনা সাধারণ মুসলমানদের চেতনায় প্রতিকূল মনোভাব জাগিয়ে তুলত। অর্থনৈতিক আন্দোলন হিসেবে স্বদেশী আন্দোলন মুসলমানদের নিকট অনেকটা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু যেহেতু এ আন্দোলনকে বাংলার বিভক্তির যেটাকে কেবল এ অনুন্নত এলাকার বৃহৎ সংখ্যক মুসলমান সমর্থন করেছে। তাই এর বিরুদ্ধে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং যেহেতু এটাকে প্রায়শ ধর্মীয় অবয়ব দেওয়া হয়েছে।
তাই সেহেতু এটা মুসলিম মানসকে শত্রুভাবাপন্ন করে তোলে। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বাংলায় জাতীয় ভাবপ্রবণতার সাথে মিলিত হয়ে কংগ্রেসে যে নতুন জোয়ারের সূচনা হয়, তাতে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে যেমন, পাঞ্জাব, মধ্যপ্রেদেশ, পুনা, মাদ্রাজ, বোম্বে ও অন্যান্য নগরেও তা উপচে পড়ে। বিদেশে তৈরি পোশাক পরিধানের পরিবর্তে ভারতীয়রা শুধুমাত্র ভারতে তৈরি স্বদেশি তুলা ও অন্যান্য উপাদানে তৈরি কাপড় ব্যবহারের ব্রত নেয়। বিদেশি সাজসরঞ্জামকে ঘৃণিত আমদানি বলে গণ্য করা হয়। স্বদেশি আন্দোলনটি অতি তৎপরতার সাথে অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় উদ্যোগকে উদ্দীপিত করে।
কাপড়ের মিল থেকে শুরু করে দিয়াশলাই কারখানা, কাচ গলিয়ে জিনিসপত্র তৈরির দোকান, লোহা ও ইস্পাতের ঢালাই কারখানা স্থাপিত হয়। তুমুল আন্দোলন জাতীয় শিক্ষার ব্যাপারে বর্ধিত দাবিও সৃষ্টি করে। বাঙালি শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দ ও ছাত্র-ছাত্রীরা ব্রিটিশ জিনিসপত্র বর্জনকে ইংরেজি স্কুল ও কলেজের শ্রেণিকক্ষসমূহে পর্যন্ত বিস্তৃত করে। জাতীয় শিক্ষার জন্য আন্দোলন সমগ্র বাংলাব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। তা এমনকি, বারাণসীর মতো দূরবর্তী স্থানেও পৌঁছে, যেখানে পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য ১৯১০ সালে তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগে বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
বাংলার ছাত্র সম্প্রদায় জাতীয়তাবাদের ডাকে প্রবল আগ্রহ নিয়ে সাড়া দেয়। স্বদেশী ও বর্জনের প্রচার-অভিযানে ছাত্র-ছাত্রীরা, যাদের মধ্যে স্কুলের ছেলেরাও অন্তর্ভুক্ত, দলবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করে। তাদের দমন করার উদ্দেশ্যে সরকার কুখ্যাত কার্লাইল ইশতাহার প্রণয়ন করে। ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দ উভয়ই এ উৎপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিরুদ্ধে জোরালোভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এবং এ প্রতিবাদ ছিল প্রায় সর্বজনীন। প্রকৃতপক্ষে এ প্রতিবাদ আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলায় প্রথম সুসংগঠিত ছাত্র আন্দোলনের বীজ উপ্ত হয়। এর সাথে সাথে সোৎসাহে সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ায় উম্মুখ ছাত্র-সংগঠন ‘ইশতাহার-বিরোধী সমাজ’ও জন্মলাভ করে। বিভক্তি-বিরোধী বিক্ষোভ প্রারম্ভিক পর্যায়ে ছিলো শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক, কিন্তু যখন এটা প্রতিভাত হয় যে, এটা আকাঙ্ক্ষিত ফল বয়ে আনছে না, তখন প্রতিবাদ আন্দোলনটি যুদ্ধংদেহী নেতৃবৃন্দের হাতে চলে যায়।
তাদের উদ্দেশ্য সফল করে তোলার জন্য বর্জন ও সন্ত্রাসের দুটি কৌশল প্রয়োগের কথা চিন্তা করা হয়। এর পরিণতিস্বরূপ রাজনীতিতে টেনে আনা যুবা প্রজন্ম নির্বিচারে আগ্নেয়াস্ত্র, পিস্তল ও বোমা ব্যবহারের মাধ্যমে সন্ত্রাসী পদ্ধতি অবলম্বন করে। ফলে আন্দোলনটি নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার দিকে মোড় নেয়। সরকারের প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরকে কয়েকটি গোপন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় এবং স্যার এন্ড্রু ফ্রেজারসহ অনেক কর্মকর্তার জীবননাশের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। সন্ত্রাসী আন্দোলনটি অচিরে স্বদেশী বিক্ষোভের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়।
বাংলায় যেভাবে ১৯০৮ থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত সন্ত্রাসবাদ উচ্চ শিখরে পৌঁছে, সেভাবে সরকারি পীড়ন ও ‘নিবৃত্তিমূলক আটক’ আইনে গ্রেফতারের সংখ্যা ভীষণভাবে বৃদ্ধি পায়। নতুন যুদ্ধংদেহী চেতনাটি বন্দে মাতরম্, সন্ধ্যা, যুগান্তর প্রভৃতি জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রের কলামগুলিতে প্রতিফলিত হয়েছে। বিপ্লবী ধারণাসমূহ প্রচার করার ব্যাপারে মুদ্রণশিল্প প্রভূতভাবে সাহায্য করেছে। ১৯০৭ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনে সংগঠনটি দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যা। এর একটির অনুসারীরা ছিল মধ্যপন্থী, উদার ও বিবর্ধনপন্থী এবং অপরটির সমর্থনকারীরা ছিল চরমপন্থী, যুদ্ধংদেহী ও বিপ্লবী।
বালগঙ্গাধর তিলকের চরমপন্থী দলের সংগ্রামপ্রবণ যুবাগণ ‘বোমা ও বন্দুকের পূজা-অর্চনা’-কে সমর্থন করত। অন্যদিকে গোপালকৃষ্ণ গোখলে ও সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর মতো মধ্যপন্থী নেতৃবৃন্দ এ রকম চরমপন্থী কার্যাবলির বিরুদ্ধে সকলকে সতর্ক করে দেন। উনারা বলেন যে, এটা সম্পূর্ণ নৈরাজ্য ও অনিয়ন্ত্রণযোগ্য হিংস্রতার পথ প্রশস্ত করতে পারে। বিভক্তি-বিরোধী বিক্ষোভের প্রথম-সারির অন্যতম নেতা হওয়া সত্ত্বেও সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী সন্ত্রাসী কার্যাবলির কখনো পক্ষপাতী ছিলেন না। ১৯০৩ সালে বিভক্তির প্রস্তাবটি প্রথম প্রকাশিত হলে এ কর্ম-পরিকল্পনার প্রতি মুসলমানদের প্রতিবাদ অভিব্যক্ত হয়। মোসলেম ক্রনিকল পত্রিকা, সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন, কাজেমুদ্দীন আহমেদ সিদ্দিকী ও দেলওয়ার হোসেন আহমেদ প্রস্তাবিত ব্যবস্থাটির নিন্দা করে। প্রারম্ভিক পর্যায়ে এমনকি নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহ ও উত্থাপিত বিষয়টিকে ‘জঘন্য’ বলে অভিহিত করেন। শুরুতে মুসলমানদের দিক থেকে প্রধান সমালোচনা ছিল কুসংস্কারাদি থেকে মুক্ত ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রসর বাংলা প্রদেশটির কোন অংশ চীফ কমিশনারের শাসনের অধীনে চলে যাবার বিরুদ্ধে।
তারা উপলব্ধি করেছিলো যে, এর ফলে তাদের শিক্ষাগত, সামাজিক ও অন্যান্য স্বার্থ বিঘ্নিত হবে। তবে এর বিপরীতে তাদের অনেকেই অনুভব করেছিলো যে, প্রস্তাবিত ব্যবস্থাটি বাঙালি সংহতি ব্যাহত করবে। মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ চরমপন্থী সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের ধারণাকে ইসলামের চেতনার বিরোধী বলে সমালোচনা করেন। মুসলিম পত্র-পত্রিকা শিক্ষিত সমধর্মীদের সরকারের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার সনির্বন্ধ অনুরোধ জানায়। মোটের ওপর হিন্দুদের মতো স্বদেশী প্রচার করা পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মুসলমান জনতাকে প্রভাবিত ও সক্রিয় করতে সক্ষম হয়নি। মুসলমানদের চিন্তা-ভাবনায় বিভক্তি-বিরোধী প্রবণতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। যখন মুসলমানদের শিক্ষিত অংশ স্বয়ংসম্পূর্ণ আলাদা প্রদেশের ব্যাপকতর কর্ম-পরিকল্পনা জানতে পারলেন তখন তাদের অধিকাংশ শিঘ্রই তাদের মত পরিবর্তন করলেন। তারা স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারলেন যে, বিভক্তি তাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ হবে। এবং এর ফলে মুসলমানদের বিশেষভাবে নির্দিষ্ট অসুবিধাগুলি নতুন প্রশাসনের নিকট থেকে অধিকতর মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারবে।
মুসলমানগণ নতুন লেফটেন্যান্ট-গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলার-কে উষ্ণ সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে। এমনকি মোসলেম ক্রনিকল-এর মতো সংবাদপত্রও অনতিবিলম্বে বিভক্তির পক্ষে মনোভাব পরিবর্তন করে। কলকাতার কিছুসংখ্যক মুসলমানও নতুন প্রদেশটির সৃষ্টিকে স্বাগত জানায়। মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি ১৯০৫ সালে সাতজন নেতৃস্থানীয় মুসলমান ব্যক্তিত্ব কর্তৃক স্বারিত একটি প্রকাশ্য লিখিত ঘোষণা বের করে। ঘোষণাটি পশ্চিম ও পূর্ব উভয় বাংলার বিভিন্ন মুসলমান সোসাইটিগুলির নিকট বিলি করা হয়। এবং এর মাধ্যমে বিভক্তি ব্যবস্থার প্রতি তাদের শর্তহীন সমর্থন দানের জন্য মুসলমানদের নিকট সনির্বন্ধ অনুরোধ জানানো হয়। নতুন প্রদেশটির সৃষ্টি মুসলমানদেরকে একটি সঙ্ঘবদ্ধ দলে পরিণত করে। এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কিত বিষয়ে তাদের আশা-আকাক্সা তুলে ধরার অভিপ্রায়ে একটি সঙ্ঘ গঠন করতে উৎসাহিত করে। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর ‘মোহামেডান প্রভিন্সিয়াল ইউনিয়ন’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিরাজমান সকল প্রতিষ্ঠান ও সমিতিকে এ নতুন ইউনিয়নটির সাথে নিজেদেরকে অধিভুক্ত করতে আহ্বান জানানো হয় এবং খাজা সলিমুল্লাহকে সর্বসম্মতিক্রমে এর পৃষ্ঠপোষক হিসেবে মনোনীত করা হয়।
তথাপি এক দল শিক্ষিত উদারবাদী মুসলমান ছিল যারা বিভক্তি-বিরোধী বিক্ষোভ ও স্বদেশী আন্দোলন-এর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে। যদিও তাদের সংখ্যা ছিল নগণ্য, তবুও তাদের ভূমিকা মুসলমানদের চিন্তাধারায় নতুন মাত্রা যোগ করে।
এ উদার মনোভাবাপন্ন দলটি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে সমর্থন ও বিভক্তির বিরোধিতা করে। মুসলমানদের মধ্যকার এ ধারার লোকদের মধ্যে সবচেয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন নওয়াব সলিমুল্লাহর সৎ ভাই খাজা আতিকুল্লাহ। কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে (১৯০৬) তিনি বঙ্গভঙ্গকে আনুষ্ঠানিকভাবে বর্জন করে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। আবদুর রসুল, খান বাহাদুর মুহম্মদ ইউসুফ , মুজিবুর রহমান, আবদুল হালীম গজনবী, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মুহম্মদ গোলাম হোসেন। মৌলভী লিয়াকত হোসেন (উদারবাদী মুসলিম যিনি ইংরেজদের ‘বিভক্তির মাধ্যমে শাসন’-এর নীতিকে প্রচণ্ডভাবে বিরোধিতা করেছিলেন), বগুড়ার সৈয়দ হাফিজুর রহমান চৌধুরী এবং বর্ধমানের আবুল কাশেম মুসলমানদের বিভক্তি-বিরোধী বিক্ষোভে যোগদান করতে অনুপ্রাণিত করেন।
ময়মনসিংহের দীন মুহম্মদ ও চট্টগ্রামের আবদুল গাফ্ফারের মতো স্বল্পসংখ্যক মুসলমান এমনকি স্বদেশী ধ্যান-ধারণারও প্রচারক ছিলেন। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, আবদুল হালিম গজনবী ও খান বাহাদুর মুহম্মদ ইউসুফের মতো কিছুসংখ্যক উদার জাতীয়তাবাদী মুসলমান স্বদেশী আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছেন বটে, কিন্তু বিদেশী জিনিসপত্র বর্জনের নিমিত্ত বিক্ষোভকে পৃষ্ঠপোষকতা করেননি। পত্র-পত্রিকার সাথে সংশ্লিষ্ট মুসলমানদের একটি শাখা হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সঙ্গতিপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেছিল। এ. কে ফজলুল হক ও নিবারণচন্দ্র দাশ তাঁদের সাপ্তাহিক পত্রিকা বালক (১৯০১, বরিশাল) ও মাসিক পত্রিকা ভারত সুহৃদ (১৯০১, বরিশাল)-এর মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণা প্রচার করেন। মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের শুধু একটি ক্ষুদ্র শাখা তাঁদের সাম্প্রদায়িকতাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠতে এবং বিভক্তি-বিরোধী বিক্ষোভ ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে কংগ্রেসের সাথে হাত মেলাতে পেরেছেন।
মুসলিম মানসে চিন্তা-ভাবনার সর্বজনীন প্রবণতা ছিল বিভক্তির পক্ষে নওয়াব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে ১৯০৬ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় নিখিল ভারত মুসলিম লীগ। ১৯১০ সালের ইম্পেরিয়াল কাউন্সিলের সভায় বাংলার শামসুল হুদা ও বিহার থেকে মাজহার-উল-হক বিভক্তির পক্ষে বক্তব্য রাখেন।
সনাতন ও সংস্কারবাদী মুসলমান দলসমূহ ফরায়েজী, ওহাবী ও তাইয়ুনি বিভক্তিকে সমর্থন করে। এর পরিণতিস্বরূপ মুসলমানদের রাজনৈতিক মনোভাবে প্রগাঢ় নিষ্ঠার প্রবণতা পরিলতি হয়। বাঙালি মুসলিম পত্র-পত্রিকা সাধারণত বিভক্তির পক্ষে সমর্থন জানায়। ইসলাম প্রচারক পত্রিকা স্বদেশীকে হিন্দু আন্দোলন হিসেবে বর্ণনা করে এবং এটি সাধারণ জনতার জন্য কষ্ট বয়ে আনবে বলে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। সাধারণভাবে মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ এটি তাঁদের সমধর্মীদের যন্ত্রণা-ভোগের কারণ হবে বলে উদ্বিগ্ন হন। বিভক্তি বিরোধী বিক্ষোভের সাথে একই সূত্রে গ্রথিত হওয়ার জন্য তাঁরা ঐ আন্দোলনকে বিশেষভাবে অপছন্দ করতেন। মীর মশাররফ হোসেন-এর মতো প্রসিদ্ধ সাহিত্যিকগণ স্বদেশী আন্দোলনের প্রবল সমালোচক ছিলেন।
যেহেতু এটিকে বিভক্তির বিরুদ্ধে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং এর সাথে ধর্মীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যোগ করা হয়েছে, তাই সকল স্তরের মুসলমানদের বৃহৎ জনতা স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি বিরূপ ছিল। আন্দোলনটির অর্থনৈতিক দিকটি মুসলিম সমাজের স্বতন্ত্রবাদী শক্তিকে উৎসাহিত করে তোলার জন্য আংশিকভাবে দায়ী ছিল। ব্যবসায় ও শিল্প পরিমণ্ডলে হিন্দুদের প্রাধান্য সর্বদা বিরাজমান থাকায় তা মুসলমানদেরকে জাগ্রত করে তোলে।
আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে হিন্দুদের কর্তৃত্ব চলতে থাকার ভীতি মুসলমানদেরকে তাদের নিজেদের স্বার্থসমূহ সংরণের ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়। এ আশঙ্কাসমূহ হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের মাঝে ফাটল ধরায়। হিন্দুদের অর্থনৈতিক শোষণ এড়ানোর উদ্দেশ্যে কিছু সংখ্যক ধনী মুসলমান উদ্যোক্তা ঝুঁকিপূর্ণ নতুন বাণিজ্যিক কর্মপ্রচেষ্টায় প্রবৃত্ত হতে এগিয়ে আসে। এ রকম একটি মহতী প্রচেষ্টা ছিল ১৯০৬ সালে স্টিমার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা যা চট্টগ্রাম ও রেঙ্গুনের মধ্যে চলাচল করত।
বিভক্তির প্রসঙ্গে মুসলিম মানসকে প্রভাবিত করতে বাংলায় ভূমি ব্যবস্থার প্যাটার্ন বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। নিজেদের জমিদারি থেকে অনুপস্থিত হিন্দু জমিদারগণ রায়তদের, যাদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান, ভাগ্যোন্নয়নের কোন প্রচেষ্টা গ্রহণ করেনি। প্রদেশটিতে ইতঃপূর্বে বিরাজমান ভূ-সম্পত্তি সম্পর্কিত বিরোধসমূহও (ভূস্বামী ও প্রজাদের মধ্যে) সাম্প্রদায়িক রূপ নেবে বলে মনে হচ্ছিল। অভিযোগ ছিল যে, হিন্দু ভূস্বামিগণ প্রজাদের উপর স্বদেশী ধ্যান-ধারণা চাপানোর এবং তাদেরকে বিভক্তি-বিরোধী বিক্ষোভে যোগ দিতে প্ররোচিত করার চেষ্টা চালিয়েছিলো।
একটি সম্প্রদায় হিসেবে তাদের আলাদা ব্যক্তিগত পরিচয় জোরালো করার পদক্ষেপ হিসেবে মুসলমানগণ ১৯০৬ সালে ঢাকার কেরানিগঞ্জে একটি ইসলামি সম্মেলনের আয়োজন করে। অন্য সম্প্রদায়ের তরফ থেকে স্বদেশী আন্দোলন তার হিন্দু ধর্মীয় উন্মদনা নিয়ে আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়া বাড়িয়ে তোলে। হিন্দুদের সাথে সম্পূর্ণরূপে সংযোগ ছিন্ন করার সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়ে পূর্ব বাংলা ও আসামের সাধারণ মুসলমান জনতার মাঝে অত্যন্ত উত্তেজনাকর প্রকৃতির একটি লাল পুস্তিকা প্রচার করা হয়। জনৈক ইবরাহিম খানের সম্পাদনায় আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম-এর পৃষ্ঠপোষকতায় এটা প্রকাশিত হয়েছিল।
অধিকন্তু, ‘বন্দে মাতরম্’কে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ অথবা জাতীয় বীর হিসেবে শিবাজীর পূজা প্রচলনের মতো উত্তেজনাকর প্রচারণা এবং সাম্প্রদায়িক হিংস্রতার রিপোর্টসমূহ মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এ ধরনের প্রচারণার একটি অবশ্যম্ভাবী ফল হলো ১৯০৭ সালের মার্চ মাসে সহসা কুমিল্লায় সঙ্ঘটিত দাঙ্গা। এর পরপরই ঐ বছরের এপ্রিল মাসে জামালপুরে অনুরূপ দাঙ্গা বাধে। এ সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলাসমূহ পূর্ব বাংলা ও আসামের সুপরিচিত বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয় এবং তা এমন একটি প্যাটার্ন অনুসরণ করে, অন্যত্র যার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ১৯০৭ সালের দাঙ্গাসমূহ আধুনিক বাংলার ইতিহাসে এক সন্ধিক্ষণ হিসেবে বিবেচিত।
একদিকে যখন হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি ঘটে, অন্যদিকে তখন ভারত সরকারের নীতিতে, এবং যুগপৎভাবে বাঙালি মুসলমান নেতৃবৃন্দের সাথে তাদের অবাঙালি প্রতিপক্ষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরাট গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবর্তন সাধিত হচ্ছিল। পূর্ব বাংলায় সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের ওপর উভয় অগ্রগতিরই বিরাট প্রতিক্রিয়া ছিল। শাসনতান্ত্রিক সংস্কার প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত ১৯০৯ সালের মর্লি-মিন্টো সংস্কার-এর পরিণতি লাভ করে। এটি মুসলমানদের জন্য যে আলাদা প্রতিনিধিত্বের সূত্রপাত করে তা হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ঘটনার নিদর্শনস্বরূপ। লেফটেন্যান্ট গভর্নর থেকে শুরু করে নিুপদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ পর্যন্ত নতুন প্রদেশটির প্রথম দিককার প্রশাসকবৃন্দ সচরাচর উন্নয়নমূলক কার্যাবলি সম্পাদনে প্রবল উদ্যমী ছিলেন।
প্রথম লেফটেন্যান্ট গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলার বিভক্তি-বিরোধী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ কর্তৃক মুসলমানদের প্রতি অতিশয় পক্ষপাতিত্বপূর্ণ ছিলেন বলে অভিযুক্ত হন। ভারত সরকারের সাথে তাঁর মতানৈক্যের কারণে তিনি ১৯০৬ সালের আগস্ট মাসে পদত্যাগ করেন। তাঁর পদত্যাগ ও এর ত্বরিত গ্রহণকে মুসলমানগণ হিন্দুদের জন্য এক বলিষ্ঠ রাজনৈতিক বিজয় বলে গণ্য করে। মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক ধারণা জন্ম যে, বিভক্তি-বিরোধী বিক্ষুব্ধদের চাপের মুখে সরকারের বশ্যতা স্বীকার স্বীয় দুর্বলতাকে প্রকাশ করেছে এবং সরকারের প্রতি মুসলমানদের অটল আনুগত্যকে উপেক্ষা করা হয়েছে। এর পরিণতিস্বরূপ নতুন প্রদেশে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যকার বিরোধ অত্যন্ত তীব্র আকার ধারণ করে। স্বতন্ত্র সাম্প্রদায়িক পরিচয় সম্পর্কে অধিকতর সচেতন মুসলমান নেতৃবৃন্দ তাদের সম্প্রদায়ের বিভিন্ন শাখাকে একত্রিত করার চেষ্টা করেন, যাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে একটি প্রতিপ আন্দোলন সৃষ্টি করা যায়।
তারা গভীরভাবে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং বিশ্বাস করেন যে, বিভক্তির বিরুদ্ধে হিন্দুদের বিক্ষোভ প্রকৃতপে একটি সাম্প্রদায়িক আন্দোলন এবং তাই স্বতন?
লেখাটি তক্ষশীলা হতে সংগৃহীত
সান নিউজ/এফএআর