আলতাফ পারভেজ
পাকিস্তান থেকে খবর মানে সচরাচর হানাহানির বার্তা। বছরের পর বছর এসব খবর তৈরি এবং প্রচারিত হচ্ছে। কিন্তু দেশটি মিডিয়ার অগোচরে অনন্য এক অর্জনের দিকেও এগোচ্ছে ধীরে ধীরে। এক হাজার কোটি তথা ১০ বিলিয়ন গাছের মালিক হওয়ার চেষ্টায় নেমেছে তারা। লক্ষ্য হিসেবে এটা পাহাড়সম।
তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক তুমুল উদ্বেগের মুখে দেশটির এ চেষ্টা সবার মনোযোগ পাওয়ার মতো। এ কাজে তারা বিশ্বে পথপ্রদর্শক হয়ে উঠছে।
যখন কোনো দেশ ‘গাছ লাগানোর সুনামি’তে নামে
ইমরান খান সরকার তাদের এ কর্মসূচিকে বলছে ‘১০ বিলিয়ন গাছের সুনামি’। অর্থাৎ দেশকে এক হাজার কোটি গাছে মুড়ে দেওয়া হবে। খাইবার পাখতুনখাওয়া ২০১৫ সালে এ উদ্যোগের শুরু। ইমরানের দল পিটিআই ওই প্রদেশে ক্ষমতায় এসে ১০০ কোটি গাছ লাগানোর কাজ নেয় এবং তিন বছরে সেটা শেষ করে।
দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে খাইবার পাখতুনখাওয়া ইমেজ বরাবরই রক্ষণশীল। তার বিপরীতে এই বৃক্ষায়ন প্রকল্পের সফলতা ভিন্ন এক ইমেজ তৈরি করে। পিটিআই একে পুঁজি করতে দেরি করেনি। কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পরই খাইবারের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে ২০১৯ থেকে ১০ গুণ বড় লক্ষ্য নিয়ে নেমেছে তারা।
পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে প্রস্তাবিত ১০ বিলিয়ন গাছের ৪ বিলিয়ন হবে নতুন গাছ। যেগুলো রোপণ হবে। এ জন্য প্রায় ২০ প্রজাতির গাছ বাছাই হয়েছে। ইতিমধ্যে বড় হওয়া গাছপালা রক্ষা করে বংশবৃদ্ধি ঘটিয়ে বাকি ৬ বিলিয়ন গাছ তৈরি হবে। শেষের ছয় বিলিয়ন স্থানীয় মানুষকে প্রণোদনা দিয়ে সেসব গাছ যত্ন করা হবে। এই মানুষকে বলা হচ্ছে ‘নিগাবান’, অর্থাৎ গাছ হেফাজতকারী। এভাবে ২০২৮ নাগাদ পাকিস্তান ১০ বিলিয়ন নতুন গাছ পেতে চায়। ২০২৩ নাগাদ পাওয়ার লক্ষ্য ৩২০ কোটি। এরই মধ্যে তারা ১০০ কোটি নতুন গাছ পেয়ে গেছে। খাইবার পাখতুনখাওয়ায় নতুন লাগানো গাছ টিকে থাকার হার প্রায় ৯০ ভাগ।
‘ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ’-এ নতুন কর্মসংস্থান
গাছ বাড়ানোর পাশাপাশি সংরক্ষিত বন ও জলাভূমিও বাড়াতে চায় পাকিস্তান। ভূখণ্ডের অন্তত ১৫ ভাগ তারা নিরাপদ প্রকৃতি বানাতে ইচ্ছুক। ইমরান কিছুদিন আগে ১৫টি ন্যাশনাল পার্ক গড়ার ঘোষণা দিলেন। এতে থাকবে সাত হাজার কিলোমিটার এলাকা। দেশটিতে এরই মধ্যে ৩১টি ন্যাশনাল পার্ক আছে। ন্যাশনাল পার্কগুলো চালাতে দক্ষ জনবল গড়তে একটা ন্যাশনাল পার্ক একাডেমিও করা হচ্ছে।
‘গাছ সুনামি’তে চারা রোপণের সময় সেসব গাছ বাছাই হচ্ছে যেগুলো উঁচু হয়, ছায়া দেয় এবং মাটি টেনে ধরে। মাটির ক্ষয় রোধের জন্য এ রকম গাছ বাছাই হচ্ছে। এ ছাড়া সব গাছই কার্বন ডাই অক্সাইড টেনে নেবে। বাতাসের গুণাগুণ পাল্টাবে তাতে।
পাকিস্তান সরকারের হিসাব হলো বন-সৃজন থেকে হাজার হাজার নতুন কর্মসংস্থান হবে। কিছু কর্মসংস্থান হবে সাময়িক, কিছু হবে দীর্ঘস্থায়ী। অনেক নতুন নার্সারি তৈরি হচ্ছে সেখানে গাছের জোগানের জন্য। পুরো কর্মসূচিতে খরচও হবে অনেক অর্থ। পাকিস্তানে জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের (একনেক)অনুমান, পুরো কর্মসূচির জন্য কয়েক বিলিয়ন ডলার লাগবে। আপাতত এ কাজে বরাদ্দ হয়েছে ৮০০ মিলিয়ন। স্কুল-কলেজ-মসজিদ-মাদ্রাসার স্বেচ্ছাসেবী ছাড়াও নিয়মিত এক লাখ মানুষ এ কাজে লেগে আছে। সরকার বলছে, তারা জানে এ বিনিয়োগ থেকে ভোট বাড়বে না, কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এটা করা হচ্ছে।
পরিবেশ-অর্থায়নে নতুন ধারণা আনা হচ্ছে
পাকিস্তানে মাত্র ৫ ভাগ এলাকায় বনাঞ্চল। মানদণ্ড হিসেবে এটা খারাপ। লোকসংখ্যায় পাকিস্তান বিশ্বের পঞ্চম বড় দেশ। একদিকে গাছপালা কম, অন্যদিকে লোকসংখ্যা বিপুল। এই দুষ্টচক্রে পরিবেশ সংকট জটিল হচ্ছিল।
জলবায়ু পরিবর্তনের অনেক ধরনের বিপদের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল পাকিস্তান। গাছশূন্যতায় আবহাওয়া ক্রমে গরম হচ্ছিল। তাতে উত্তরে ঠান্ডাপ্রধান এলাকায় বরফগলা পানি বাড়ছে। অন্যত্র বেড়েছে খরা, বৃষ্টি, বন্যা। একই সময় কোনো এলাকায় খরা হচ্ছিল, কোনো এলাকায় বন্যা। এভাবে গত ২০ বছর যেসব দেশ জলবায়ু পরিবর্তনে কাবু, সেই তালিকায় পাকিস্তান প্রথম দশে চলে আসে। পাকিস্তান তার এ দুঃসহ বর্তমানকে মোকাবিলা করতেই নেমেছে।
কিন্তু গাছ লাগানো ও গাছ রক্ষার মেগা প্রকল্পে অনেক অর্থ দরকার। চীন ও আইএমএফের কাছে পাকিস্তানের যা ধারদেনা, তাতে রাজস্ব আয়ের ১০ ভাগ (প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার) চলে যাচ্ছে ঋণের সুদে। এ রকম অর্থনীতিতে মানুষকে এড়িয়ে গাছের পেছনে বিনিয়োগে মুশকিল আছে। তবে দেশটি প্রয়োজনীয় মুদ্রার জন্য কিছু নতুন ধারণা নিয়ে এসেছে। গাছপালা সুরক্ষা এবং বনায়নের বিনিময়ে ঋণ মওকুফের মতো কর্মসূচির কথা ভাবা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থাগুলোকে ‘প্রতিবেশ উন্নয়নের মাধ্যমে ধারদেনা মওকুফে’র মতো কর্মসূচিতে টেনে আনতে চায় তারা। ধনী দেশগুলোকে এভাবে তৃতীয় বিশ্বের ঋণ মওকুফের জন্য বলছে পাকিস্তান। বনায়নে অর্থায়নের জন্য বন্ড ছাড়ার কর্মসূচিও আছে তাদের।
পরিবেশ রক্ষার মাধ্যমেও যে বড় অঙ্কের কর্মসংস্থান তৈরি করা যায়, এ ধারণার প্রচার-প্রসার বিশ্বজুড়ে বেশ কম। জাতিসংঘ সে জন্য ২০২১ থেকে আগামী ১০ বছরকে ‘প্রতিবেশব্যবস্থা পুনর্গঠন দশক’ ঘোষণা করেছে। পাকিস্তানের এ কর্মসূচিকে জাতিসংঘ এ দশকের ভালো এক মডেল আকারে হাজির করছে।
বনায়ন অডিট করবে আন্তর্জাতিক সংস্থা
গাছ লাগানোর কর্মসূচি দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন নয়। কিন্তু সেই গাছ টিকছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হয় কম। পাকিস্তান সরকার বনায়ন তদারকির জন্য বিশ্ব খাদ্য সংস্থা, আইইউসিএন ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংস্থাকে ডেকেছে। দুর্গম অঞ্চলে কাজের ‘অডিট’ হচ্ছে স্যাটেলাইট ইমেজে। এ রকমের অডিটের লক্ষ্য ধরা হয়েছে কয়েকটি। কেবল গাছ থাকলেই হলো না, স্থানীয় প্রয়োজন অনুযায়ী ঠিক জায়গায় ঠিক গাছটি লাগানো হচ্ছে কি না, সে-ও দেখা হবে স্যাটেলাইটে। বনায়নে সফলতার নামে বন বিভাগের মিথ্যাচার ও দুর্নীতি বন্ধে স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ভালো রক্ষাকবচ। পিটিআই খাইবার পাখতুনখাওয়ায় এক বিলিয়ন গাছ লাগানোর কর্মসূচির অডিট করিয়েছে ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড’কে দিয়ে।
ইমরানের জন্য এ উদ্যোগে একটা সুবিধার দিক হলো যুক্তরাজ্যে তাঁর ঘনিষ্ঠ জ্যাক স্মিথ পরিবেশ বিষয়ে মন্ত্রী এখন। জ্যাক ইমরানের সাবেক স্ত্রী জেমিমার ভাই। তিনি পরিবেশ বিষয়ে চাঁদা তোলায় আন্তর্জাতিকভাবে বেশ দক্ষ। ইমরান তাঁর সাহায্য নিতে চান।
যে কারণে বিশ্বজুড়ে এ রকম কর্মসূচি গুরুত্ব পাচ্ছে
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গাছ লাগানোই একমাত্র পথ নয়। এটাই জলবায়ুজনিত সব সমস্যার সমাধান দেয় না। কিন্তু এ হলো সমাধানের এমন এক অংশ, যাতে খরচপাতি লাগে কম। গাছ লাগানোর সময় যেমন অনেকের কাজের সংস্থান হয়, তেমনি গাছ ও বন যত বাড়ে, তত নতুন কর্মসংস্থান হয়।
পরিবেশ রক্ষার মাধ্যমেও যে বড় অঙ্কের কর্মসংস্থান তৈরি করা যায়, এ ধারণার প্রচার-প্রসার বিশ্বজুড়ে বেশ কম। জাতিসংঘ সে জন্য ২০২১ থেকে আগামী ১০ বছরকে ‘প্রতিবেশব্যবস্থা পুনর্গঠন দশক’ ঘোষণা করেছে। পাকিস্তানের এ কর্মসূচিকে জাতিসংঘ এ দশকের ভালো এক মডেল আকারে হাজির করছে। প্রতিবেশ ও পরিবেশ বিষয়ে যে এত বড় উদ্যোগ হতে পারে এবং তার পেছনে দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসনের অঙ্গীকার থাকতে পারে, সেটাই জাতিসংঘ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দেখাচ্ছে এখন।
তারা বলছে, পরিবেশ প্রশ্নে মানুষকে খলনায়কের জায়গা থেকে আবার নায়কের ভূমিকায় আনা সম্ভব। পাকিস্তানের মতো এ রকম উদ্যোগ দরকার আরও অন্তত ৫০টি। ইতিমধ্যে পাকিস্তানের ‘সুনামি’র ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ঘটেছে। এ বছরের শুরুতে সৌদি সরকার তাদের দেশেও এক হাজার কোটি গাছ লাগানোর এক প্রকল্প নিয়েছে। বাস্তবে এসব হলো একধরনের অনিবার্যতা। যেমন সৌদিতে দ্রুত মাটির নিচের পানি শেষ হয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতের বিপদ সম্পর্কে দ্রুতই সতর্ক হলো তারা।
এ রকম বিপদ কেবল পাকিস্তান বা সৌদি আরবের নয়। সম্প্রতি তুরস্কে বনে আগুন লেগে বহু মানুষ মারা গেল। এ রকম আগুন লাগার ঘটনা ২০২০-এর চেয়ে ৫০ ভাগ বেড়ে গেছে সেখানে। পাশের গ্রিসে এ বছর অন্তত ৫০০ জায়গায় একই রকম আগুনের ঘটনা ঘটেছে। ইতালিতে এবার ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৮ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড হলো। আলজেরিয়ায় একই রকম আগুনে ৩৩ সেনাসহ মারা গেল প্রায় ১০০ জন।
একদিকে যখন উত্তাপে পুড়ছে বনভূমি, অন্যদিকে অচিন্তনীয় গতির বন্যায় ডুবছে বিশ্বের অনেক শহর-বন্দর। কেবল গত জুলাইয়ে বিশ্বের ৩৮৫ স্থানে বন্যা হলো (ওয়ার্ল্ড-ফ্লাড-ডেইটা)। এর মাঝে অবকাঠামোতে অতি উন্নত চীনে বন্যায় মারা গেছে প্রায় ১০০ জন।
এসব কোনোটাই স্বাভাবিক বন্যা, বৃষ্টি আর আগুন নয় এবং ভবিষ্যতে সবই আরও বাড়বে। কথাগুলো বিজ্ঞানীরা বলছেন অনেক দিন। কিন্তু রাজনীতিবিদ আর প্রশাসকদের তাতে আগ্রহ ও মনোযোগ বাড়ছে না। ইমরান খান এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তৃতীয় বিশ্বে জলবায়ু মোকাবিলায় রাজনীতিবিদদের এ রকম অঙ্গীকার বিরল। দক্ষিণ এশিয়ার সবাই এ মুহূর্তটি উদ্যাপন করতে পারে। সার্ক অঞ্চল বিশ্বকে কম খরচে বর্তমান কালের সবচেয়ে জরুরি সমস্যা মোকাবিলার পথ দেখাচ্ছে।
লেখক: আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক
সান নিউজ/এনকে/এমএম