লুৎফর রহমান লাভলু
বর্তমান যুগ বিশ্বায়নের যুগ। বিশ্বায়নের এই যুগে এসে আমরা যেমন পেয়েছি আধুনিকতার ছোঁয়া এবং সময়ের পরিক্রমায় আজ অবস্থান করছি উন্নয়নশীল দেশের কাতারে, যা আমাদের জন্য এক বড় প্রাপ্তি ও গৌরবের বিষয়। একসময় যারা বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ মনে করত তারা আজ এই দেশকে উন্নয়নের মডেল মনে করছে। বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাংলাদেশের বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছে এক নতুন মাত্রায়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতিসংঘের উদ্যোগে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় যুক্ত হয় এবং ধীরে ধীরে বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীনতার অর্ধশতবছরে আমরা পা রেখেছি। এই দীর্ঘসময়ে আমরা প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি দুটোই যেমন আছে, তেমনি আছে অপ্রাপ্তিও।
আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিগুলোর মাঝে বিশ্বব্যাংকের ঋণ ছাড়াই নিজ দেশের অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি, কর্ণফুলি ট্যানেল, ঢাকার মেট্রোরেল এবং বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ তথ্য ও প্রযুক্তিতেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। উল্লিখিত উন্নয়নগুলো বহির্বিশ্বেও চোখে পড়ার মতো, যা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
কিন্তু এসব উন্নয়ন রাজদানীকেন্দ্রিক কিংবা শহরাঞ্চলে। ফলে স্বাধীনতার অর্ধশত বছরে এসে প্রান্তিক উন্নয়ন কতটুকু? তার আজ প্রশ্নবিদ্ধ। বাংলাদেশের সংবিধানে গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লবের জন্য সংবিধানের দ্বিতীয়ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ১৬নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয় যে, নগর বা গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করার উদ্দেশ্যে কৃষি বিপ্লবের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে প্রান্তিক বা গ্রামঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অথচ বাংলাদেশের গ্রামীণ কৃষিব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখা যায়, এখনো আধুনিক যুগোপযোগী ব্যবস্থার সাথে তাল মিলাতে পারেনি। বাংলাদেশে যদিও আধুনিক ধানজাত উফশী, হাইব্রিড ব্রি-ধান—এগুলোর ফলে উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু চলমান ফসলের মৌসুমগুলোতে শ্রমিক ব্যবস্থার স্বল্পতার কারণে কৃষকরা অবহেলিত, বঞ্চিত। মৌসুম চলার সময় শ্রমিকের দাম থাকে সাতশ থেকে আটশ টাকা। কিন্তু ধান বিক্রি করতে হয় ছয়শ থেকে সাতশ টাকায়, যার ফলে দামের দিক থেকে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে চাষিরা।
কৃষি দ্রব্যের সংরক্ষণ ও গুদামজাতরণে সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকার কারণে দালাল, ফড়িয়া ও মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা লাভবান হয়ে মুনাফার পাহাড় গড়ছে, আর কৃষকেরা ন্যায্যামূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আজ বলা হয় আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। অথচ প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে সময়মতো থাকছে না বিদ্যুৎ, যার অন্যতম কারণ চাহিদা অনুপাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন একেবারে নগণ্য। আর লোর্ডশেডিংয়ের ফলে অনেক ফসলি জমির সেচ কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে, ফসল নষ্ট হচ্ছে। উপরন্তু এখনো অনেক অঞ্চলে বিদ্যুৎসেবা পৌঁছেনি।
বাংলাদেশের এক ঐতিহ্যের অংশ জুড়ে আছে গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প। আজ গ্রামের ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পগুলো প্রায়ই বিলুপ্ত। দেখা যায় না, আর গ্রামে মেয়েদের হাতে হাতে তৈরি বিভিন্ন পোশাক, বস্ত্র, নকশিকাঁথা। বাঁশ, বেত, কাঠ ইত্যাদি দিয়ে তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্রগুলো বিলুপ্তির পথে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের তাঁতশিল্পও হারিয়ে যাওয়ার পথে, নেই ঢাকার মসলিন, জামদানি। যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, তাও যথাযথ মূল্যায়ন ও ব্যবস্থাপনার অভাবে হারাতে বসেছে। একসময় বাংলাদেশের তাঁতশিল্পগুলো দেশের বস্ত্রের চাহিদা নিবারণ করত। দেশের কুটিরশিল্পগুলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব হেতু এবং অস্থিতিশীল দাম ব্যবস্থার কারণে আজ বন্ধের পথে।
গ্রামবাংলার শিক্ষার দিকে তাকালে দেখা যায় এর করুণচিত্র। শহরে শিক্ষার জন্য সুশৃঙ্খল পরিবেশ, উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা সুনিশ্চিত থাকলেও গ্রামাঞ্চলে তার অবস্থা একেবারে নিম্নমানের। নেই শিক্ষার সুব্যবস্থা, উন্নত পরিবেশ, শিক্ষার জন্য পরিমাণমতো সরঞ্জাম ও শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক ও অবকাঠামোর সুব্যবস্থা। ফলে প্রান্তিক অঞ্চলের সাথে শহরাঞ্চলের শিক্ষার বৈষম্য অনেক। খাদ্য, অপুষ্টি, দারিদ্র্য গ্রামের শিক্ষাব্যবস্থার এক নীরব ঘাতক। শহরে ই-লার্নিং, প্রজেক্টর, অনলাইনভিত্তিক শিক্ষার পরিবেশ বিদ্যমান, কিন্তু গ্রামে নেই বিদ্যুতের সুব্যবস্থা, নেই উন্নত নেটওয়ার্ক কাঠামো। ফলে বিশ্বায়নের যুগে শহরের সঙ্গে গ্রামের শিক্ষাব্যবস্থা তাল মেলাতে পারছে না। স্বাধীনতার অর্ধশত বছরে এসে গ্রামের শিক্ষাব্যবস্থার নেই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। ফলস্বরূপ প্রতি বছর ঝরে যাচ্ছে হাজারো শিক্ষার্থী।
গ্রামীণ যোগাযোগব্যবস্থা ও অবকাঠামোতেও নেই তেমন পরিবর্তন। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে প্রতি বছর সরকার যে পরিমাণ বরাদ্দ দেয়, তার সিংহভাগ পকেট বোঝাই করে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাকর্মীরা। যোগাযোগব্যবস্থার ক্ষেত্রে এখনো অনেক সমস্যা। পণ্যদ্রব্য উৎপাদন, বিপণন, ব্যবসা-বাণিজ্যের অগ্রগতি সাধনের ক্ষেত্রে রাস্তাঘাট ও উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু প্রান্তিক অঞ্চলে ব্যবসা, বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা এর অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থা।
একই সঙ্গে শিল্পের দিকে তাকালেও দেখা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত যেসব শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে, তার সিংহভাগ রাজধানী শহর এবং সামান্য কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান অন্যান্য বিভাগীয় শহরে। বাংলাদেশে এখনো জেলা, উপজেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে বড় বড় কোনো শিল্প-কারখানা, গার্মেন্ট কিংবা উন্নত মানের হাসপাতাল অথবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। ফলে প্রতি বছর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে কর্মসংস্থানসহ উন্নত যে-কোনো ধরনের সেবা গ্রহণে শহরমুখী হতে হচ্ছে। সুশিক্ষিত, মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষের শহরমুখী হওয়ার কারণে যেমন গ্রামীণ পর্যায়ে মেধাশূন্যতা দেখা দিয়েছে, পাশাপাশি শহরের ওপরে চাপ বেড়েই চলেছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। মোদ্দাকথা, প্রান্তিক উন্নয়ন ছাড়া একটি দেশের সার্বিক উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়।
সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সব ধরনের দূষণ প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের অস্ত্তিত্ব রক্ষায় এখন সরকারকে প্রান্তিক পর্যায়ের উন্নয়নে উদ্যোগ নিতে হবে। আর তার জন্য প্রতিটি বিভাগ, জেলা, উপজেলা পর্যায়ে শিল্পকারখানা, উন্নত মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল নির্মাণ জরুরি। এর মাধ্যমে মানুষের শহরমুখী প্রবণতা যেমন কমবে, তেমনি বেকারত্ব হ্রাস করাও সম্ভব হবে।
মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসেও শহরের সঙ্গে গ্রামের বৈষম্য প্রকট। তাই স্বাধীনতার অর্ধশত বছরে এসে প্রান্তিক উন্নয়ন আজ সময়ের দাবি। আমরা বিশ্বাস করি, বর্তমান সরকারের স্লোগান ‘গ্রাম হবে শহর’-এর বাস্তবায়নে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নসহ দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ
সুত্রঃ বাংলাদেশের খবর