এম এম রুহুল আমিন:
২৫ মে ২০২০ তারিখে আমেরিকার মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপোলিশ শহরের একটি রেস্তোরাঁর নিরাপত্তা কর্মী ৪৬ বৎসর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডকে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার ডেরেক চাওভিন হাঁটু দিয়ে গলা চেপে মেরে ফেলে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচণ্ড গতিতে ছড়িয়ে পড়া জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ মিছিল কাঁপিয়ে দিচ্ছে সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। ঘটনাটির ভয়াবহতার গুরুত্ব বিবেচনায় অধিকাংশ শহরে জারি করা হয়েছে কারফিউ। এসব বিক্ষোভ হয়ত সহসা থেমে যাবে। সমসাময়িক করোনাকালের ক্ষতির সাথে যোগ হওয়া এই অপূরণীয় ক্ষতি বিশাল ক্ষতচিহ্ন রেখে যাবে আমেরিকার সামাজিক ও আর্থিক অঙ্গনে।
নানা কারণ ও প্রেক্ষাপটে আমেরিকায় হত্যা নতুন কিছু না। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, শুধুমাত্র ২০১৯ সালেই ১০১৪ জনের হত্যার ঘটনা ঘটেছে, যার বেশীর ভাগই কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন নাগরিক।
উল্লেখযোগ্য খুনের মধ্যে ট্রেইভন মান্টিন ২০১২, এরিক গার্নার ২০১৪, মাইকেল ব্রাউন ২০১৪, ওয়াল্টার স্কট ২০১৫, ফ্রেডি গ্রে ২০১৫, সান্ডা ব্লান্ড ২০১৫, আতাতিয়ানা জেফারসন ২০১৯ এবং ব্রেওনা টেলর ২০২০ বহুল আলোচিত ও নিন্দিত।
মার্কিন ইতিহাসে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা পরপর দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন শেষে ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে বিদায়ী ভাষণে তিনটি বিষয়ে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেন। বর্ণবাদ, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিভক্তি।
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র আমেরিকায় বর্ণবৈষম্য দূর করতে অগ্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটনের লিঙ্কন মেমোরিয়ালের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে 'I have a dream' ঐতিহাসিক ভাষণটি দেন।
এই ভাষণে তিনি নিগ্রোদের প্রতি অত্যাচারের কথা, তাদের বৈষম্যের শিকার হওয়ার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেছেন তার স্বপ্নের কথা। স্বপ্ন দেখেছেন সাম্যের, স্বপ্ন দেখেছেন শোষণমুক্ত এক সমাজের যেখানে সব মানুষ সমান হবে।
সেই লুথার কিং জুনিয়রকে ১৯৬৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রব্যাপী প্রবল বর্ণবৈষম্য বিরোধী আন্দোলন চলাকালীন হত্যা করা হয়েছিল। গত শনিবার মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র কন্যা বার্নিস কিং সমগ্র আমেরিকাবাসীকে আহবান করেছেন "আসুন আমরা সবাই অহিংস পথে এই বিদ্বেষ দানবকে হত্যা করি।"
আমেরিকার রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ভাষ্যকার স্টিফেন লেন্ডমান বলেছেন আমেরিকার প্রায় সব বড় শহরে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ হচ্ছে এবং তা প্রকৃতপক্ষে একজন নাগরিক হত্যার জন্য নয়, বরং সমাজের বিদ্যমান অবিচার ও সহিংসতার বিরুদ্ধে জনগণ ফুঁসে উঠেছে। এটি মার্কিন সমাজ ব্যবস্থা, সীমাহীন যুদ্ধ ও রাষ্ট্রীয় মদদে পরিচালিত সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। লেন্ডমান আরো বলেন, আমেরিকায় যা হচ্ছে তা নতুন কিছু নয় বরং ঔপনিবেশিক আমল থেকেই এটি বর্তমান সময় পর্যন্ত চলে আসছে।
আমেরিকার সামাজিক-সাংস্কৃতিক শক্তির সবচেয়ে বড় দিক হলো বহুমত, বহুজাত, বহুবর্ণ ও বহু সংস্কৃতি। ফলে ব্যক্তিভেদে মতের ভিন্নতা খুবই স্বাভাবিক। কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ডও তার ব্যতিক্রম নয়। এটা ডেরেক চাওভিনের একান্ত ব্যক্তিগত দায়। রাষ্ট্র চাওভিনকে কখনও কাউকে নির্মম হত্যায় দায়িত্ব দেয় নাই। চাওভিন গ্রেফতার হয়েছে; থাকছে জেলের রাতদিন ২৪ ঘণ্টা 'সুইসাইড ওয়াচে' সেলে, হারাতে যাচ্ছে আইনগত বিচ্ছেদে প্রিয়তমা স্ত্রী ক্যালি চাওভিনকে। আর আগামীর বিচার তো থাকছেই। তবে ব্যক্তির দায়ের খেসারত বহন করছে সমগ্র আমেরিকাবাসী, যা কখনই কাম্য হতে পারে না।
কী পরিস্থিতিতে ডেরেক ফ্লয়েডকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল তার চুল-চেরা বিশ্লেষণ নিশ্চয়ই সমগ্র বিশ্ব জানবে। তবে ভুলবশত: আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার অপরাধ ডেরেক কখনও অস্বীকার করতে পারবে না। শাস্তি তার হবেই। আর কখনও পারবে না একটি কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের স্বপ্নের অকাল মৃত্যুর দায় এড়াতে।
লেখক: সদস্য জাতীয় প্রেস ক্লাব ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।