মতামত

শিক্ষা খাতে চাই মেগা প্রকল্প

আবু সাঈদ খান

গত ১২ সেপ্টেম্বর শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটেছে। দেড় বছর পর তারা স্কুল-কলেজে ফিরেছে। স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার কড়াকড়িতে প্রাণের উচ্ছ্বাস প্রকাশে তাদের থাকতে হয়েছে সংযত। তবে চোখেমুখে ছিল আনন্দের ঝিলিক।

শিক্ষাঙ্গনে ফেরার এই আনন্দ মিছিলে শরিক হতে পারেনি বা পারছে না বেশ কিছু শিক্ষার্থী। এরা অনেকেই সেইসব ভাগ্যাহত বাবা-মায়ের সন্তান, যারা করোনার থাবায় কাজ হারিয়েছেন, কিংবা ব্যবসা গুটিয়েছেন। তাই তাদের সন্তানরা জীবন ধারণের জন্য নানা কাজে জড়িয়েছে কিংবা কাজের খোঁজে হন্যে হয়ে ফিরছে। কর্মহীন হয়ে পড়ায় অনেক নর-নারী শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। তাদের ছেলেমেয়েরা শহরেই পড়ত। এসব ছেলেমেয়ের স্বপ্নও টুটে গেছে বা টুটে যাওয়ার উপক্রম। এভাবেই অনেক স্বপ্নাহত-ভাগ্যাহত শিক্ষার্থী এখন ঝরে পড়াদের মিছিলে। এই মিছিলে রয়েছে বাল্যবিয়ের নির্মম শিকার মেয়ে শিক্ষার্থীরা। ১৩ সেপ্টেম্বর সমকালের খবরে প্রকাশ, করোনাকালে ১৩ হাজার ৮৮৬ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়া নতুন কিছু নয়। প্রতি বছর দারিদ্র্য, ফসলহানি, নদীভাঙন ইত্যাদিতে আক্রান্ত পরিবারের অগণিত শিক্ষার্থীকে স্কুল-কলেজ ছাড়তে হয়। তারা কৃষি বা অন্য পেশায় যোগ দেয় কিংবা বেকারের কাতারে শামিল হয়।

বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০১৭ সালে ঝরে পড়ার হার ১৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ, ২০১৮ সালে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ ও ২০১৯ সালে ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ। মাধ্যমিকে ২০১৭ সালে ঝরে পড়ার হার ৩৭ দশমিক ৮১ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৩৭ দশমিক ৬২ শতাংশ এবং উচ্চ মাধ্যমিকে ২০১৭ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ ও ২০১৮ সালে ১৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ (কালের কণ্ঠ ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০)। এই পরিসংখ্যানে দেখা যায়, তিন স্তরেই ঝরে পড়ার হার ছিল নিম্নমুখী। করোনার কারণে সর্বস্তরেই ঝরে পড়ার হার বিপুলভাবে যে বেড়ে যাবে, তা নিয়ে সংশয়ের সুযোগ নেই।

কেবল শিক্ষার্থীই নয়; করোনার থাবায় ঝরে পড়েছে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা অধিক। রাজধানীসহ সারাদেশে অসংখ্য কিন্ডারগার্টেন রয়েছে। বেশিরভাগেরই ভাড়া বাড়িতে ক্লাস চলত। শিক্ষার্থীদের বেতনই তাদের আয়ের একমাত্র উৎস। করোনার কারণে শিক্ষার্থীদের বেতন বন্ধ হয়ে গেলে ভাড়া মেটাতে না পারায় স্কুলঘর ছেড়ে দিতে হয়। তাই অনেক স্থানেই দেখা যায়, যেখানে করোনার আগে স্কুলের সাইনবোর্ড ছিল, সেখানে এখন অন্য ভাড়াটিয়া উঠেছেন। কোথাও কিন্ডারগার্টেনের স্থলে মুদি দোকান, আড়ত কিংবা মুরগির খামার করা হয়েছে। শিক্ষকরা পেশা বদল করেছেন। কেউ 'পাঠাও'তে চাকরি নিয়ে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন, কেউ কেউ সবজি ফেরি করছেন; এটা-সেটা করছেন। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, বন্ধ হয়ে যাওয়া কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা ১০ হাজার। এসব স্কুলে যারা পড়ত, তারা এখন কোথায় যাবে? বছরের শেষার্ধে কোন স্কুলে তারা ভর্তির সুযোগ পাবে?

দুর্দশাগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে নন-এমপিও স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা। এসব প্রতিষ্ঠানের সিংহভাগেরই অবস্থান গ্রামে। সেখানেও শিক্ষকরা ছাত্রবেতনের বিনিময়ে কায়ক্লেশে চলতেন। করোনাকালে ছাত্রবেতন প্রায় বন্ধ। শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিরা যে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আগের মতো তা পাওয়া যাচ্ছে না। বলা যায়, দেড় বছর শিক্ষকরা স্কুল থেকে তেমন কোনো আর্থিক সুবিধা পাননি। একবার তারা প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ প্রণোদনা আড়াই হাজার টাকা পেয়েছিলেন। সেখানে এমন শিক্ষকও আছেন, যারা ১০/১৫ বছর ধরে আছেন এই ভরসায়- একদিন স্কুল এমপিওভুক্ত হবে। বলা সংগত, এসব শিক্ষকের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন করার অবকাশ নেই। তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চাকরিবিধি অনুযায়ীই নিয়োগপ্রাপ্ত। বেশিরভাগই এনটিআরসিএর নিবন্ধিত।

অনেককেই বলতে শুনি, বেকার শিক্ষিত যুবকরা চাকরির আশায় এসব প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। যেখানে একটি স্কুল বা কলেজ দরকার, সেখানে তিনটি প্রতিষ্ঠান হয়েছে। এসব সত্য। এক সময়ে পাল্লা দিয়ে কোথাও কোথাও প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রতিষ্ঠান হয়েছে। কিন্তু এখন সে সুযোগ নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে স্থাপনা ও পাঠদানের অনুমতি নিয়ে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা স্থাপন করতে হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ছেলেমেয়েরা মাধমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ছে। অথচ তাদের গড়ার কারিগররা নির্মম বঞ্চনার শিকার। করোনার কবলে তারা ক্ষতবিক্ষত।

কভিড-১৯ আমাদের অমূল্য বহু জীবন কেড়ে নিয়েছে। অনেক দুর্দশার মুখে ঠেলে দিয়েছে। সেই সঙ্গে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে অনেক কিছু। উন্নয়ন প্রচারণার ডামাডোলে চাপা পড়েছিল ভয়াবহ বৈষম্যের খতিয়ান। মানুষে মানুষে সে বৈষম্য বেড়েই চলেছে। বৈষম্য বেড়েছে ধনী ও দরিদ্রে, শহর ও গ্রামের মধ্যে। এর প্রতিফলন দেখছি শিক্ষাক্ষেত্রেও। করোনাকালে তা প্রকটতর।

গ্রামের শিক্ষার্থীরা আর্থসামাজিক কারণে পিছিয়ে ছিল। অতিমারিতে আরও পিছিয়েছে। শহরের স্কুল-কলেজে অনলাইনে ক্লাস হয়েছে। গ্রামে তা সম্ভব হয়নি, বলা চলে। সেখানে অধিকাংশ ছেলেমেয়ের ল্যাপটপ-অ্যান্ড্রয়েড ফোন নেই। আর ইন্টারনেট কানেকশন হচ্ছে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো। বৈষম্য রয়েছে অভিজাত ও অনভিজাত, এমপিও ও নন-এমপিও, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যেও।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে কোথায় দাঁড়িয়েছি আমরা! আজ প্রশ্ন জাগে- একাত্তরে এমন বৈষম্য কি আমরা চেয়েছি? স্বাধীনতার ইশতোরে ছিল- সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে বলেছিলেন, জাতির লক্ষ্য হবে তিনটি- ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র, যা বাংলাদেশের সংবিধানে প্রতিফলিত। তাই বাংলাদেশের চেতনার সঙ্গে এ বৈষম্য খাপ খায় না।

করোনাকবলিত দুনিয়ায় চিন্তাজগতে পরিবর্তন এসেছে। এক সময় ইউরোপের দেশগুলো কল্যাণ রাষ্ট্রের লক্ষ্যচ্যুত হয়ে রাষ্ট্রের সামাজিক দায় কমিয়ে এনেছিল। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বেসরকারিকরণে ঝুঁকেছিল। এখন সেসব দেশের নীতিনির্ধারকরা রাষ্ট্রকে অধিকতর দায়িত্ব গ্রহণের কথা বলছেন। সেসব দেশে তা বাস্তবায়নও হচ্ছে। বাইডেনের যুক্তরাষ্ট্র মানুষের নিরাপত্তাবলয় সম্প্রসারণে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বাড়াতে তৎপর। তবে অথনৈতিক-সামাজিক বৈষম্য কমাতে না পারলে কেবল সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা বাড়িয়ে লাভ হবে না। বৈষম্য অবসানের অন্যতম উপায় হচ্ছে সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা। একটি ঘোষণায় তা হবে না সত্য, তবে সে লক্ষ্যে অগ্রসর হতে হবে।

সরকার স্কুল-কলেজ খোলার পর প্রাথমিক-মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তনের পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার আরও আধুনিকায়নের কথা বলেছেন। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি গৃহীত পদক্ষেপের ব্যাখ্যা করে বলেছেন, এখন থেকে মাধ্যমিক স্তরের সব শিক্ষার্থীই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাবে। সরকারের এ পদক্ষেপ সাধুবাদযোগ্য। তবে শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়নে এখন প্রয়োজন একটি মেগা প্রজেক্ট। এটি সবার বোধগম্য, শিক্ষার মানোন্নয়ন করতে হলে ব্যয় বরাদ্দও বাড়াতে হবে।

শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কতিপয় বিষয়ে আশু পদক্ষেপ জরুরি। ঝরে পড়াদের ফিরিয়ে আনা, বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুলগুলো চালু করা ও দ্রুততার সঙ্গে নন-এমপিও স্কুলগুলোকে এমপিওভুক্ত করা এখন সময়ের দাবি। আর শিক্ষণ ঘাটতি কমিয়ে আনতে টেলিভিশন ও অনলাইনে অঙ্ক, ইংরেজি, বিজ্ঞান ইত্যাদি পাঠদান অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ এসব বিষয়ে সব স্কুলে, বিশেষ করে গ্রামের স্কুলে অভিজ্ঞ শিক্ষক নেই। অনলাইনে পাঠদানের ক্ষেত্রে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট কানেকশন দরকার। দরকার সব শিক্ষার্থীর হাতে ল্যাপটপ, অগত্যা অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন। প্রসঙ্গক্রমে, প্রতিবেশী দেশের পশ্চিমবঙ্গে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতে সরকার একটি ট্যাব কেনার অর্থ তুলে দিয়েছে। গত বছর যারা দ্বাদশ শ্রেণিতে ছিল, তারাও পেয়েছিল। ওরা পারলে আমরা কেন পারি না?

সাংবাদিক ও লেখক

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদ কর্মসূচিতে সংহতি জানালো মুক্তিজোট

গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে সোমবার (৭ এপ্রিল) বিশ্বব্যাপী হরতাল পালনের আহ্বান জ...

ফিলিস্তিনে গণহত্যার প্রতিবাদে লক্ষ্মীপুরে হরতাল অবরোধ

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর চলমান ধ্বংসযজ্ঞ...

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মিষ্টি কুমড়ার বাম্পার ফলনে কৃষকরা খুশি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মিষ্টি কুমড়ার বাম্পার ফলন হয়েছে। এসব মিষ্টি কুমড়া যাচ্ছে দেশে...

টিভিতে আজকের খেলা

প্রতিদিনের মতো আজ সোমবার (৭ এপ্রিল) বেশ কিছু খেলা প্রচারিত হবে টেলিভিশনের পর্...

গৃহবধূকে ধর্ষণচেষ্টা; ওসি-এসআইসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা

সুনির্দিষ্ট কোন মামলা ছাড়াই এক গৃহবধূকে (২৫) আটক করে ধর্ষণচেষ্টা ও চাঁদাবাজির...

'শূন্যতা থাকে না, মানুষ অন্য দেশে সমাধান খুঁজে নেয়'

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এম তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, ভারত ভিসা দেবে কি না, সেটা তাদের...

ফরিদপুরে বাস উল্টে খাদে, নিহত বেড়ে ৭

ফরিদপুরের সদরে যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ার ঘটনায় আরো দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়...

নববর্ষ সামনে রেখে নিরাপত্তা বাড়ানো হচ্ছে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা 

ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ চলাকালে দেশের নানা জায়গায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচ...

ওমরাহ যাত্রীদের নিজ দেশে ফেরার সময় বেঁধে দিল সৌদি 

পবিত্র ওমরাহ পালন শেষে সৌদি আরবে অবস্থানরত বিদেশি মুসল্লিদের নিজ নিজ দেশে ফির...

'দুর্নীতি-অপরাধ না করার চর্চাগুলো এখন থেকে শুরু করতে হবে'

শিক্ষার্থীদের সৎ ও ভালো মানুষ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষ...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা