ফারুক ওয়াসিফ : কবি শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘কইলকাত্তায় গিয়া দেখি, বাপজান হে, কইলকাত্তায় গিয়া দেখি সক্কলেই সব জানে, আমিই কিছু জানি না।’ সেই তালে বলা যায়, বাংলাদেশে সবকিছুই চলছে, কেবল গোত্তা মেরে পড়ে থাকা শিক্ষাজীবন আর মাথাই তুলছে না। ট্রেন চলছে, বাস চলছে, লঞ্চ চলছে। গাদাগাদি করা ফেরি চলছে, সড়কে গাড়ি ও মানুষের গা ঘষাঘষি চলছে, কিন্তু শিক্ষকের সঙ্গে দেখা হচ্ছে না শিক্ষার্থীর। কেলেঙ্কারি চলছে, ক্লাব চলছে, জমায়েত জমছে, কিন্তু শিশু-কিশোর-তরুণেরা ক্লাসে যেতে পারছে না।
অস্থির হয়ে উঠছেন অভিভাবক, শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা। সন্তানের পড়ালেখার চিন্তায় ব্যাকুল অভিভাবকদের একজন হলেন রাখাল রাহা। লেখক মানুষটি ফেসবুকে উদ্বেগ-আহাজারি শেষে এখন নিজেই সন্তানের স্কুলের সামনে স্কুল খোলার দাবি লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়ানো শুরু করেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চার এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক খোলা মাঠে প্রতীকী ক্লাস নেওয়া শুরু করেছেন। এসব ক্লাসে শিক্ষার্থীরা আসছেনও। এভাবেও চলতে পারে না, আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ থাকতে পারে না।
দেড় বছরের বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। অনলাইন ক্লাস? সে এক হাওয়াই মিঠাই, দেখতে সুন্দর কিন্তু মুখে দিলে নাই। অনেক শিক্ষকের অনলাইনে পড়ানোর দক্ষতা নেই, অনেক শিক্ষার্থীর সে রকম মোবাইল বা কম্পিউটার নেই, থাকলেও ইন্টারনেটের ডেটা সব সময় কিনতে পারে না। ব্যাপারটা একঘেয়েও বটে।
২০৩০ সাল নাগাদ সব শিশুর জন্য ন্যূনতম প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্য ছিল উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাসমূহের মধ্যে এটি (প্রাথমিক শিক্ষা) ভালোভাবে অর্জনের সব সম্ভাবনাই ছিল। কিন্তু করোনা মহামারি এসে ‘সকলই গরল ভেল’ করে দিল।
প্রশ্ন হচ্ছে, বন্ধ রাখাই কি অনিবার্য ছিল? সংক্রমণ বাড়ানোর দোহাই ধোপেও টেকে না, ধারেও কাটে না। ভ্যাকসিনের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সম্পর্ক খুবই কম। ভিয়েতনামে ২ ডোজ পেয়েছে ১.৯ শতাংশ মানুষ। তাইওয়ানে ৩.৩ শতাংশ আর বাংলাদেশে ৩.৯ শতাংশ! ভিয়েতনামে গত মাসেও তীব্র সংক্রমণের মুখে ১০ লাখেরও বেশি বেশি ছাত্রছাত্রী পরীক্ষায় বসেছে। তাইওয়ানও নতুন বছরের শিক্ষাক্রম পয়লা সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করতে যাচ্ছে। আর বাংলাদেশে স্কুল-কলেজ ছাড়া সবকিছুই হাটখোলা অবস্থায়। শপিং মল থেকে পরিবহন; এমনকি সিনেমা হলও খুলে দেওয়া হয়েছে। বড়রা ঠিকই বাইরে যাচ্ছে। তো, বাসায় শিশু আছে বলে করোনা মহাশয় কি বড়দের গায়ে-নিশ্বাসে করে বাড়িতে আসবে না? সদর দরজা খোলা রেখে জানালা এঁটে ঘুমিয়ে থাকার এ ব্যারামকে সন্দেহ করতেই হয়।
অনেকের মধ্যেই তাই প্রশ্ন আছে। স্কুল খুললে কলেজ খুলতে হয়, বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে হয়। ক্যাম্পাসগুলো সরগরম হওয়া মানে তরুণসমাজ জীবন্ত হয়ে উঠবে। দেশের যে বাস্তবতা, তাতে করে জীবন্ত তরুণসমাজ বিভিন্ন আন্দোলনে শামিল হতেই পারে। বন্ধ থাকা অবস্থাতেই বিভিন্ন ইস্যুতে ফেসবুক থেকে প্রেসক্লাব সোচ্চার ছিল। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিলে আগুনে ঘি পড়ার আশঙ্কাই কি কাজ করছে সরকারের মনে? এ কারণেই প্রশ্ন: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার পেছনে জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষার যুক্তিটা যখন বাস্তব না, তাহলে তরুণদের জমায়েত হওয়াকেই ভয়?
কিন্তু বিদ্যালয় বন্ধ বলে তো কিশোর-তরুণেরা বসে নেই। এই সময়ে কিশোর অপরাধ বেড়েছে। এই অনিচ্ছুক ছুটির শাস্তিতে বিরক্ত অনেকে নেশায় জড়াচ্ছে। গ্রাম-মফস্বলে ঘুরে দেখেছি, রাস্তার পাশে, ঝোপের ভেতর অজস্র বাঁশের মাচা তৈরি হয়েছে। তরুণেরা সেখানে বসে তাস খেলে, মাদক নেয়, মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ‘নীল-ধ্যান’ করে। দল বেঁধে মোটরসাইকেল হাঁকায়। মেয়েদের পিছু লাগে।
কথায় বলে অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। দীর্ঘ অবসরে অনেকে পড়ালেখায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে। মাদারীপুরের মাসুদ কলেজ বন্ধ বলে ঢাকার কলাবাগানে এসে মোটর মেকানিকের কাজ নিয়েছে। আর পড়বে না সে। কাজ শিখে বিদেশ যেতে চায়।
কিশোরগঞ্জ ও ভোলার অনেক শিশু স্কুল বন্ধ বলে কাজ নিয়েছিল রূপগঞ্জের হাশেম ফুডসের কারখানায়। তাদের আগুনে মৃত্যু দেখে স্কুল বন্ধের এই জ্বলন্ত পরিণামটাও আমরা জানলাম। জানলাম যে ‘মাচা নিবাসী’ যুবকদের ভয়ে বাবা-মায়েরা বালিকাদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন।
সমাধান সরকারের হাতে। শিক্ষকদের টিকা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভারতের মতো ১৮ বছর বয়সীদেরও টিকা দিতে হবে। সরকার যদি পোশাক কারখানা খুলে দিতে পারে, তাহলে বিদ্যালয় খুলতে অসুবিধা কী? তিন দিক খোলা রেখে এক দিক (শিক্ষা) বন্ধ রাখা খামখেয়ালিপনা। বন্ধ রাখলে সব বন্ধ রেখে সংক্রমণ ভগ্নাংশের ঘরে নিয়ে আসুন। তারপর সব খুলুন। আর যদি না-ই খোলেন তো স্বীকার করুন, করোনা মোকাবিলায় আমাদের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা, আমাদের টিকাদান কর্মসূচি ব্যর্থ।
আমাদের মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন, আমাদের পপুলেশন ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যা সুবিধার বোনাসের সামর্থ্য সব রসাতলে যাবে, যদি আমরা শিক্ষাব্যবস্থাকে এভাবে স্থবির করে রাখি। ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে যেতে চাইছে, শিক্ষকেরা পড়াতে চাইছেন, অভিভাবকদের বড় অংশও ঘরে রেখে বাচ্চাদের সামলাতে পারছেন না। এ অবস্থাকে শিক্ষার দুর্ভিক্ষ ছাড়া আর কী বলা যায়?
বাংলাদেশ এ পর্যন্ত উঠে এসেছে শিক্ষার প্রতি তীব্র অনুরাগ দিয়ে। বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষত কৃষকেরা তাঁদের সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে সব সময় উন্মুখ ছিলেন বলেই সাক্ষরতা ও শিক্ষার হারে আমরা উপমহাদেশের মধ্যে অনেক এগিয়ে। কিন্তু করোনাকালে খামখেয়াল দেখে বলতে হচ্ছে, ‘সকলই গরল ভেল’।
লেখক : ফারুক ওয়াসিফ, লেখক ও সাংবাদিক।
সান নিউজ/এনএম