মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেছেন, ‘হারাম কিছু খেলে নামাজ হবে না, ঘুষ খেলে নামাজ হবে না।’গত ৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর আগারগাঁওয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) ভবনে স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পসমূহের প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ও জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়ন বিষয়ক সভায় তিনি সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশে বলেন, ‘প্রতিদিন আয়নার সামনে দাঁড়ান। নিজেকে প্রশ্ন করুন, সারা দিন কী কাজ করলেন।’
খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম একজন সৎ ও সজ্জন মানুষ হিসেবেই পরিচিত। ব্যক্তিজীবনে তিনি যেমন ধর্মপরায়ণ, তেমনি পেশার প্রতিও একনিষ্ঠ। সচিবালয়ের মসজিদে অনেক সময় তিনি নিজেই ইমামতি করেন। ফরজ নামাজের আগে পরে অনেক সময় তিনি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশে অনেক উপদেশমূলক কথা বলেন। তারই অংশ হিসেবে গত ৪ সেপ্টেম্বর সহকর্মীদের তিনি ঘুষের ব্যাপারে সতর্ক করেন। তবে এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন যে ঘুষ খেলে নামাজ হবে না বলার চেয়ে ঘুষ খেলে চাকরি থাকবে না বলাই অধিকতর সময়োপযোগী কিনা? কারণ, যারা ঘুষ খায়, তাদের অনেকেই নামাজ পড়েন না। সুতরাং, যারা নামাজই পড়েন না, তাদের ক্ষেত্রে ‘ঘুষ খেলে নামাজ হবে না’ বাক্যের কোনও গুরুত্ব নেই। আবার এমনও বহু মানুষ আছেন, যারা নিয়মিত নামাজ পড়েন, আবার দুই হাতে ঘুষও খান। ঘুষ খাওয়া যে অন্যায় ও পাপ, সে কথাও তারা জানেন। জেনেবুঝেই ঘুষ খান তারা। সর্বগ্রাসী লোভ তাদের খেয়ে ফেলেছে। ফলে ঘুষ খেলেও তার পারলৌকিক পরিণাম নিয়ে তারা চিন্তিত নন। বরং তাদের জন্য প্রয়োজন পার্থিব তথা প্রশাসনিক শাস্তি। যদি সত্যি সত্যি ঘুষখোরদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয় এবং অনেককে দৃশ্যমান শাস্তির আওতায় আনা যায়—তাহলে সরকারি অফিসগুলোর চেহারা বদলে যেতে বাধ্য।
দীর্ঘদিন এই তর্ক ছিল যে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কম, তাই তারা ঘুষ খান। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি নেই। তাদের বেতন যথেষ্ট বেড়েছে। বেতনের বাইরেও তারা সরকারি অনেক সুযোগ-সুবিধা পান। তাহলে এরপরও কেন ঘুষ বন্ধ হচ্ছে না? তাছাড়া যে দেশে সরকারের অনেক নীতিনির্ধারকও মনে করেন, ঘুষ হচ্ছে স্পিডমানি অর্থাৎ দ্রুত কাজ বা সেবা পেতে গিয়ে কেউ যদি ঘুষ দেয় এবং নেয়, সেটি অন্যায় নয়—সেই দেশে ঘুষ খেলে নামাজ হবে না খুবই নীতিবাক্য বটে! কিন্তু এর কোনও কার্যকারিতা নেই। কারণ, চোরের কাছে ধর্মের বাণী গুরুত্বহীন।
সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) পরিচালিত এক জরিপের ফল প্রকাশ করে বলা হয়েছে, করোনা মহামারির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ পেতে ২৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই ঘুষ দিতে হয়েছে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে এই ঘুষ দাবি করা হয়েছে।
বলা হয়, দেশে দুটি খাতে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি তথা ঘুষের লেনদেন হয়। ১. সরকারি ব্যয় এবং ২. ব্যাংক ঋণ। তবে দুর্নীতি চিহ্নিত করা এবং অপরাধীদের শাস্তির পরিমাণ যেহেতু কম, সেহেতু ঘুষ বন্ধ তো দূরে থাক, কমারও কোনও লক্ষণ নেই। এর একটি বড় কারণ ঘুষের চেইন। এমন কোনও উন্নয়ন প্রকল্প খুঁজে পাওয়া কঠিন যেখানে কোনও না কোনও পর্যায়ে ঘুষের লেনদেন হয় না। মন্ত্রী, স্থানীয় এমপি, ক্ষমতাসীন দলের নেতা, সচিব, প্রকল্প পরিচালক, ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে নানা ঘাটে ঘুষ দিয়ে কাজ আদায় করেন ঠিকাদার। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, অনেক প্রকল্পে ঠিকাদারকে কাজের মোট টাকার ওপর শতকরা ৮ থেকে ১০ ভাগ ঘুষ দিতে হয়। অর্থাৎ ঘুষ এখন সহনশীল ও গ্রহণযোগ্য প্রবণতা।
টেন্ডার প্রক্রিয়া ডিজিটাল হওয়ায় সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে ঘুষ কমেছে বলে দাবি করা হলেও, আসলেই কতটুকু কমেছে— তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ফলে যখন একশ’ টাকার কাজে ঠিকাদারকে ৫০ টাকা ঘুষ দিতে হয় এবং তিনি নিজেও যেহেতু ওই কাজ থেকে ব্যবসা করবেন, ফলে একশ’ টাকার কাজ গিয়ে ঠেকে আসলে তিরিশ টাকায়। সঙ্গত কারণেই কাজের মান কমে যায়। একই রাস্তা প্রতি বছর সংস্কার করতে হয়। উদ্বোধনের আগেই সেতু ভেঙে পড়ে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর আবাসন প্রকল্পের ঘরও ভেঙে যায়। উদ্বোধনের আগেই ফাটল ধরে আল্লাহর ঘর মসজিদেও।
নানা ইস্যুতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠলেও ঘুষের বিরুদ্ধে সেভাবে জনআন্দোলন গড়ে ওঠে না। কারণ, রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঘুষের শিকার। এমন লোক খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন হবে, যিনি জীবনের কোনও না কোনও পর্যায়ে কমবেশি ঘুষ দেননি। তাছাড়া ঘুষ বন্ধে যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন, সেটিও অনুপস্থিত। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ। কারণ, ঘুষের টাকা রাষ্ট্রের শীর্ষ মহলেও যায়। ঘুষ বন্ধে যাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি থাকার কথা, তারাও যখন মোটা অঙ্কের ঘুষের ভাগীদার হন, তখন তাদের পক্ষে ঘুষের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে অবস্থান নেওয়া অসম্ভব।
সরকারি অফিসে সেবা নিতে গিয়ে মানুষ কেন ঘুষ দেয় বা দিতে বাধ্য হয়—সেই আলোচনাও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, ঘুষের পেছনে অনেকাংশেই দায়ী ঘুষ প্রদানকারী। অর্থাৎ তিনি অন্যের আগে বা নিয়মের বাইরে গিয়ে কোনও কাজ বা সেবা পেতে গিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ঘুষ দেন। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ পেতে গিয়ে মন্ত্রী, সচিব ও প্রকল্প পরিচালকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদের লোককে তো বটেই, করোনার টিকা নিতে গিয়ে লম্বা লাইন এড়াতেও হাসপাতালের দারোয়ানকে দুইশ’ টাকা ঘুষ দেওয়ার ঘটনাও আছে। এই ঘুষের কারণ লাইনে দাঁড়ানোর বিড়ম্বনা এড়ানো। এক্ষেত্রে প্রধানত দায়ী ঘুষ প্রদানকারী, যিনি ধৈর্য ধরে লাইনে দাঁড়াতে চাননি। এক্ষেত্রে পুরো সিস্টেমের সমস্যাও দায়ী। টিকা নিতে গিয়ে বা হাসপাতালের অন্য কোনও সেবা নিতে গিয়ে যখন মানুষ মনে করে বা দেখে যে তাকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে, তখন সে নিজেই কাউকে ঘুষ দিয়ে হলেও আগেভাগে সেবাটি পেতে চায়। সুতরাং, সরকারি হাসপাতালসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে সেবা প্রদানের পদ্ধতি পরিবর্তন করা না হলে, জনদুর্ভোগ কমানোর কার্যকর উপায় বের করা না হলে, মানুষ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ঘুষ দেওয়া বন্ধ না করলে এটা কখনও বন্ধ হবে না। এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের মানসিকতার পরিবর্তনও জরুরি।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত মৌলবাদের অর্থনীতি বিষয়ে গবেষণা করেছিলেন—যেখানে তিনি দেখিয়েছেন, জামায়াতে ইসলামির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে বিভিন্ন সরকারের আমলে ফুলেফেঁপে উঠেছে; কীভাবে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের অর্থনীতির নানাক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করেছে। ২০১৪ সালের হিসাব দেখিয়ে ড. বারকাত জানান, বাংলাদেশে মৌলবাদের অর্থনীতির বার্ষিক নিট মুনাফা আনুমানিক দুই হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা। এ মুনাফার সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ আসে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে (বাংলা ট্রিবিউন, ১২ মার্চ ২০১৬)। যদিও ইসলামী ব্যাংকসহ জামায়াতের অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন আর তাদের হাতে নেই।
তবে দেশে ঘুষের অর্থনীতির আকার কত বড়—সে বিষয়ে এখনও কোনও গবেষণা হয়নি বা হলেও তার ফলাফল জানা যায়নি। ঘুষের অর্থনীতির পরিমাণ সম্ভবত মৌলবাদের অর্থনীতির চেয়েও বড়। এই গবেষণাটি হলে দেখা যাবে, ঘুষের অর্থনীতির কারণে সমাজে এমন একটি শ্রেণি গড়ে উঠেছে, যারা সামান্য বেতনে চাকরি করেও রাজধানীতে বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের মালিক। দেশে বিদেশে যাদের অঢেল সম্পদ। চাকরির নির্ধারিত বেতন সংসারে খরচের পরে যাদের হাতে মাস শেষে এক হাজার টাকাও উদ্বৃত্ত থাকার কথা নয়, তারাও কী করে বাড়ি-গাড়ি ও বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়ে গেলেন, তার সহজ থিওরি হচ্ছে ঘুষ ও দুর্নীতি। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীও কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যান কেবল এই ঘুষ, উপরি বা কোনও না কোনও অনিয়ম ও দুর্নীতির সুবাদে। অর্থাৎ সরকারি প্রতিষ্ঠানের সব কাজের ধরনই এমন যে সেখানে গিয়ে একজন সাধারণ মানুষ কোনও ধরনের হয়রানি বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীকে খুশি না করে (ঘুষ না দিয়ে) সময় মতো কাঙ্ক্ষিত সেবা পান না।
বছরের পর বছর ধরে এসব প্রতিষ্ঠানে যে দুর্নীতির দুষ্টচক্র গড়ে উঠেছে, সেটি ভাঙার জন্য রাষ্ট্রের কোনও তৎপরতাও চোখে পড়ার মতো নয়। একজন মন্ত্রিপরিষদ সচিব সৎ হলে বা সহকর্মীদের ঘুষের বিষয়ে সতর্ক করলেন কিংবা রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে ঘুষের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স বলা হলেই দেশ থেকে ঘুষ ও দুর্নীতি উধাও হয়ে যায় না। ঘুষ এখন পুরো সিস্টেমের অংশ। ভয়াবহ ব্যাপার হলো, অনেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী বেতনের মতোই ঘুষকেও তাদের অধিকার মনে করেন। তাদের বদ্ধমূল ধারণা, তারা যাকে সেবা দেবেন বা যার কাজ করে দেবেন, তিনি তাকে খুশি করবেন। মানে ঘুষ দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। অথচ ওই সেবাগ্রহীতা লোকটির মতো সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের পয়সায় যে তার বেতন-বোনাস হচ্ছে, সেই বাস্তবতা তিনি ভুলে যান।
ঘুষখোর নামাজির একটি বহুল প্রচলিত গল্প দিয়ে লেখাটা শেষ করা যাক। একজন ঘুষখোর সরকারি কর্মকর্তা আপাতদৃষ্টিতে খুবই পরহেজগার। নামাজ পড়েন। কিন্তু নিজ হাতে ঘুষের টাকা গ্রহণ করেন না। একদিন একজন কাস্টমার (সেবাগ্রহীতা) তাকে ঘুষের টাকা দিতে চাইলে তিনি ড্রয়ার খুলে দিয়ে বলেন, ‘মাত্র অজু করে এসেছি, নামাজ পড়তে যাবো। আপনি টাকাটা ড্রয়ারে রাখুন।’ সরকারি অফিসগুলোয় এ রকম ঘুষখোর নামাজি বা নামাজি ঘুষখোরের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। প্রশ্ন হলো, এসব লোকের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব কী বলবেন?
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।