মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের সংগ্রাম এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যগুলোর মধ্যে যদি একটি এবং এক নম্বর লক্ষ্যকে উল্লেখ করতে হয়, তাহলে সেটা হবে, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থার প্রতিফলন শুধু কেতাবে নয়, সর্বত্র দৃশ্যমান থাকবে।
এর বাস্তব রূপ বহুভাবে দেখা ও বোঝা যায়। ছোট থেকে বড়, রাষ্ট্রের কোনো সংস্থা, অফিস, আদালত ও প্রতিষ্ঠানে এমন কোনো ব্যবস্থা ও নিদর্শন থাকবে না, যার মাধ্যমে মনে হতে পারে কোনো একটি ধর্মকে ছোট বা বড় করা হচ্ছে। কথার কথা হিসেবে বলা যায়, দেশের কোটি কোটি মানুষের ভেতর একটি পরিবার বা একজন মানুষও যদি একটি স্বতন্ত্র ধর্মের হয়ে থাকে, তাহলে সে যেন মনে না করে যে, তার ধর্ম অন্য ধর্মের সঙ্গে সমান মর্যাদা পাচ্ছে না বা ধর্ম পরিচয়ের কারণে তিনি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, শুধু শাসক পরিবর্তন করে কোনো লাভ হবে না। পাঞ্জাবি আর বাঙালি শাসকদের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না, যদি মানসিকতার পরিবর্তন না হয়। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নিম্ম পর্যায় পর্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষতার মূলমন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হলে স্বাধীনতার কোনো উদ্দেশ্যই সাধন হবে না। পাকিস্তান আমাদের বিরুদ্ধে যত শোষণ, নির্যাতন, বৈষম্য, লুণ্ঠন, হত্যা ও গণহত্যা চালিয়েছে, তার সবকিছু করেছে ধর্ম রক্ষার নামে।
পাকিস্তানের সংবিধানে বলা হয় মুসলমান ছাড়া অন্য কাউকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজে বিশ্বাস করা যাবে না। প্রাক-ঐতিহাসিক যুগ থেকে যখনই যে ধর্মকেই রাষ্ট্র ও রাজনীতির মধ্যে আনা হয়েছে তখন মানব সমাজ, সভ্যতা, অগ্রগতি, সমৃদ্ধি, মানববন্ধন ও মানবভ্রাতৃত্ব, শুধু ক্ষতিগ্রস্ত নয়; সংঘাত, সংঘর্ষ এবং যুদ্ধ-বিগ্রহে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে, কোটি কোটি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। কারণ, পক্ষ-বিপক্ষের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে রাজনীতির মহৎ উদ্দেশ্য যখন পদদলিত হয়, তখন রাজনীতির মধ্যে ধর্ম থাকলে পবিত্র ধর্মও পদদলিত হয়, আর সেটাই হয় সবচেয়ে বড় অপধর্ম এবং ধর্মের চরম অবমাননা। দুনিয়াদারির কোনো মঙ্গলের কথা নয়, অলীক অন্ধবিশ্বাসের স্বপ্নে মানুষকে বিভোর ঘোরের মধ্যে ফেলে বকধার্মিক রাজনৈতিক ব্যক্তি ও পক্ষ ক্ষমতা দখল এবং দুনিয়ার সব ভোগ, বিলাস, লালসায় লিপ্ত হয়। ভণ্ডামি এবং প্রতারণাই হয়ে ওঠে রাজনীতির প্রধান অবলম্বন। ধর্মের পবিত্রতা চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়।
সব ধর্মেরই বকধার্মিক রাজনীতিকেরা ভাল করে জানেন, বৃহত্তর জনমানুষের মঙ্গল, কল্যাণ ও উন্নতি সাধন এবং সন্তুষ্ট করে,তাদের সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা অথবা যাওয়া অত্যন্ত কঠিন কাজ। রাজনীতির বাস্তবতা হলো, জনগণ আজ যাদের ওপর সন্তুষ্ট, কাল তাদের ওপর অসন্তুষ্ট। আর বাঙালি মানসিক চরিত্র আরও ভঙ্গুর ও ক্ষণস্থায়ী। সকালে যাকে মাথায় নিয়ে নাচে, বিকেলেই তাকে বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপ করে। তাই ইসলাম ধর্মীয় রাজনীতির মূল প্রবক্তা, ওয়াহাবিতন্ত্র এবং তার প্রধান বাহক ব্রাদারহুড ও জামায়াতের কথাই হলো, ইসলামে গণতন্ত্র হারাম অর্থাৎ নিষিদ্ধ। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক রসুলে করিম মহানবীর (স.) জীবন দর্শনের গভীর বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করেননি। তিনি মৃত্যুর আগে তাঁর পরবর্তী প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়ে যাননি। নবী (স.) এর মৃত্যুর পর সব সাহাবিগণ আলোচনা করে হযরত আবু বকরকে (রা.) ইসলামের প্রথম খলিফা নিযুক্ত করেন। ওই সময়ে সবাই আলোচনা করে খলিফা নির্বাচনই ছিল যুগান্তরের পরিক্রমায় আজকের আধুনিক গণতন্ত্রের প্রতীক। তারপরেও খলিফা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। খলিফা নিযুক্তির মতবিরোধ এবং অন্যান্য মতানৈক্যের পরিণতিতে ইসলামের চারজন মহান খলিফার মধ্যে তিনজনই আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন। সে সব ঘটনার সূত্রেই ইসলাম ধর্মের মধ্যে শিয়া-সুন্নির চরম বিভাজন ঘটেছে, যার জের ধরে অন্তঃধর্মীয় সংঘাত সংঘর্ষে অনবরত রক্ত ঝরছে।
ইসলামের মূল কথা শান্তি, আজ কোথাও নেই। অধিকন্তু শিয়া-সুন্নির বিভাজনের সুযোগ নিচ্ছে বিশ্বের ভূ-রাজনীতির প্রধান খোলোয়াড়গণ। প্রায় সব মুসলমান দেশে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে যেভাবে দীর্ঘস্থায়ী রক্তক্ষরণ হচ্ছে তা অন্য কোনো জায়গায় হচ্ছে না। শুধু ইসলাম ধর্মে নয়, চরমধর্মান্ধতা এবং রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার অন্যান্য বড় ধর্মগুলোর মধ্যে একইভাবে বিদ্যমান। অরিজিনাল স্ক্রিপ্ট অনুসারে সব ধর্মের মৌলিক কথা হলো শান্তি, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, মানবভ্রাতৃত্ব এবং ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’, এটাই দর্শন। কিন্তু ধর্মকে রাজনীতির মধ্যে নিয়ে আসায় সব ধর্মেরই বিকৃতি ও বিচ্যুতি ঘটেছে। তারপর সব ধর্মেরই বৃহত্তর মানুষ নিজ নিজ জীবন সংগ্রামে এতই ব্যস্ত থাকে, ধর্মের মৌলিকত্ব ও সময়োপযোগিতার যৌক্তিকতা অনুসন্ধানের সময় তারা পায় না। সঙ্গত কারণেই নির্ভর করতে হয় অল্প শিক্ষিত, স্বল্পজ্ঞানের লেবাসধারী ধর্মীয় শিক্ষক এবং ধর্মীয় রাজনীতিতে লিপ্ত স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিবর্গের ওপর। এরা হীন ক্ষুদ্র স্বার্থ উদ্ধারে প্রলুব্ধ হয়ে ধর্মের মনগড়া ব্যাখ্যা দেয়। সে কারণেই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘মানুষ’ কবিতায় বলেছেন-
‘‘তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী।
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী।
হায়রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়ে ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়।”
আসলে ধর্মে কোনো সমস্যা নেই। ধর্মকে রাজনীতিতে আনার জন্যেই সব সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ সংগ্রামের বাঁকেবাঁকে চরম তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে রাজনীতি ও ধর্মের এই কঠিন বাস্তব সত্যকে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি একবার বলেছিলেন রাষ্ট্রকে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত করতে না পারলে স্বাধীনতা রক্ষা করা যাবে না। সুতরাং স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে এবং ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার স্বার্থে, পরিপূর্ণ বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতির দর্শনে বাংলাদেশকে একটি আধুনিক এবং সর্বগ্রহণযোগ্য সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য মৌলিক আদর্শ হিসেবে সংবিধানে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতাকে সন্নিবেশিত করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় আসা দুই সামরিক শাসক সব শেষ করে দিলেন। তারা ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করলেন, ধর্মীয় রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনলেন। একটি ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম করায় চরম বৈষম্যের প্রতীক হিসেবে অন্য সব ধর্মের জনগণ দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে গেলেন।
এই ধর্ম প্রেমিক (!) সামরিক শাসক সকল অনৈতিক এবং অনইসলামিক কাজে অন্তত বাংলাদেশে এখনো অদ্বিতীয় হয়ে আছেন। দুই সামরিক শাসকের হাত ধরে হওয়া মহাসর্বনাশের মধ্যে আমরা এখনো আছি। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে মৌলিক আদর্শ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বটে, কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মীয় রাজনীতি বহাল থাকায় একটা জগাখিচুড়ি অবস্থা হয়ে আছে। না ঘরকা না ঘটকা। তাতে ধর্মীয় অন্ধত্বের চরম উন্মাদনা ও প্রচার অবাধে চলছে। ধর্মীয় অন্ধত্বের বিস্তার, এখন শহর ও গ্রাম-গঞ্জের সর্বত্র পূর্বের যে কোনো সময়ের চেয়ে অধিকতরভাবে সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। অন্তর ও কর্মে নয়, লোক দেখানো বাহ্যিক কর্মকাণ্ডে ধর্মীয় কিছু সাইনবোর্ড প্রদর্শন করে ঘুষ খাওয়াসহ সব ধরনের অনৈতিক কাজে নগ্নভাবে লিপ্ত মানুষগুলো দেখাতে চাইছে আমরা বড় ধার্মিক, ওসব বদকাজের মধ্যে আমরা নেই। ধর্মের বাহ্যিকতা আজকে রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও অফিস আদালতে যেভাবে দেখা যায়, সেটা যদি সকলে মনেপ্রাণে ধারণ করতেন তাহলে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ব্যাধি দুর্নীতি নির্মূল হয়ে যেত। রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার থাকলে প্রশাসনের সর্বত্র তা ছড়িয়ে পড়বে সেটাই স্বাভাবিক। লক্ষ্য করলে দেখবেন সরকারি সংস্থা ও অফিসের প্রধান ফটকসহ ভেতরে অনেক জায়গায় ধর্মের পবিত্র বাণীখচিত অনেক বোর্ড বিলবোর্ড রয়েছে। কিন্তু সেই অফিসের ভেতরে বসে যখন দুর্নীতি ও অপকর্ম হয় তখন ধর্মের পবিত্র কালামের মর্যাদা বাড়ে, না কমে। ওই অফিসে অন্য ধর্মের মানুষের কথা না হয় বাদই দিলাম।
পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে ধর্মীয় অন্ধত্বপূর্ণ সাম্প্রদায়িক ছিল। কিন্তু সে সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, আজকের বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জ অন্ধত্বমুক্ত এবং পরম অসাম্প্রদায়িক ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরের মাথায় এসে সেই গ্রাম-গঞ্জের চেহারা সম্পূর্ণ বিপরীত মানসিকতায় পূর্ণ। মানুষ, বিশেষ করে নারী ও মেয়েদের পোশাক-আশাকের দিকে তাকালে অন্ধ বিশ্বাসের একটা প্রতীকী প্রমাণ মিলে। কোনো ধর্মেই ধর্মীয় পোশাক বলতে কিছু নেই। আজকাল প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নেতা ও অর্থশালী মানুষ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় যত আগ্রহী, একটা আধুনিক স্কুল প্রতিষ্ঠায় তার এক ভাগ আগ্রহী নয়। প্রবন্ধ বড় হয়ে যাচ্ছে, এখানেই শেষ করতে হবে।
লেখাটি শেষ করছি সেই মুহূর্তেই ১৩ অক্টোবর রাতে খবর পেলাম কুমিল্লার একটা পূজামণ্ডপে কে বা কারা একটা কোরআন শরীফ রেখে গেছে। সেটিকে উপলক্ষ বানিয়ে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী আবার ২০১২ সালের রামু ও ২০১৬ সালে নাসিরনগরে সংঘটিত ঘটনার কপি পেস্ট করার জন্য উদ্যত হয়। পুলিশ দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ায় বড় লঙ্কাকাণ্ড এড়ানো গেছে বলে আপাতত মনে হচ্ছে। কাকতালীয় যে, আজকের প্রবন্ধে উল্লেখিত আমার আশঙ্কার প্রতিধ্বনিই লেখাটি শেষ করার পূর্বেই কুমিল্লায় দেখা গেল।
উপসংহারে বলা যায়, স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা আজ সংবিধানে জগাখিচুড়ি অবস্থায় আছে। রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে অসাম্প্রদায়িকতার প্রতিফলন থাকলেও রাষ্ট্রযন্ত্রের মানসিকতা ধর্মীয় অন্ধত্বের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। ধর্মীয় রাজনীতির অপব্যাখ্যা বৃহত্তর গ্রাম-গঞ্জে ধর্মনিরপেক্ষ এবং উদার ও মুক্ত মানসিকতার চিহ্ণ দিন দিন বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
লেখক: গবেষক এবং রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক