মাছুম বিল্লাহ
আমার শিক্ষকতা জীবনের একটি বড় অংশ কেটেছে ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, ক্যাডেট কলেজ (সিলেট, কুমিল্লা ও মির্জাপুর) এবং রাজউক কলেজের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পোশাক, চুল ও আচরণের ওপর সরাসরি নিষেধাজ্ঞা আছে। ফলে শিক্ষার্থী, এমনকি শিক্ষকগণও ইচ্ছে করলেই যে কোনো ধরনের পোশাক পরিধান করতে পারেন না, যে কোনোভাবে চুল রাখতে পারেন না।
সরাসরি সেনানিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান নয় রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ। তবে সেখানকার অধ্যক্ষ সেনা অফিসার ( ব্রিগেডিয়ার জেনারেল)। এখানকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদেরকেও কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এখানকার কোনো শিক্ষার্থী ইচ্ছে করলেই বড় চুল রাখতে পারে না। আমি ওই কলেজে থাকাকালীণ দেখেছি কোনো শিক্ষার্থী চুল একটু এলোমেলো করলে অধ্যক্ষ ডেকে নিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে চুল কাটিয়ে দিতেন। এখনও অবস্থা নিশ্চয়ই তেমন আছে।
অনেক প্রতিষ্ঠানেই কিছু শিক্ষক থাকেন, যারা অধিকার নিয়ে শিক্ষার্থীকে উপদেশ দেন, শাসন করেন। সেই অধিকার অবশ্য সবাই অর্জন করতে পারেন না। যারা অর্জন করতে পারেন তারা শিক্ষার্থীদের কটূ কথা বললেও শিক্ষার্থীরা তা মেনে নেয়। কিন্তু যারা সেই অধিকার অর্জন করতে পারেননি তারা সামান্য কিছু বললেই বা করলেই এ যুগের শিক্ষার্থীরা ক্ষেপে যায়, প্রতিবাদ করে, এমনকি আইনের আশ্রয় নেয়।
শিক্ষার্থীদের ওপর নিয়ম-কানুন ফলানো বা তাদের কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে রাখা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত মানানসই। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এটি হয় না, হওয়ার কথাও নয়। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রাপ্তবয়স্ক, স্বাধীন, উন্মুক্ত। পোশাক-আশাক, আচার-আচরণে তাদের পরিপাটি থাকার কথা, কিন্তু ছাত্র রাজনীতি, সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো একটু অন্যরকম পোশাক পরে, অন্য ধরনের চুল রাখে। সেটি হয়তো কোনো কোনো শিক্ষকের চোখে লাগে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক সরাসরি সেসব শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন কিনা, নিজ হাতে চুল কাটার মতো ঘটনা ঘটাতে পারেন কিনা সেটি একটি প্রশ্ন।
আমাদের চিন্তা করতে হবে শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক সেই অবস্থায় আছে কি? এমনকি চুল পরিপাটি রাখার মতো উপদেশ দেওয়ার অবস্থায় সেই শিক্ষক আছেন কিনা বা উপদেশ দিলেই শিক্ষার্থীরা শুনবে কিনা সেটি শিক্ষককে বুঝতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার হলে প্রবেশের আগে নিজ হাতে কাচি দিয়ে চুল কেটে দেওয়ার ঘটনা একটু বিস্ময়করই মনে হয়। ২৬ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটেছে। অভিযুক্ত শিক্ষক হলে ঢোকার পূর্বে ১৪ জন শিক্ষার্থীর চুল কেটে দেন। একজন শিক্ষার্থী এর প্রতিবাদ করায় তাকে রুমে ডেকে নিয়ে গালিগালাজ করা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের হুমকি দেওয়া হয়। ফলে শিক্ষার্থী ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে শিক্ষার্থীদের চুল কেটে দেওয়াটা কি খুব জরুরি ছিল? অভিযুক্ত শিক্ষক কি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চুল কেটে দেওয়ার অধিকার রাখেন? ওই শিক্ষার্থী যদি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র হতো তাহলে কি তিনি তার প্রতি এমন আচরণ করতেন? প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীরা যখন শিক্ষকের কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ পায় সেটি তাদের মনোকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের মনস্তত্ত্ব জানা প্রয়োজন। তার উদ্দেশ্য সৎ ছিল নাকি ফেইসে আসার জন্য চুল কাটার মতো ঘটনা ঘটানো হয়েছে সেটি আরেকটি প্রশ্ন।
এ দিকে লক্ষীপুরের রায়পুর উপজেলায় ৬ শিক্ষার্থীর চুল কেটে দিয়েছেন একজন মাদ্রাসা শিক্ষক। এ ঘটনায় শিক্ষককে গ্রেপ্তার করে জামিন না-মঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীর চুল কেটে দিলেই তাকে কারাগারে যেতে হবে- এ কেমন কথা? তিনি তো এতো বড় অপরাধ করেননি যে জামিন পর্যন্ত পাবেন না।
শিক্ষকতা পেশা সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দাবি রাখলেও অবহেলা, অযত্ন ও অবজ্ঞার ফলে এই পেশা ক্রমেই মেধাবীদের আকর্ষণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। তার মধ্যে এ ধরনের ঘটনা তো শিক্ষকদের আরও বেকায়দায় ফেলছে। তার মানে হচ্ছে এই পেশার প্রতি শিক্ষিত মানুষের আগ্রহ আরও কমে যাবার উপক্রম হয়েছে। এক-দু’জন শিক্ষক না হয় এ ধরনের ঘটনা আবেগের বশবর্তী হয়ে হোক কিংবা রাগের মাথায় হোক, ঘটিয়ে ফেলেছেন, তাই বলে তাদের প্রতি এ ধরনের আচরণ করতে হবে? তাদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও প্রতিষ্ঠানের যে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে সেটিই কি তাদের সংশোধনের জন্য যথেষ্ট নয়?
দু’একদিনের ব্যবধানে আরেকটি ঘটনা দেখলাম পত্রিকার পাতায়। বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি শিক্ষককে ঘুষি মেরে তার কয়েকটি দাঁত ফেলে দিয়েছেন। পুরো শিক্ষাক্ষেত্রে এসব হচ্ছেটা কী? বিষয়টি নিয়ে খুব একটা আলোচনা হচ্ছে না। যতটা-না আলোচনা হচ্ছে শিক্ষকের চুল কাটা নিয়ে। তাহলে কি ধরে নিতে হবে শিক্ষকের দাঁতের চেয়ে শিক্ষার্থীর চুলের মূল্য অনেক বেশি?
আমরা কাউকেই যদি কেউ সম্মান না দেখাই তাহলে সম্মান আসবে কোত্থেকে? শিক্ষার্থীদের যেমন শ্রদ্ধা করতে হবে শিক্ষককে, বয়স্কদেরকে, তেমনি শিক্ষকদেরকেও সম্মান দেখাতে হবে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সমাজকে। একজন শিক্ষক যত ছোট ক্লাসেরই হোক- শিক্ষার্থীর আত্মসম্মানে আঘাত করতে পারেন না। কথাটি শুধু আইনের খাতায় লিখে রাখলে হবে না, পালন করতে হবে। শিক্ষকের কাছ থেকে যখন শিক্ষার্থীরা শিখবে কীভাবে মানুষকে সম্মান প্রদর্শন করতে হয়, কীভাবে বয়সভেদে মানুষের সঙ্গে আচরণ করতে হয় তখন শিক্ষকদের সমাজও সম্মান প্রদর্শন করবে।
লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক
সুত্রঃ রাইজিংবিডিডটকম
সান নিউজ/এমএইচ