এ কে এম শাহনাওয়াজ
তিনটি ভিন্ন সময়ের অভিজ্ঞতা। প্রথম গল্পটি ২০১৩ কি ’১৪ সালের। গল্পের কেন্দ্রে আছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র। ছিপছিপে গড়নের সাদামাটা চেহারার ছেলেটি। গায়ের রং শ্যামলা। কথা বলার ঢঙে একটা বিনীত ভাব। বললো স্যার, আপনার সাথে একটু কথা বলব। আমি শিক্ষকতার বাইরে তখন অতিরিক্ত একটি দায়িত্ব পালন করতাম। ছাত্রকল্যাণ ও পরামর্শদান কেন্দ্রের পরিচালকের দায়িত্বে ছিলাম। সেই সূত্রে দেখতাম মাঝে মধ্যে বিচিত্র সব বিষয়ে পরামর্শ চাইতে আসত ছাত্রছাত্রীরা।
আমাদের অফিসে একজন পুরুষ ও একজন মহিলা মনোবিজ্ঞানী আছেন। তাদের ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়। ছাত্রছাত্রী অনেকের মধ্যে নানা জটিল ও বিচিত্র মনোসমস্যা থাকে। ভালো লাগত যখন দেখতাম মনোবিজ্ঞানীদের তত্ত্বাবধানে থেকে অনেক ছেলেমেয়ে সংকট থেকে বেরিয়ে আসত। আরও একটি কাজ শুরু করেছিলাম এই কেন্দ্রে। তালিকা তৈরি করেছিলাম শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। যে অভিভাবকরা বাড়িতে পড়ানোর জন্য প্রাইভেট টিউটর চান এবং যে ছাত্রছাত্রীরা টিউশনি করাতে আগ্রহী আমরা তাদের মধ্যে একটি যোগসূত্র তৈরির দায়িত্ব নিয়েছিলাম।
এই দুই প্রয়োজনেই ছাত্রছাত্রীরা বেশি আসত কেন্দ্রে। অবশ্য এসবের জন্য আমার কাছে সরাসরি আসার প্রয়োজন পড়ত না। তাই এই ছেলেটির আমার সঙ্গে কথা বলতে চাওয়ার কারণ চট করে বুঝতে পারছিলাম না। আমি ওকে সামনের চেয়ারটিতে বসতে বললাম। সামান্য দ্বিধা নিয়েই ও সব কথা খুলে বলল। ধরে নেই ওর নাম মাসুদ। কলা অনুষদের একটি বিভাগে পড়ছে। বলল ওর নিজের কথা। সাতক্ষীরা বাড়ি। বরাবর মেধাবী, ভালো ফলাফল করেছে।
মেধার প্রমাণ রেখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে মাসুদ। তাকে অসম্ভব স্নেহ করতেন স্কুলের শিক্ষক কবির স্যার এবং এলাকার বড় ভাই শেখ ইয়াসিন। তারা আর্থিক সহায়তা করায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছে। বাবা ভ্যানগাড়ি চালিয়ে ছয় জনের সংসার নির্বাহে হিমশিম খান। সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো তার জন্য বিলাসিতা। মাসুদ তিনটি টিউশনি করে নিজের খরচ চালায়। চেষ্টা করে বাবাকে পাঁচ সাত শ’ টাকা পাঠাতে। আর প্রতিদিন কর গোনে কবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ হবে। চাকরি জোগাড় করে সংসারের হাল ধরবে। ওর কাছে এক একটা দিন এক একটি বছরের মতো।
সেসময়ে তিন বছর ধরে রাজনৈতিক বা সন্ত্রাসী ঝামেলায় মাঝে মাঝে ক্লাস পরীক্ষার বিঘ্ন ঘটেছে। সামান্য সেশনজট তৈরিও হয়েছে। এর মধ্যে নানা কারণে মাসুদের আর্থিক সংকট বেড়েছে। এখন সেশনজটের আশঙ্কা ওকে বিমর্ষ করে। সে বছরের মে থেকে ওকে খুব শঙ্কায় ফেলে দিয়েছিল ভিসি পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষকদের একটি অংশের আন্দোলন।
বেশিরভাগ শিক্ষক ক্লাস নিলেও আন্দোলনকারী শিক্ষকদের অনেকেই নিচ্ছিলেন না। কষ্টের সঙ্গে মাসুদ জানাল যখন অধিকাংশ কোর্সের ক্লাস শেষের দিকে তখন আন্দোলনকারী শিক্ষক নেতা মাত্র দুটো ক্লাস নিয়েছেন। শিক্ষকদের ক্লাস ধর্মঘট ও ব্যক্তিগত অসাধুতায় ক্লাস না নেয়ার কারণে ওদের হিসেবে ছয়মাস থেকে একবছর সেশনজটের ফাঁদে পড়ে যাবে। মাসুদের পক্ষে টিকে থাকার সংগ্রমে এ এক কঠিন সংকট।
মাসুদ প্রশ্ন করে স্যার, এ থেকে বের হওয়ার উপায় কী? শিক্ষকরা কি আমাদের কথা একবারও ভাববেন না? আমি বিব্রত। কুণ্ঠিত কণ্ঠে বললাম- মাসুদ, এর উত্তর আমার জানা নেই। পরক্ষণেই মনে হলো এ আমার আত্মপ্রবঞ্চনা নয় তো! সত্যি কি উত্তরটি আমার জানা নেই?
এবার দ্বিতীয় গল্প। গত সপ্তাহে পাওয়া এক ছাত্রীর টেলিফোন। কোনো এক বিভাগে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। ও এক দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছে। মেধাবী মেয়ে। কিশোরগঞ্জের গ্রামের বাড়ি। বাবা বৃদ্ধ। এখন আর হালচাষ করতে পারেন না। বড় ভাই অন্যের জমিতে চাষ করে আর অবসরে বিলে মাছ ধরে সংসারের আয় বাড়ানোর চেষ্টা করে। মেধাবী বোনটির আগ্রহকে মূল্য দিতে চায় ভাই। সেই সূত্রেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা। কিন্তু ভাইয়ের পক্ষে ব্যয়নির্বাহ করা কঠিন। মেয়েটি একটি টিউশনি করে কায়ক্লেশে চলে। ওর বিভাগের এক স্নেহভাজন সহকর্মী মেয়েটির কষ্টের কথা আমাকে জানিয়েছিল।
আমরা সামান্য চেষ্টা করেছিলাম ওকে কিছুটা সহযোগিতা করার। ফলে ওর শিক্ষাজীবনে একটু ছন্দ ফিরে এসেছিল। এর মধ্যে কভিড হানা দিল। বন্ধ হয়ে গেল ক্যাম্পাস। অনেকের মতো মেয়েটিও গ্রামে ফিরে গেল। মাস তিনেক আগে মেয়েটির একটি ফোন পেলাম। কান্নাভেজা কণ্ঠ। খুবই স্বাভাবিক যে, মেয়েটির পরিবারের পক্ষে অজানা সময় পর্যন্ত ভার বহন করা কঠিন। তাই ওকে কিছুদিন আগে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে। বাস্তবতার বিচারে ও বুঝে গেছে ওর শিক্ষাজীবনের এখানেই সমাপ্তি ঘটল।
আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের বিষয়ে খোঁজ নিলে এ ধরনের অসহায় চিত্র অনেক খুঁজে পাব। আমরা কাছে থেকে দেখি, অনুভব করি। ব্যক্তিগতভাবে কতটুকুইবা সহায়তা করা যায়। আবার অনেক শিক্ষার্থী এ ধরনের সহায়তা নিতে কুণ্ঠাও বোধ করে।
এবার তৃতীয় গল্প, আমি তখন একটি হলের প্রভোস্ট। আমার হলের এক ছাত্রের কথা জানলাম। যশোরের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসেছে। বাবা নেই। মা এর ওর বাড়িতে কাজ করেন। আর নানারকম সব্জি চাষ করে ঘরের পাশের পালানে। ছেলেটির আর্থিক দুর্দশাটা বুঝতে পেরেছি। আমি আমার হাউস টিউটরদের সঙ্গে আলাপ করে ওর ডাইনিংয়ের খাবার ফ্রি করে দিয়েছিলাম। কৃতজ্ঞতার প্রকাশ হিসেবে ছেলেটির মা একদিন ব্যাগ বোঝাই করে তার ফলানো নানা শাকসবজি পাঠিয়েছিলেন ছেলের হাতে। এই মহামূল্য উপহার পেয়ে সেদিন চোখ ভিজে গিয়েছিল।
দেশ অনেকটা এগিয়েছে বলেই আমরা জানি। এসব উন্নয়নের সুফলও দেশবাসী পাচ্ছে। তারপরেও সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেয়নি প্রান্তিক অবস্থা থেকে আসা মেধাবী শিক্ষার্থীদের পাশে ছায়া হয়ে দাঁড়াতে। অথচ দেশে অর্থ সংকট আছে বলে মনে হয় না! প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতির কারণে যে পরিমাণ অর্থ অতৃপ্ত কুমিরদের পেটে যাচ্ছে- সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারলে এর খণ্ডাংশ দিয়েই অসহায় শিক্ষার্থীদের চলার পথ আলোকিত করা যেত। তবে এর জন্য প্রয়োজন কল্যাণকামী পরিকল্পনা। কভিডকালিন দীর্ঘ সময়ে অনেকের পারিবারিক জীবন ও জীবিকা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। মানসিকভাবেও অনেকে বিপর্যস্ত। শিক্ষাক্ষেত্রে এর যে বিরূপ প্রভাব পড়বে এদিকে কোনো পক্ষের দৃষ্টিপাত লক্ষ করা যাচ্ছে না।
আমাদের ক্যাম্পাসের পাশে এক বয়স্ক ভদ্রলোককে জানি। চার হাজার টাকায় বাসা ভাড়া করে কায়ক্লেশে থাকেন। একসময় এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছোটখাট চাকরি করতেন। কভিডের আগেই অবসরে গেছেন। পায়ের কী এক সমস্যায় খুঁড়িয়ে হাঁটেন। স্ত্রী ও পাঁচ মেয়ে নিয়ে তার সংসার। ক্যাম্পাসের পাশে একটি টং দোকান দিয়ে চা বিক্রি করে সংসার চালাতেন। ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে গেলে ক্যাম্পাস-সংশ্লিষ্ট সকলের ব্যবসায় ভাটা পড়ে।
কভিডের আঘাতে তার দোকান পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। কভিডের প্রথম বছর এর ওর সাহায্যে জীবিকা নির্বাহ ও মেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে গিয়েছেন। বোজ রোজ কে কতটা সাহায্য করবে! গত সপ্তাহে সাহায্যের আশায় ভদ্রলোক এসেছিলেন। কান্নাভেজা কণ্ঠে জানালেন পাকাপাকিভাবে মেয়েদের পড়াশুনোর ইতি টেনেছেন।
সরকারি দায়িত্বশীলরা দেশজুড়ে থাকা অমন অসহায় মানুষদের তালিকা কি তৈরি করেছেন? সরকার ছাড়া গণমানুষের পাশে দাঁড়াবে কে! সামর্থ্যবান মানুষ যে সহযোগিতা করেন না তেমন নয়। তবে তাদের মাধ্যমে স্থানিক পর্যায়ে বিচ্ছিন্নভাবে কেউ কেউ সহযোগিতা পেতে পারেন। এতে সার্বিক সংকটের সুরাহা হয় না।
এখন স্কুল-কলেজ খুলে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও খুলছে। এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ফরম পূরণের সময়েই জানা গেছে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী কভিডের নানা প্রতিক্রিয়ায় ঝরে পড়েছে। এমন অবস্থায় শিক্ষা উন্নয়ন নিয়ে কি আমরা বিশেষ গর্ব করতে পারি?
আমরা প্রত্যাশা করব শিক্ষাক্ষেত্রে চলমান এবং কভিড-উত্তর চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলার জন্য বিধায়করা বিশেষ নজর দেবেন। সংকটসমূহ যথার্থভাবে শনাক্ত করে ব্যবস্থা না নিলে ভয়ংকর অন্ধকারকেই মোকাবিলা করতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
লেখাটি নিউজবাংলা২৪.কম থেকে সংগৃহীত