সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা:
আবার পেঁয়াজের বাজারে আগুন। কোনও কারণ ছাড়াই মাত্র চার থেকে পাঁচ দিনের ব্যবধানে কেজি প্রতি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ২০-২৫ টাকা। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, হঠাৎ আড়তদাররা পেঁয়াজের দাম বাড়িয়েছে। ফলে তাদের কাছ থেকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে এবং বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি কমেছে, এই অজুহাতে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হচ্ছে। আর তার প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে।
একদিকে দেশের নানা প্রান্তে বন্যা আর সামগ্রিকভাবে মূল্যবৃদ্ধির আগুনে দগ্ধ মানুষ। এর সঙ্গে করোনা আতঙ্ক তো আছেই। ঘাতক করোনার দাপট শেষ হয়নি। রোজগার হারা, কাজ হারা সাধারণ মানুষ এমনিতেই কষ্টে আছে। এ কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে চালসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। চালের পাশাপাশি ডাল, আটা, চিনি, তরকারি, মাছ, মাংসের দাম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দরিদ্র, খেটে খাওয়া ও অসহায় মানুষ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে। শুধু দরিদ্র মানুষ নয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও নানারকম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।
পত্রিকার খবর বলছে, করোনার বিধিনিষেধে মানুষ অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে উঠলেও দেশের ১০ জেলায় বন্যা চলছে। ফলে এসব এলাকার মানুষ দুর্ভোগে পড়েছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় সুপেয় পানি ও খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন দিনমজুররা। আনুষ্ঠানিকভাবে বর্ষা বিদায় নিলেও বেশি বৃষ্টিতে এই বন্যা দেখা দিয়েছে।
করোনা আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের নির্মম আঘাতের পাশাপাশি গরিব মধ্যবিত্তের অবস্থাকে আরও সঙ্গিন করে তুলেছে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি। কিন্তু মানুষ দেখছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় আশ্চর্যজনকভাবে নির্বিকার। টিসিবির মাধ্যমে শহরাঞ্চলে কিছু পণ্য বিক্রি ছাড়া মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের কোনও চেষ্টা কোথাও দৃশ্যমান নয়। আন্তর্জাতিক বাজার দরের দোহাই দিয়ে যখন তখন দাম বাড়ানো হতো জ্বালানি তেলের। বিশ্ববাজারে কমলে অবশ্য কমায়নি কখনও সরকার। আর এখন সরকার আর ব্যবসায়ীরা একসঙ্গে হয়ে আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে বাড়িয়ে চলেছে ভোজ্যতেলের দাম। সঙ্গে সিন্ডিকেটের কারসাজিতে বেড়ে চলেছে চাল, সবজির দামও।
সাধারণ মানুষের এখন ত্রাহী 'মধুসূদন অবস্থা'। কার্যত সংসার চালাতে হাঁসফাঁস করছে আম জনতা। কে জানে আর কত দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। করোনার ধাক্কায় এমনিতেই এখন সাধারণ মানুষের হাতে নগদের বড়ই অভাব। অনেকেরই আয় কমেছে। তার ওপর নিয়ন্ত্রণহীন দ্রব্যমূল্য। প্রায় ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়া ডাল সবজি মাছ কিনে দুবেলা দু'মুঠো ভাত জোগাড় করাটাই এখন অনেকের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। রাজধানীতে যেকোনও সিগন্যালে গাড়ি থামলে এখন অভাবী হাত সাহায্যের আশায় মরিয়া হয়ে ওঠে। অভাবী মানুষ ঢুকে পড়েছে পাড়া-মহল্লায়। তাদের অনেকে নগদও চায় না। বলে কিছু চাল-ডাল কিনে দিতে।
ব্যবসায়ী মন্ত্রী আর এমপিদের যুগে ব্যবসায়ীরা ভালো থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সাধারণ মানুষের ভালো থাকাটা দেখার কেউ নেই। অতি ব্যবসায়ী হওয়ার এই সুযোগে ফড়িয়ারা আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বলা হয়, সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় অস্বাভাবিক দাম বাড়ে জিনিসের। প্রশ্ন হলো, সিন্ডিকেট কি সরকারের চেয়েও শক্তিশালী? সিন্ডিকেট হোতাদের সঙ্গে নীতিনির্ধারকদের কোথাও না কোথাও সম্পর্ক না থাকলে এটা সম্ভব না। তাদের মধ্যকার এই লেনদেনের কারণেই মাঠ পর্যায়ে অনেকে চাইলেও ব্যবস্থা নিতে পারেন না ওপর মহলের কারণে।
চালের ক্ষেত্রে যেটা হয় তা হলো- সরকারের হাতে পর্যাপ্ত চালের মজুত থাকে না, যতটা থাকে মিলারদের হাতে। তারা তাদের সুবিধা মতো বাজারে চাল ছাড়ে। আলুর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। এটা তো সরকারের হাতে থাকে না। থাকে কোল্ড স্টোরেজ ও ব্যবসায়ীদের কাছে। বন্যার কারণে যখন সবজি উৎপাদন ব্যাহত হয়, তখন আলুর ওপর চাপ পড়ে। আলুর চাহিদা যখন বেড়ে যায়, তখন কোল্ড স্টোরেজ থেকে পর্যাপ্ত আলু বাজারে ছাড়া বন্ধ করে দেয়। পেঁয়াজের ক্ষেত্রে আমাদের ঘাটতি আছে। কিন্তু ভারত রফতানি বন্ধ করলে বাজারে সংকট তৈরি হয়। তখন অন্য জায়গা থেকে দ্রুত আমদানি করে ঘাটতি পূরণ করতে উদ্যমী হয় না সরকার। দেশীয় অসাধু বাণিজ্য সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজারে কারসাজি এবং ভারতের রফতানি নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি অতিমাত্রায় ভারতের ওপর পেঁয়াজ আমদানির জন্য নির্ভরতা অন্যতম কারণ বারবার পেঁয়াজের দাম বাড়ার।
শুধু চাল, আলু আর পেঁয়াজ নয়, আরও অনেক কিছুতেই সিন্ডিকেট রয়েছে। ভোজ্যতেলেও তো সিন্ডিকেট কাজ করে। এই সিন্ডিকেট অনেক শক্তিশালী এবং এদের হাত অনেক লম্বা। শুধু এই সরকার নয়, সব সরকারের আমলেই এরা সক্রিয় ছিল এবং এখনও আছে।
দ্রব্যের বাজারে এই সিন্ডিকেট প্রথা ব্যাপক অর্থে দুর্নীতি, কারণ এটি নীতিনৈতিকতা-বহির্ভূত কাজ। এই দুর্নীতি রুখতে এখনই বাজারে নজরদারি বাড়ানো দরকার। এমনিতেই এখন সবকিছুরই বাজার দর চড়া। ফড়িয়া বা সিন্ডিকেটের দৌলতে চড়া দর আরও চড়া হওয়ায় বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে গরিব ও মধ্যবিত্তের জীবনধারণ। তাই মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে যেমন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সক্রিয় ভূমিকা চাই, তেমনই অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিভাগকেও সজাগ সতর্ক থেকে কালোবাজারি বা অযথা পণ্যদ্রব্য মজুত করার প্রচেষ্টা বন্ধ করতে হবে। বাজার দর নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নিতে হবে দৃশ্যমান কড়া পদক্ষেপ।
লেখক: সাংবাদিক
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
সান নিউজ/এফএইচপি