লেলিন চৌধুরী: বাংলাদেশে করোনার টিকাদান চলছে। এত দিন আঠারো এবং তদূর্ধ্ব বয়সীদের টিকা দেওয়া হচ্ছিল। সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী বারো থেকে সতেরো বছর বয়সের শিশুদের টিকাদানের সিদ্ধান্ত জানালেন। বিষয়টি নিয়ে জনমনে দোলাচল তৈরি হয়েছে। অভিভাবকরা দ্বিধাগ্রস্ত ও উদ্বিগ্ন।
প্রশ্ন উঠে এসেছে, করোনার টিকা কি শিশুর জন্য নিরাপদ? দিতে হলে কোন টিকা দেব? করোনা প্রতিরোধে বাংলাদেশে অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না, সিনোভ্যাক এবং সিনোফার্মের তৈরি টিকা ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ভারতে, ফাইজার ও মডার্নার টিকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং সিনোভ্যাক ও সিনোফার্মের টিকা চীনে তৈরি করা হয়।
এই সবগুলো টিকাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি ব্যবহারের তালিকাভুক্ত। টিকার কার্যকারিতা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, রক্ষণাবেক্ষণ প্রণালিসহ প্রাণী ও মানবদেহে ট্রায়ালের সব বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত ভালোমতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এসব টিকাকে ব্যবহারের জন্য তালিকাভুক্ত করে থাকে। তাই সব বিবেচনায় বলা যায় আমাদের দেশে ব্যবহৃত করোনার প্রতিটি টিকাই আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন।
সফল ট্রায়ালের পর ফাইজার ও মডার্নার টিকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বারো ও তদূর্ধ্ব বয়সের শিশুদের দেওয়ার জন্য অনুমোদন পেয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বাস্থ্যের দেখভালের দায়িত্ব পালন করে ইউরোপীয় মেডিসিনস এজেন্সি বা ইএমএ। ইএমএ ইউরোপীয় দেশগুলোতে ফাইজারের টিকা ১২-১৭ বছরের শিশুদের প্রদানের পরামর্শ দিয়েছে।
এরই মধ্যে যুক্তরাজ্য, স্পেন, ইতালি, ডেনমার্কসহ অনেকগুলো দেশ শিশুদের জন্য ফাইজারের টিকা ব্যবহার শুরু করেছে। অস্ট্রেলিয়াও ইউরোপের পদাঙ্ক অনুসরণ শুরু করেছে। অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার এ-সংক্রান্ত ট্রায়াল একেবারে শেষপর্যায়ে রয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে তারা শিশুদের টিকা দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে সিনোফার্মের টিকা। এই টিকা কি শিশুদের দেওয়া যায়? তিন থেকে সতেরো বছরের শিশুদের ওপর সিনোফার্মের টিকার ট্রায়াল বেশ আগে থেকেই শুরু হয়। এই ট্রায়ালের চূড়ান্ত বা তৃতীয় পর্যায় চীন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে একই সঙ্গে শুরু হয়। তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর চীনা কর্র্তৃপক্ষ গত জুলাই মাসে শিশুদের এই টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে।
সেই অনুযায়ী চীনের বিভিন্ন প্রদেশে ৩-১৭ বছরের শিশুদের টিকা প্রদান শুরু হয়েছে। ২ আগস্ট সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকার তিন থেকে সতেরো বছরের শিশুদের টিকা দেওয়া শুরু করেছে। অবশ্য শিশুদের প্রদানের জন্য সর্বপ্রথম অনুমোদন পায় চীনের সিনোভ্যাকের তৈরি করা টিকা। ট্রায়ালের সব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে চীনের স্বাস্থ্য কর্র্তৃপক্ষ বিগত জুন মাসে এই টিকার ব্যবহার অনুমোদন করে।
চীনের সিনোভ্যাক ও সিনোফার্মের টিকা সব বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে কার্যকর ও নিরাপদ প্রমাণিত হওয়ার পরও সেগুলো প্রচারের পাদপ্রদীপের আলোয় আসে না কেন? করোনার ভ্যাকসিনগুলো তৈরিতে ব্যবহৃত প্রযুক্তি, ট্রায়ালের প্রক্রিয়া, লব্ধ তথ্য-উপাত্ত ইত্যাদি যাবতীয় বিষয় মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত হয়। প্রতিটি বিষয়কে পুনঃ পুনঃ নিরীক্ষা করা হয়। নির্ধারিত বৈজ্ঞানিক মানসম্মত পদ্ধতির কোথাও কোনো ভুলত্রুটি ছিল কি না সেগুলোও যাচাই করা হয়।
এগুলো অনেকটা খোলা বইয়ের মতো। যে-কেউ ইচ্ছে হলে পড়ে দেখতে পারে। তারপরও কিন্তু আমরা দেখতে পাই পশ্চিমা দেশগুলোর ‘ন্যাটো’ জোটভুক্ত দেশগুলোর প্রস্তুত করা টিকাগুলোর সাফল্য যেভাবে তুলে ধরা হয় রাশিয়া, চীন বা ভারতের তৈরি করা করোনার টিকা নিয়ে পশ্চিম নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমগুলো বিমাতাসুলভ আচরণ করে থাকে।
এটি নিশ্চিতভাবেই ন্যাটোবলয়ের সঙ্গে বাকিদের মুনাফাযুদ্ধের কৌশল। যেমন ইসরায়েলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত জুলাই মাসে জানায়, ‘ইসরায়েলে করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা মাত্র ৩৯ শতাংশ কার্যকর হয়েছে।’ একই খবর চীনের বা রাশিয়ার কোনো টিকা সম্পর্কে হলে সারা পৃথিবীতে যে তোলপাড় হতো, যতটা নেতিবাচক প্রচার হতো ফাইজারের টিকা নিয়ে তার খণ্ডাংশও হয়নি।
পৃথিবীতে ৬০টির বেশি দেশ চীনের তৈরি টিকা নিজ দেশে ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। চীন ৬৯টি উন্নয়নশীল দেশে জরুরি ভিত্তিতে উপহার হিসেবে টিকা পাঠিয়েছে এবং ৪৩টি দেশে এখন নিয়মিত টিকা রপ্তানি করছে। জাতিসংঘের অনুরোধে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনীর জন্য চীনা সরকার টিকা প্রদান করেছে। চীনে তৈরি টিকার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা বোঝানোর জন্য এই বিষয়গুলোর অবতারণা করা হলো।
তাহলে আমরা শিশুদের টিকা দেওয়ার জন্য ফাইজার ও মডার্নার টিকা কেন কিনব? এই দুটি টিকারই দাম বেশি এবং সংরক্ষণ করা আমাদের জন্য কঠিন। কারণ এগুলোকে ‘-৭০’ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় স্টোর করতে হয়। আমরা সহজেই চীনের সিনোফার্মের টিকা আমাদের শিশুদের জন্য ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিতে পারি।
এই টিকা ২-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়। যে পদ্ধতিতে এই টিকা প্রস্তুত করা হয়েছে সেটি বহু বছর যাবৎ ব্যবহৃত হচ্ছে এবং এই পদ্ধতি শিশুদের জন্য নিরাপদ বলে প্রমাণিত হয়েছে। শিশুদের ওপর সিনোফার্মের টিকার যেসব ট্রায়াল হয়েছে সেই তথ্য-উপাত্তগুলো ভালোমতো যাচাই করে দেখা যেতে পারে। শিশুদের টিকা দেওয়ার পর সংযুক্ত আরব আমিরাত ও চীনের তথ্য ও অভিজ্ঞতাও আমরা জানতে এবং পরীক্ষা করে দেখতে পারি।
টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রবর্তিতা নির্ধারণ করা জরুরি। ষাটোর্ধ্ব বয়সের মানুষ যাদের করোনায় মৃত্যুঝুঁকি বেশি তাদেরই প্রথমে টিকা দেওয়া প্রয়োজন। এরপর চল্লিশের বেশি বয়সী মানুষ যাদের শরীরে নানা রোগ রয়েছে তাদের টিকা দিতে হবে। তারপর যাদের টিকা দিলে শিক্ষা ও অর্থনীতির চাকা সচল থাকবে তাদের টিকাদানের আওতায় আনতে হবে। এই অগ্রবর্তিতার তালিকায় নিঃসন্দেহে শিশুদের অবস্থান পেছনের দিকে। তাই তাড়াহুড়ো না করে সমস্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে শিশুদের টিকা প্রদান এবং টিকা নির্বাচনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন।
লেখক: চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
সান নিউজ/এমএইচ/এমকেএইচ