মিলিতা বাড়ৈ
বাংলাদেশের রাজধানী হলো ঢাকা। ঢাকা একটি মেগাসিটি এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান শহর। মুগল সাম্রাজ্যের সময় ঢাকা একটি বিশ্বজনীন শহর হিসেবে আবির্ভূত হয়। এটি মসজিদের শহর, ইসলামী স্থাপত্য ও বুড়িগঙ্গা (পুরনো গঙ্গা) সম্মুখীন নদীপ্রবাহের কারণে প্রাচ্যের ভেনিস হিসেবেও পরিচিত।
বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা প্রায় সোয়া দুই কোটি। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৪৫ হাজারেরও বেশি মানুষের বসবাস। এছাড়া প্রতিদিন প্রায় পঞ্চাশ লাখ মানুষ ঢাকার বাইরে থেকে বিভিন্ন প্রয়োজনে যাওয়া আসা করে।
তবে বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় তলানিতে রয়েছে ঢাকা। সম্প্রতি এমনই তথ্য প্রকাশ করেছে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) গবেষকরা।
গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবন কতগুলো এর সঠিত পরিসংখ্যান নেই। তবে বেসরকারি নানা জরিপের তথ্যমতে এ সংখ্যা লক্ষাধিক।
রাজধানীতে বিল্ডিং কোড না মেনেই প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে অবৈধ ভবন। ফলে ভূমিকম্পসহ অবকাঠামোগত ঝুঁকি বাড়ছে। ঢাকা বিশ্বে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা শহরগুলোর একটি।
এছাড়া ঢাকা শহরে রয়েছে গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলা, যানযট, ভাঙ্গা ও সরু রাস্তাঘাট, চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত ফুটপাতের অভাব, বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, পরিবেশ দূষণ, গাছপালার অভাব, যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা, বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়া, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির সমস্যা, জলাবদ্ধতা, আগুন লাগা, দুর্ঘটনা, মাথার উপর ঝুলন্ত বিদ্যুতের তারসহ অসংখ্য তার, অস্বাভাবিক দ্রব্যমূল্য, ভেজাল খাদ্য, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিনোদনের জন্য পর্যাপ্ত খোলা জায়গা বা পার্কের অভাব, মশার উৎপাত, পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির অভাব, ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব, খুন, ছিনতাই, ডাকাতি, প্রতারণা, ঘুষ, দুর্নীতি, ষড়যন্ত্র, আন্ডারওয়ার্ল্ড, মাফিয়া গ্যাং, কিশোর গ্যাং, নাগরিক নিরাপত্তার অভাব, হাজার হাজার বস্তি, মানসিক চাপ ইত্যাদি।
এখন প্রশ্ন হলো, কেন এমন হচ্ছে? মূলত এসব সমস্যা তৈরির পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক কারণ।
কিন্তু আশার কথা হচ্ছে এতো সমস্যা থাকার পরেও ঢাকার অব্যাহত অগ্রগতি কিন্তু থেমে নেই। ১৬০৮ সালে বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর তীরে সমতল ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত ও ১৬১০ সালে সুবাহ বাংলার রাজধানী হিসেবে স্বীকৃত ছোট একটি শহর ঢাকা আজ মেগাসিটি। এই চারশ বছরে ঢাকার উন্নয়নের গল্পও কিন্তু কম না।
এখনো এদেশের অধিকাংশ মানুষ ঢাকাকে অন্য এক সম্মানের চোখে দেখে। কারণ, এই শহরেই বাঙালি তার স্বকীয়তা রক্ষায় মাতৃভাষা বাংলার জন্য জীবন বিসর্জন দিয়েছে, এখানেই সূচিত হয়েছে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম আন্দোলন।
ঢাকাতেই জন্মেছেন ও বেড়ে ওঠেছেন অনেক নামকরা কবি, সাহিত্যিক, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, খ্যাতিমান শিল্পী, সাহিত্যিক, ক্রীড়াবিদ, চলচ্চিত্রকার ও রাজনীতিবিদ। ঢাকার খ্যাতি রয়েছে মসজিদ ও অতি মসৃন মসলিনের জন্যও। অনেকেই ঢাকাকে নিয়ে লিখেছেন হৃদয়গ্রাহী কবিতা, গদ্য ও ইতিহাস। সেসবে ওঠে এসেছে ঢাকার অনেক জানা ও অজানা কাহিনী।
গত কয়েক বছরে ঢাকাকে বসবাসযোগ্য করার জন্য রাজউক কর্তৃক প্রণীত ড্যাপের আওতায় অনেক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভার, ফুটপাত ও রাস্তাঘাট নির্মাণ, পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্র সংস্কার ইত্যাদি। ভবিষ্যতে হয়তো আরও অনেক বড় প্রকল্প নেয়া হবে।
এসব উন্নয়নের ধারা আমাদের যেমন আনন্দ দেয়, তেমনি আবেগাপ্লুত করেও বটে।
এদিকে সম্পদে ও বিপদে ঢাকাকেই মানুষ শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে মনে করে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, জ্ঞানচর্চা, সংষ্কৃতি, গণমাধ্যম, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ প্রভৃতির জন্য মানুষ ঢাকার দিকেই তাকিয়ে থাকে।
অনেকের মতে, ঢাকা হচ্ছে মানবিকতার শহর। এই ঢাকার শহরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ ছুটে আসে এক বুক স্বপ্ন নিয়ে। ভালো চাকরি করতে, ভালো চিকিৎসা সেবা পেতে, ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে, ব্যবসা-বাণিজ্য করে ভাগ্যের চাকা ঘোরানোসহ নানা কারণে এই ঢাকাকেই একমাত্র অবলম্বন মনে করেন লাখ লাখ মানুষ।
এই শহর নদী ভাঙনে সহায়-সম্বলহীনদের, শ্রমজীবীদের, ফুটপাতের অতি ক্ষুদ্রব্যবসায়ীদের, গ্রাম থেকে গার্মেন্টসে কাজের জন্য আসা লাখ লাখ গরিব ছেলে মেয়েদেরকে আশ্রয় দেয়। এই শহরে রাস্তায় কেউ অসুস্থ হলে বা দুর্ঘটনায় আহত হলে বা ভবন ধসে পড়লে পুলিশের সঙ্গে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে সাধারণ মানুষ। রানা প্লাজা ট্রাজেডির কথা এক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে। সুতরাং, মানবিকতার দিক দিয়ে ঢাকা শহর বিশ্বের অন্য যেকোনো শহরের চেয়ে কম নয়।
মূলত ঢাকা হচ্ছে বাংলাদেশের হৃৎপিন্ড। সতের কোটি মানুষের আশা ও নিরাশার শহর। এ শহর যেমন মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে সাহায্য করে, তেমনি প্রাপ্তি পূরণ না হলে হতাশাগ্রস্ত করে জীবন কেড়ে নিতেও পারে। তাই আমাদের নগর কর্তৃপক্ষ বা সরকার এই শহরকে বসবাসযোগ্য করার জন্য আরও উদ্যোগী ও মনোযোগী হবেন এমন প্রত্যাশা মনে লালন করি সব সময়।
লেখক: মিলিতা বাড়ৈ/ নিউজরুম এডিটর/ সাননিউজ