সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সদ্য সাবেক শিক্ষার্থী মাসুদ আল মাহাদী অপু আত্মহত্যা করেছেন। এর আগে আত্মহত্যা করেছেন ইভানা লায়লা চৌধুরী নামের এক নারী। স্কলাসটিকা স্কুলে ইউনিভার্সিটি প্লেসমেন্ট সার্ভিসেসের উপ-ব্যবস্থাপক হিসেবে চাকরি করতেন তিনি।
অভিযোগ উঠেছে, স্বামীর পরকীয়ার কারণেই তিনি আত্মহত্যা করেছেন। বেশ কয়েক দিন থেকেই স্বামী ও শ্বশুরবাড়ি থেকে বিভিন্ন মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলেন তিনি। অথচ এই বিয়ের জন্য তাকে একদিন ব্যারিস্টার হওয়ার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিতে হয়েছিল। পরিবারের চাপে ব্যারিস্টারি পড়তে বাইরে যাওয়া হয়নি তার।
অন্যদিকে অপুর শিক্ষকদের কয়েকজন ফেসবুকে লিখেছেন তাকে নিয়ে। অপু প্রতিবাদী ছিলেন, সাহসের সঙ্গে বৈরী পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সময় নেতৃত্ব দিয়েছেন। সাহসী প্রতিবাদী মানুষ কেন আত্মহননের পথ বেছে নিলো সেটা ভাবছি। চরম অবসাদ বা হতাশায় আত্মহননের পথে চলে যায় মানুষ।
আত্মহত্যা মানসিক অসুস্থতা নাকি মানসিক জটিলতা, এ নিয়ে আমার সংশয় আছে। কিন্তু প্রতিটি কেইস হয়তো গভীরভাবে অনুসন্ধান করলে পাওয়া যেতে পারে যে এগুলোর পেছনে কোনও না কোনও প্ররোচক আছে।
অপু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন, ইভানা ব্যারিস্টার হতে চেয়ে ব্যারিস্টারের স্ত্রী হয়ে সুখী হতে পারেননি। যে সিস্টেম অপুকে শিক্ষক হতে দেয় না, ইভানাকে গৃহবন্দি করে, সেই সিস্টেমের সঙ্গে মানুষ লড়াই করতে করতে একসময় হেরে যায়। মানুষের প্রাপ্য ও সম্মান বিষয়ে দায়িত্ববোধ ও সচেতন হওয়ার সংস্কৃতিই নেই আমাদের মাঝে।
আত্মহননের ঘটনা বাড়ছে। নানা সংকট, নানা জটিলতায় মানুষ এটা করছেন। দু’একটি ঘটনা যখন আলোচনায় আসে, তখন আমরা দেখি কিছু কারণের কথা বলা হচ্ছে, সেই মানুষটাকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য কিছু মানুষের ভূমিকার কথা উঠে আসছে। তাই আত্মহত্যার ঘটনা কেবলই কোনও নিভৃত কাণ্ড নয়। নিজেকে খুন করছেন মানেই হলো তারা আর এ সমাজে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারছেন না। আইনে প্ররোচনার কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই।
তা নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপরে। মৃত যদি সুইসাইড নোটে কাউকে দায়ী করে যান, তার বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা হতে পারে। তা না হলে পুলিশ দেখবে, কারও কথা বা আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষটি এই রাস্তা বেছে নিয়েছেন কিনা। কিন্তু সেই তদন্তটা জোরালোভাবে হয় না তেমন।
শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা কেন হয়, তা জাতীয়ভাবে খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ইদানীং পড়ালেখা ও ফলাফল নিয়ে আগের চাইতে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। পড়াশোনা এখন পরিণত হয়েছে অস্থির সামাজিক প্রতিযোগিতায়। যেখানে মা-বাবা সন্তানের পরীক্ষার ফলকে সামাজিক সম্মান রক্ষার হাতিয়ার বলে মনে করেন। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে একটা ছেলে বা মেয়ে যখন ভাবে পড়ালেখা শেষ করে কী করবে, তখন রাজ্যের হতাশা তাকে ডুবিয়ে দিতে থাকে।
আমাদের নগরায়ণ বাড়ছে। ছোট শহর বড় হয়ে যাচ্ছে, বড় শহর মেগাসিটি হচ্ছে। গ্রামেও নগরায়ণের ছোঁয়ায় পরিবেশ এবং প্রতিবেশ বদলে যাচ্ছে। কেন্দ্র থেকে প্রান্ত – আমরা জীবনযাপন করছি শহুরে অমানবিকতায়। অপু কিংবা ইভানা, কিংবা এমন অনেকে যারা নিজেদের প্রাণটি নিজেরাই কেড়ে নেওয়ার মতো চরম দুঃসাহসিক কাজটি সমাধা করেছেন, তাদের কোথায় বেদনা ছিল কেউ জানবে না।
জানতে ইচ্ছে করে, কী এমন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় যে এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারে একজন মানুষ। অপুর পরিবার বা তাদের বন্ধুরা কি জানতো তাদের কষ্ট কোথায় ছিল, কেমন ছিল? তারা আমাদের মতোই স্বাভাবিক ছিল। তাদেরও ভালোবাসা ছিল, তিক্ততা ছিল, বই পড়া, টিভি দেখা, সামাজিকতা করা, সবই ছিল। তাহলে হঠাৎ তার মনে এমন কী জেগে উঠলো যে নিজেকে সে এই পৃথিবী থেকে, সব প্রিয়জন থেকে সরিয়ে নিলো? জীবনটাকে কতটা ফাঁপা তেতো বোঝা মনে হলে এই জীবন থেকে এমন জোরপূর্বক ছুটি নেওয়া যায়?
আত্মহত্যার প্রবণতার সঙ্গে অর্থনৈতিক যোগ আছে কিনা সেটাও ভেবে দেখা দরকার। আত্মহত্যার প্রবণতা বোধহয় কয়েকগুণ বেড়েছে এই অতিমারির পরিস্থিতিতে। বেকার যুবক, কর্মচ্যুত শ্রমিক — অনেকেই হয়তো বেছে নিচ্ছেন এই অন্তিম পথ।
গত ১০ সেপ্টেম্বর ছিল বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। দিবসটি পালনও করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-নির্দেশনা ও পরামর্শদান দফতর এবং এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের যৌথ উদ্যোগে আগের দিন ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র চত্বরে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান আত্মহত্যা প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। সমাজে অস্বাভাবিক মৃত্যু প্রত্যাশিত নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আত্মহত্যার প্রবণতা রোধে তরুণ প্রজন্মকে সচেতন, সক্ষম ও আত্মনির্ভরশীল হয়ে গড়ে উঠতে হবে।
কথাগুলো ভালো, কিন্তু কাজটা করবে কে? আমাদের চারপাশে অনেক হতাশা ও অবসাদ আক্রান্ত মানুষ দেখি। তাদের বোধ, তাদের উপলব্ধি আমরা বুঝতে চাই কম। তারা হয়তো আত্মহননের কথা কখনও কখনও বলেও ফেলেন। কিন্তু আমাদের কাছে সব সময় এমন যুক্তি থাকে না, যা দিয়ে তার চলে যাওয়ার ইচ্ছেটা ঠেকাতে পারি। স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে কাছে টেনে নেওয়ার এই ভাবনাটা নিয়ে ভাবা দরকার। অবসাদের অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছে গেলে অনেকে মনে করেন যে আর কোনও দরজাই খোলা নেই। আত্মহত্যার কথা মাথায় এলে জীবনের ইতিবাচক দিকগুলো দেখা প্রয়োজন আর সে রকম উদ্যোগ সামাজিকভাবেই প্রত্যাশিত। প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা ও সহমর্মিতা।
লেখক: সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সান নিউজ/এনকে