আহমদ রফিক
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র হওয়ার সুবাদে একটি কথা বারবার মনে হয়েছে, দরিদ্র ও স্বল্পআয় মানুষের জন্য এখানে জরুরি দরকার উন্নতমানের চিকিৎসাসেবার উপযোগী একটি দাতব্য হাসপাতাল। কিন্তু ভাষা আন্দোলন থেকে গণতন্ত্রী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে আমার শিক্ষাজীবনে বিপর্যয় ও জীবনসংগ্রামের ব্যস্ততার মধ্যে ভেবেছি- বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
উচ্চশিক্ষা ও অর্থবিত্ত থেকে অনেক দূরে অবস্থানের কারণে উল্লিখিত চিন্তা। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর 'গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র' প্রতিষ্ঠা ও ঢাকা শহরে সুলভমূল্যে সর্বজনীন চিকিৎসাকেন্দ্র 'নগর হাসপাতাল' বা ডা. কামরুজ্জামানের একই রকম 'কমিউনিটি হাসপাতাল' স্থাপন দেখে খুশি হয়েছি। কিন্তু এগুলো আমার চিন্তার হাসপাতাল থেকে বেশ দূরে, যদিও ওরা সুলভমূল্যে চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকে।
একাধিক ব্যবসা সূত্রে বড় কোম্পানি স্কয়ার অনায়াসে একটি দাতব্য হাসপাতালের দায়িত্ব পালন করতে পারতো, তাদের গোটা হাসপাতাল ব্যবস্থার একাংশে। তারা তা করেনি। অবস্থাদৃষ্টে চিকিৎসা জীবনে প্রতিষ্ঠিত নিউইয়র্ক প্রবাসী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক স্বজন হুমায়ুন কবিরকে বলেছিলাম আমার পরিকল্পনার কথা। ওর প্রবাস জীবন শুরু ১৯৭০ সাল থেকে।
ওদের ব্যাচের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা অনেকে স্বদেশে-বিদেশে অর্থবিত্তে প্রতিষ্ঠিত। ইদানীং ওরা বছরে একবার ঢাকায় 'গেট টুগেদার'-এ মিলিত হয় ক'টা দিন আনন্দে কাটাতে। এবার তাদের জয়তি উপলক্ষে ওরা একত্র হয়েছিলো। ঢাকা মেডিকেল কলেজ মিলনায়তনে ওদের সম্মিলনে আমাকে ডেকেছিলো বিশিষ্ট অতিথি রূপে। সে সুযোগে আমি হুমায়ুনকে এ প্রস্তাবটি করি। ওরা বিশ-পঁচিশ বা চল্লিশজন মিলে নিজেদের স্মরণীয় করে রাখতে পরে উল্লিখিত ধরনের একটি দাতব্য হাসপাতাল গড়ে তোলে। কথাটা আমি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. নাজমুন্নাহারকেও বলি। দু'জনের একই প্রতিক্রিয়া। অর্থাৎ এ আহ্বানে সাড়া মিলবে না।
ওরা অবশ্য কথা বলেছিলো অন্য কোনো সহপাঠীর সঙ্গে। আমি নিজেও আমার বক্তব্যে এ পরিকল্পনার কথা বলি কিছুটা মানবিক আবেগ সহকারে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করি, দু-চারজন বাদে কেউ কথাগুলো মন দিয়ে শোনেনি। ওরা নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল ছিলো। পাশে বসা ডা. নাজমুন ফিসফিস করে বলেন, বাদ দিন, অন্য কথা বলুন। ওখানে ডা. কাজী তামান্নাও ছিলো।
এই হলো আমাদের বিত্তবান বিশেষজ্ঞ মহলের চালচিত্র। দু-চারজন যে ব্যতিক্রম নন, তা বলা যাবে না। তবে বাণিজ্যেই সবার ঝোঁক। আমার চেনাজানাদের মধ্যে অনেকে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন করেছেন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মুনাফা ও বিত্তের টানে।
অথচ শিক্ষার্থী জীবনের সূচনায় এরা সবাই এ লাইনে পড়ার লক্ষ্য হিসেবে জনসেবার কথা বলেছে অনেকটা শপথবাক্য উচ্চারণের ভঙ্গিতে। আত্মসেবা পেশাগত জীবনে গৌন। কিন্তু বাস্তবে পেশাগত জীবনে এর বিপরীতটাই লক্ষ্য করা গেছে। পেশাজীবীর জীবনে বাস্তবে লক্ষ্য থাকে একটাই- অর্থবিত্ত, খ্যাতি ও সমৃদ্ধিতে সাত রং ফুটিয়ে তোলা। তাতে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য ব্যক্তিভেদে হয়তো ভিন্ন- তবু ইতির দিকটাই প্রধান।
চিকিৎসা পেশার ক্ষেত্রটিও উচ্চস্তরে ভিন্ন নয়, পূর্বোক্ত লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে। যদিও এক্ষেত্রে জনসেবার সুযোগ সবার চাইতে বেশি। তেমনি সুযোগ মানুষের শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা অর্জনের। ব্যতিক্রমীদের কথা বাদ দিলে বলতে হয়, এরা সবাই বা অধিকাংশই জনসেবামূলক আদর্শ পালনে আগ্রহী বলে মনে হয় না। বিশ্বাসী তো নয়ই। দাতব্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দরিদ্র বা নিম্ন আয় মানুষের চিকিৎসাসেবার কাজটি তাদের দশজন বা বিশজনে মিলে করতে পারে, স্মরণীয়-বরণীয় হওয়ার সে সহজ কাজেও তাদের আগ্রহের নিতান্ত অভাব।
দুই.
সম্প্রতি আমার জন্মদিন উপলক্ষে অভাবিত বেশ কিছু লেখালেখি হলো। এর মধ্যে ইসমাইল সাদীর লেখাটি কেন্দ্র করে ফেসবুকে তরুণদের মধ্যে আমাকে নিয়ে লেখার আলোড়ন ও কিছু ভুল বোঝাবুঝি দুই-ই হলো। এসবের পরিণামেই কিনা জানি না, ফেসবুকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসকের ঘোষণা ভাষাসংগ্রামী আমার চিকিৎসা-সংক্রান্ত সব দায়িত্ব গ্রহণের।
প্রতিক্রিয়ায় আমার একান্তজন সবারই বিস্ময়। পরে আমাকে ওই ডাক্তার সাহেবের ফোনকলে তার ও তার প্রতিষ্ঠানের পরিচয় জানা গেলো। তিনি ডা. হারুন এবং হাসপাতালটির নাম শমরিতা। একসময় এর খুবই পরিচিতি ছিলো স্কয়ার হাসপাতালের প্রস্তাবিত আবির্ভাবের আগে। কয়েকজন ডাক্তারের সমন্বিত প্রচেষ্টার ফসল শমরিতা। সেখানে একসময় আমাদের বৃহত্তর পরিবারগুলোর যাতায়াত ছিলো চিকিৎসাসেবা নেওয়া উপলক্ষে। যেমন অধুনালুপ্ত স্বনামখ্যাত 'দৈনিক বাংলা' পত্রিকার সম্পাদক আহমেদ হুমায়ুন ও আরও অনেকে।
এবার আমার অসুস্থ গৃহকর্মীর সেখানে ফ্রি-বেড-এ ডা. হারুনের কল্যাণে ভর্তি হওয়ার সুবাদে জানা গেলো, তিনিও তাদের দু-একজনের মতো ঢাকা মেডিকেল কলেজে আমার স্ত্রীর ছাত্র। আরও জানা গেলো, তাদের হাসপাতালে কয়েকটি ফ্রি-বেড-এ দরিদ্র রোগীদের বিনা অর্থমূল্যে চিকিৎসার কথা।
আমার মনে পড়ে গেলো, দরিদ্র ও স্বল্পআয় মানুষের জন্য ঢাকা শহরে একটি দাতব্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা নিয়ে আমার পূর্বোক্ত পরিকল্পনা ও অভিজ্ঞতার কথা যা ইতোপূর্বে বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে স্কয়ার, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নামীয় একাধিক হাসপাতালের শ্রীবৃদ্ধি আমাকে আবারও স্মরণ করিয়ে দিলো, আধুনিককালের জনসেবায় চিকিৎসা-সংক্রান্ত চিন্তার মধ্যে চিকিৎসক সমাজের বিশেষত বিশেষজ্ঞ বিত্তবান বিশেষজ্ঞদের শিক্ষার্থী জীবনের নীতিগত শপথ ভাঙার ধারাবাহিক উদাহরণের কথা।
কয়েক হাজার বছর আগে গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস যা পেরেছিলেন, আমরা একালেও আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির চেতনা নিয়ে তা পারছি না। শুধু তাই নয়, প্রাচীন গ্রিকগুরু প্রবর্তিত চিকিৎসাসেবা সংক্রান্ত নীতিকথা (মেডিকেল এথিকস) পদে পদে অগ্রাহ্য করছি। তাতে আমাদের চিকিৎসক বিবেক আহত হচ্ছে না। আবারও বলি, ব্যতিক্রম অতি অল্প।
চিকিৎসাসেবার উল্লিখিত ব্যাপক বাণিজ্যিক শ্রীবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে স্বীকার করি যে, একই সঙ্গে আমাদের সমাজে উচ্চমধ্যবিত্ত থেকে বিত্তবান শ্রেণিতেও অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি যথেষ্ট ঘটেছে, যেজন্য বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর এত রমরমা চিকিৎসা বাণিজ্য। কিন্তু ভুলি কেমন করে রোগাক্রান্ত দরিদ্র ও নিম্ন আয় মানুষের চিকিৎসা-সংক্রান্ত দুর্ভোগের কথা। অনেকগুলো উদাহরণ আমাকে তা স্মরণ করিয়ে দেয়।
তাই ডা. হারুনের (শমরিতা) ভাষাসংগ্রামীর প্রতি সহানুভূতি যেমন আমাকে স্পর্শ করেছে, তেমনি তাদের কয়েকটি ফ্রি-বেড দেখে মনে হয়েছে তারা তো পারেন তাদের সম্প্রসারিত হাসপাতালের একাংশে পূর্বোক্ত দাতব্য চিকিৎসালয়টি স্থাপন করতে; সদিচ্ছার অভাবে ডা. হুমায়ুন-নাজমুনের বন্ধুরা যা পারেনি।
আমার চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণে ডা. হারুনের প্রস্তাবের নেপথ্যে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন আমার স্নেহভাজন এক সাংবাদিক। তিনিও পারেন আমার প্রস্তাবিত বিষয়টিকে শমরিতাকে কেন্দ্র করে একাধিক দৈনিকের পাতায় প্রসারিত করায় হাত লাগাতে।
এই দুই পক্ষকেই আমি অনুরোধ জানাই, আমার ব্যক্তিগত চিকিৎসার চেয়ে অনেক জরুরি আমার স্বপ্নের হাসপাতালটি নিয়ে বাস্তবায়নের ভাবনা। তাতে শমরিতা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সেই সঙ্গে উদ্যোক্তারা। আর তা বাস্তবের মুখ দেখলে জীবন সায়াহ্নে অনেক শান্তি মিলবে। ভাবব ভবিষ্যতে একই পথে আরও অনেকে এগিয়ে আসবেন।
ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক, কবি, প্রাবন্ধিক
সান নিউজ/এফএআর