প্রদীপ অধিকারী
সাম্প্রতিক সময়ে দুর্গোৎসবসহ বিভিন্ন পূজা অনুষ্ঠানে, অপ্রয়োজনে লাউড স্পিকারের উচ্চশব্দ, অশালীন গান-বাজনা, অশ্লীল নৃত্য, মাদকীয় উন্মাদনা, পূজা-উৎসবের ভাবগাম্ভীর্যকে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করছে। কলুষিত করছে পূজাঙ্গনের পরিবেশ। হ্রাস পাচ্ছে ভক্তবৃন্দের সপরিবার অংশগ্রহণ। পূজা-উৎসব হারাচ্ছে সর্বজনীনতা। ভেঙে যাচ্ছে বাঙালির হাজারো বছরের সৌন্দর্য-চেতনার পাদপীঠ, আত্মশুদ্ধির পাঠশালা, পারলৌকিক মুক্তির তপোবন।
পূজার বিরুদ্ধে তুলে দেয়া হচ্ছে বিদ্রূপাত্মক মারণাস্ত্র, অবজ্ঞা-অশ্রদ্ধার ক্ষেপনাস্ত্র, নেতিবাচক বাক্যবাণের দুন্দুভি। অহেতুক ঝুঁকির মুখে ফেলা হচ্ছে পূজাঙ্গনের নিরাপত্তা। এই অনাকাঙ্খিত অনাচার পূজা-উৎসবের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দিচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে সর্বজনীন মননে পূজা-উৎসবের প্রতি চরম ঘৃণাবোধ জেগে ওঠার আশঙ্কা তৈরি করেছে। পূজাঙ্গন রূপান্তরিত হচ্ছে তামসাঙ্গনে। ভক্তিমূলক গীত-বাদ্যের স্থান দখল করছে বেলেল্লাপনা। আরতি-নৃত্যের স্থান দখল করছে রতি-নৃত্য। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উৎসবসমূহের সনাতন সৌন্দর্য, নিবিড় আধ্যাত্মবোধ, শৈল্পিকতা-নান্দনিকতা। যা অত্যন্ত মর্মান্তিক।
যারা এই পুণ্যার্জনের নির্মল সাত্ত্বিক পরিমণ্ডলে তামসীক মাদকীয় উন্মাদনার সৃষ্টি করছে, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে পূজা-উৎসবের হাজার বছরের পরিশীলিত শ্রদ্ধা-ভক্তি-বিশ্বাসের অবকাঠামোর উপর মারাত্মক আঘাত হানছে, তারা পূজা-উৎসবের সচেতন-অসচেতন-অস্পষ্ট শত্রু। এই শত্রুদের চরমভাবে দমন করতে হবে।
শ্রীমদ্ভগবদগীতায় নবম অধ্যায় রাজবিদ্যা-রাজগুহ্যযোগের দ্বাদশ শ্লোকে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ‘মোঘাশা মোঘকর্মাণো মোঘজ্ঞানা বিচেতসঃ। রাক্ষসীমাসুরীঞ্চৈব প্রকৃতিং মোহিণীং শ্রিতাঃ’ অর্থাৎ মূর্খ ব্যক্তিরা এরূপ মোহাচ্ছন্ন হয়, তারা রাক্ষসী ও আসুরীক ভাবের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সেই মোহাচ্ছন্ন অবস্থায় তাদের মুক্তিলাভের আশা, তাদের সকাম কর্ম এবং জ্ঞানের প্রয়াশ সমস্তই ব্যর্থ হয়।
আবার ষোড়শ অধ্যায় দৈবাসুর-সম্পদ-বিভাগযোগের নবম শ্লোকে, শ্রীভগবান বলেছেন, ‘এতাং দৃষ্টিমবষ্টভ্য নষ্টাত্মানোহল্পবুদ্ধয়ঃ। প্রভবন্ত্যুগ্রকর্মাণঃ ক্ষয়ায় জগতোহহিতাঃ “ অর্থাৎ হে অর্জুন, এ সকল আত্মতত্ত্ব-জ্ঞানহীন অল্প-বুদ্ধিসম্পন্ন উগ্রকর্মা ও অনিষ্টকারী অসুরেরা জগৎ ধ্বংসকারী কার্যে প্রভাব বিস্তার করে|
এ সকল স্থূল-বুদ্ধিজাত উন্মত্ত আসুরিক প্রবৃত্তির বিবর্তিত রূপই হচ্ছে সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, অমানবিকতা যা জগৎ ধ্বংসকারী, মনুষ্যত্ব ধ্বংসকারী কর্মের অনুঘটক। এ জন্য সবাইকে সচেতন এবং সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, এটাই হচ্ছে এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় পুণ্যকর্ম। এ জন্য ভূমিকা রাখতে হবে সকল ব্যক্তি, পরিবার, প্রতিষ্ঠান, বিশেষত আয়োজক প্রতিষ্ঠান, সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, প্রধানত ধর্মীয় সংগঠনগুলোকে, সর্বোপরি সরকারকে।
পূজা-উৎসবের ভাবগাম্ভীর্য রক্ষায় অনিবার্য করণীয়সমূহ:
যেহেতু ব্যক্তি, পারিবার ও আয়োজক প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন, পূজা-উৎসবের মূল নিয়ন্ত্রক। এই মৌলিক কাঠামোগুলো থেকে যদি পূজা-উৎসবের ভাব-গাম্ভীর্য রক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, অশালীন মাদকীয় উন্মাদনার নেতিবাচক দিক সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে সচেতন করে, বন্ধ করার প্রয়োজনীয় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তবেই অনাদীকালের মহৎ-সৃজনশীল উৎসবগুলো সর্বজনীন ঘৃণানল থেকে দ্রুত রক্ষা পাবে।
সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন সভা-সমাবেশে ফেস্টুন-পোস্টার-লিফলেট-বক্তৃতা ইত্যাদির মাধ্যমে, এ সকল পূজার আচার বর্জিত, আঙ্গিকতা বর্জিত, কল্যাণ বর্জিত কর্মকাণ্ডের পরিণতি সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। মনে রাখতে হবে সকল অসভ্যতা উগ্রতাই ভয়ঙ্কর, অস্পষ্ট শত্রু আধিক ভয়ঙ্কর। প্রথমেই এই প্রচ্ছন্ন শত্রুদের চিনিয়ে দিতে হবে এবং জনগণের মধ্যে প্রতিরোধ সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে।
বিশেষত ধর্মীয় সংগঠনগুলোকে সাংগঠনিক কাঠামো ব্যবহার করে, নানাবিধ ধর্মীয় আচার আলোচনায়, এ সকল উন্মাদনা সৃষ্টিকারীদের কর্মকাণ্ডের পরিণতি সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে এবং প্রতিরোধের প্রক্রিয়া উপস্থাপন করতে হবে।
সর্বোপরী এ সকল উন্মাদনা নিয়ন্ত্রণের জন্য, পরিবেশ পরিস্থিতি নিরিখে প্রয়োজনীয় বিধিমালা প্রণয়ন করে, তা মেনে চলার জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং প্রয়োজনে সরকার-আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা নিতে হবে।
এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। আমাদের কালান্তরের ভক্তি-বিশ্বাস-শ্রদ্ধাকে অপমানিত করতে দেয়া যায় না। সর্বোপরী এই উগ্রতাজাত অসভ্যতা এবং অমাঙ্গলীক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধের জন্য, পূজা-উৎসবের যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য রক্ষার জন্য, সবার সমবেত প্রচেষ্টা এখন সময়ের দাবি।
লেখক: সভাপতি, হিন্দু কল্যাণ সংস্থা, টঙ্গী থানা শাখা, গাজীপুর
সান নিউজ/এমএইচ
সুত্রঃ রাইজিং বিডি