কোভিড-১৯ প্রতিরোধ এবং ৩১ মে থেকে পূণরায় উন্মুক্ত করা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ এর বিবৃতি:
বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ একটি নাগরিক উদ্যোগ। তথ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে স্বাস্থ্যনীতি পর্যালোচনা এবং জনগণের মতামত নিয়ে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহিতার উন্নয়নে কাজ করছে বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ। দেশে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি এবং অযাচিত মৃত্যুর হার ঊর্ধ্বমূখী হওয়ায় বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
অন্যদিকে, কোভিড-১৯ আক্রান্তদের নমুনা পরীক্ষার অনুপাতের দিক বিবেচনা করলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তালিকার নীচের দিকে রয়েছে। কোভিড-১৯ প্রতিরোধে সাধারণ মানুষের মধ্যে নূন্যতম শিষ্টাচার না মানার প্রবণতা এবং ক্রমবর্ধমান ভয় ও সামাজিক স্টিগমার মত বিষয়গুলোও একইভাবে উদ্বেগজনক।
বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ মনে করে কোভিড-১৯ এর মতো বৃহত্তর ও জটিল সঙ্কট মোকাবেলায় সামগ্রিকভাবে দেশের মধ্যে একটি সামাজিক অংশীদারিত্ব দরকার। যেখানে সমাজের প্রতিটি গোষ্ঠী ও ব্যক্তি এই কোভিড যুদ্ধে সম্মিলিতভাবে কাজ করবে। যেমনটি আমরা করেছি মুক্তিযুদ্ধের সময়। দু:খজনকভাবে এই সামাজিক অংশীদারিত্বের বিষয়টি এক্ষেত্রে অনুপস্থিত। বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ মনে করে, ৩১ মে থেকে ‘পুণরায় সবকিছু খুলে দেওয়ার যে পরিকল্পনা করা হয়েছে সেখানে আগামীদিনে কোভিড-১৯ এর সম্ভাব্য পরিণতি এবং এর সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক দিক যথাযথভাবে বিবেচনায় রাখা হয়নি।
বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ নিম্নের সুপারিশমালা তুলে ধরছে:
পূণরায় সব উন্মুক্ত করার বিষয়ে করণীয়:
১. কোভিড আক্রান্তের হার চুড়ান্ত পর্যায়ে র্পোঁছানোর ওপর ভিত্তি করে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশই বিধি নিষেধ শিথিল করেছে অথচ এখনও বাংলাদেশের সঠিক অবস্থান নিরূপন করা সম্ভব হয়নি। সমাজের দুর্বল অংশ এবং জাতীয় অর্থনীতির দুর্দশার মতো আরও অনেক প্রতিবন্ধকতার কথা বিবেচনা করে, সরকার ইতিমধ্যে কৃষি এবং তৈরি পোষাক খাত চালু করেছে, যদিও তাদের মধ্যে কোভিড -১৯ এর প্রভাব সম্পর্কে আমরা এখনও কিছু জানি না। এক্ষেত্রে সেক্টর অনুযায়ী ধীরে ধীরে সাধারণ ছুটি শিথিল করার নীতি অনুসরণ করা উচিত। এই প্রক্রিয়ায় ক্ষেত্রে এলাকা ভিত্তিক সাধারণ ছুটি বা লকডাউন শিথিল করা কিংবা উন্মুক্ত করার ব্যাপারে সুপারিশ করা হচ্ছে। যেমন, দশটি জেলা চিহ্নিত করে খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেখানে কম সংখ্যক সংক্রমণ রয়েছে এবং খুলে দেওয়ার পরের প্রভাব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা। এটি সরকারকে কম ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সর্বোত্তম উপায় খুঁজে পেতে সহায়তা করবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার বিষয়টিও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
২. কোভিড-১৯ সংক্রমনের প্রকোপ বিবেচনায় রেখে পুণরায় খোলার প্রভাব বৈজ্ঞানিকভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে যাতে কোনও নেতিবাচক ফলাফল সহজেই এবং তাৎক্ষণিকভাবে নির্ণয় করা যায় এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতি অনুয়ায়ী কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। আমাদের দেশে অনেক ভাল ভাল প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা তথ্য ও উপাত্ত নিয়ে কাজ করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এদের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই পরোক্ষভাবে কাজ করছে কিংবা নিষ্ক্রিয় রয়েছে।
৩. এসব প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে রয়েছে আইইডিসিআর, বিবিএস, বিআইডিএস এবং বিশ্ববিদ্যালসমূহ। কোভিড-১৯ সংক্রমনের প্রকোপ বিবেচনায় রেখে পুণরায় খোলার প্রভাব পর্যবেক্ষণের জন্য এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, সক্রিয় করা, তাদরকে সমর্থন করা এবং শক্তিশালী করার জন্য সরকারি পদক্ষেপ প্রহণ করা উচিত। প্রাইভেট ও বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলিকেও এই তদারকির ভূমিকা পালনে উৎসাহ প্রদান এবং সমর্থন করা উচিত। এক্ষেত্রে ৩ ‘T’ এর বার্তা (Test পরীক্ষা, Trace সনাক্ত Treat এবং চিকিৎসা) কঠোরভাবে মেনে চলা, ধর্মীয়ভাবে প্রয়োগ এবং ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
স্বাস্থ্যসেবার উপর গুরুত্ব আরোপ
কোভিড-১৯ সংক্রমণের এই যুদ্ধ জয়ের ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা হাসপাতাল থেকে কমিউনিটি পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে।
৪. কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সহ সকল প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলি শক্তিশালীকরণ ও ক্ষমতায়ন করা উচিত। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র হওয়া উচিত স্বাস্থ্যসেবার প্রথম ধাপ। এইসব কেন্দ্রে পরীক্ষা, আইসোলেশন এবং প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানের প্রয়োজনীয় সুবিধা থাকতে হবে। পরবর্তীতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকে পাঠানো রোগীদেরকেই কেবল কোভিড -১৯ হাসপাতাল গ্রহণ করবে।
৫. দেশে হাজার হাজার কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছে যারা প্রশিক্ষিত, বিশ্বস্ত এবং সহজে যাদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব তাদের কাজে লাগাতে হবে। সঠিকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি, হাত ধোয়ার নতুন কৌশল ও শরীরীক দূরত্ব বজায় রাখার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে তা ভালোভাবে বোঝাতে হবে। ভয় ও সামাজিক স্টিগমা কমানো এবং লক্ষণযুক্ত/সন্দেহজনক রোগীদের চিহ্নিত করা এবং প্রাথমিক স্বাস্থসেবা কেন্দ্রে পাঠানোর ক্ষেত্রে তারাই হতে পারে অগ্রগামী সৈনিক।
করোনা পরবর্তী নতুন স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া
কোভিড -১৯ সংকট আমাদের বিদ্যমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আরও সীমাবদ্ধতা এবং দুর্বলতাগুলি প্রমাণ করেছে। বর্তমান সংকট থেকে সর্বোত্তম উপায়ে বেরিয়ে আসতে হবে। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে আমাদের যে নতুন শিক্ষা নেবার সুযোগ হয়েছে সেটিকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে হবে। নতুন, কার্যকর, সকলের সমান চিকিৎসা পাবার অধিকার নিশ্চিত করে ভবিষ্যতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিকল্পনা করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
৬. দু:খের বিষয় হলো সারা বিশ্বের সাথে তুলনা করলে দেখা যায় বাংলাদেশ সরকার স্বাস্থ্যখাতে জিডিপির সবচেয়ে কম ব্যয় করে। আগামী ২ থেকে ৫ বছরের মধ্যে ধীরে ধীরে এই ব্যয়ের মাত্রা বর্তমান এর ০.৪% থেকে ২.৫% এ উন্নীত করার সময় এসেছে।
৭. সবার জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে আরো দায়িত্বশীল করতে দেশের সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। উল্লেখ্য, সরকার সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়কে বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা করার সময় কিভাবে তা অর্জন করা হবে তার একটি সুবিস্তৃত ও কৌশলগত পরিকল্পনা থাকা দরকার।
পরিপূর্ণ সামাজিক অংশীদারিত্ব নীতি নিশ্চিতকরণ
কোভিড -১৯ এমন এক সঙ্কট নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে যেটি কাটিয়ে উঠতে সমাজের প্রত্যেকের দায়িত্বশীল অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যক্রমে, সরকারের গৃহিত বর্তমান পদক্ষেপসমূহ সমাজের সিংহভাগকেই নিষ্ক্রিয় এবং সাধারণ দর্শক হিসেবে বাইরে রেখেছে।
৮. সরকারের উচিত বিভিন্ন কমিটি (যেমন জাতীয় কমিটি, সমন্বয় কমিটি, বিভাগ, জেলা ও উপজেলা কমিটি) পুনর্গঠন করা এবং জাতীয় প্রচেষ্টায় অবদান রাখতে সুশীল সমাজ, এনজিও, শিক্ষাবিদ, গণমাধ্যম, বেসরকারি খাতসহ সমাজের বিভিন্ন বিভাগের প্রতিনিধিদের নিয়ে আসা উচিত। ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যবৃন্দ, নারী, শিক্ষক, কমিউনিটি স্বাস্থ্য কর্মী, ইমাম এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের বিভিন্ন বিভাগের অংশগ্রহণে প্রতিটি গ্রামে ও পাড়ায় কোভিড- ১৯ প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা উচিত।
৯. কোভিড-১৯ এর মত জরুরি অবস্থা মোকাবেলার জন্য সর্বোত্তম বৈজ্ঞানিক কৌশল সম্পর্কে সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য অবিলম্বে একটি সাইন্টিফিক অ্যাডভাইজরি গ্রুপ গঠন করা দরকার। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এই জাতীয় কমিটি রয়েছে। এর মধ্যে জনস্বাস্থ্য, চিকিৎসা, অর্থনীতি, ব্যবসা, সামাজিক বিজ্ঞান এবং কমিউনিকেশন বিষয়ক সকল শাখার বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
“পরিপূর্ণ সামাজিক অংশীদারিত্ব”
বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ, ঢাকা