আনিসুল হক : রাতের রানি নিয়ে হইচই হচ্ছে খুব। নারীরা প্রতিবাদ করছেন, ফেসবুক ভেসে যাচ্ছে সরব সক্রিয় প্রতিবাদের বন্যায়। কিন্তু রাতের রাজাদের কথা কই? বিস্ময়ের সঙ্গে, হতাশার সঙ্গে এবং ভয়ানক আতঙ্কের সঙ্গে লক্ষ করি, আমাদের দেশটা রাতের রাজাদের উর্বর বীজতলা, লালনক্ষেত্র এবং চারণক্ষেত্র হয়ে উঠল।
সত্তরের দশকের বাংলাদেশি সিনেমায় একটা-দুটো দৃশ্য থাকত। খলনায়কেরা রাতের বেলায় কোনো কোনো বাড়িতে যেতেন, সেখানে একজন-দুজন নর্তকীর চরিত্র থাকত, কোনো শিল্পীর গাওয়া গানের সঙ্গে তাঁরা নাচতেন আর ভিলেন শরাব হাতে তাঁর পাশাপাশি কোমর দোলাতেন। কখনো কখনো সেই সব পার্টি হতো ডিসকো ধরনের। চিরকাল হাসাহাসি করেছি, ঢাকায় এই ধরনের পার্টি কোথায় হয়! ঢাকার সিনেমার প্রধান উৎস ও প্রেরণা যেহেতু ছিল বোম্বে, কাজেই বোম্বের আন্ডারওয়ার্ল্ডের নকল করে ঢাকায় একটা আন্ডারওয়ার্ল্ড কল্পনা করে নিচ্ছেন সিনেমা-নির্মাতারা, এই ছিল আমাদের ধারণা।
খারাপ টাকা সব সময় ভালো টাকাকে অপসারণ করে। আবার খারাপ পুঁজি থেকে ভালো কাজ কমই হয়। আশির দশকেও আমাদের চলচ্চিত্রের লগ্নি আসত আলু-পটোলের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে, যাঁরা তাঁদের কোমরে রোজ কোটি টাকা গুঁজে রাখতেন, শুধু মুখের কথায় কোটি কোটি টাকার লেনদেন করতেন প্রতিদিন। ঢাকার সিনেমার মান খুব খারাপ হয়ে গেল। নাচ-গান, ফাইটের পর সিনেমায় এল নৃশংসতা। এক সিনেমায় দেখি, একটা এলাকার এক সন্ত্রাসী কাম লোকাল লর্ড কাম লিডার চিৎকার-চেঁচামেচি করতে করতে দলবল নিয়ে এক বাড়িতে হামলা করে এক গর্ভবতী মহিলার পেটে ভোজালি চালিয়ে দিল আর অমনি পেটের বাচ্চা বেরিয়ে এল।
আমাদের দেশে এলাকাভিত্তিক রাজনৈতিক ‘গডফাদার’ কয়েকজন কুখ্যাত হয়েছিলেন বটে, কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে দেখলে এই দেশে তখন কোনো ‘গডফাদার’ ছিল না। ভয়ংকর আন্ডারগ্রাউন্ড ডনদের বাস্তব গল্প আমরা শুনি মুম্বাই সম্পর্কে। ইতালিতে বোধ হয় সত্যিকারের গডফাদাররা বিরাজ করতেন। নিউইয়র্কও একসময় কুখ্যাতি অর্জন করেছিল রাতের রাজাদের কীর্তিকলাপের জন্য। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের কাছে ছিল অসহায়। সিনেমার গল্পে দেখেছি, কখনো কখনো পুলিশের কোনো কোনো লোক এবং রাজনীতির বড় বড় লোক এদের সঙ্গে জড়িত ছিল। মেক্সিকোর মতো দেশগুলোয় মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রাষ্ট্রের যুদ্ধ বছর দশেক আগেও হয়েছে ভয়ংকর রকম, এখনো নিশ্চয়ই সেই যুদ্ধ কমবেশি অব্যাহত আছে।
কিন্তু আমাদের দেশে রাতের রাজারা ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল, সেই রকম তো কখনো দেখিনি। সিম্পল লিভিং, বিগ থিংকিং ছিল এই দেশের আদর্শ। আমরা গল্প শুনে বড় হয়েছি, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় পড়েছেন, তিনি বিদ্যাসাগর হয়ে বই বিক্রির টাকায় রীতিমতো ধনবান হয়ে ওঠার পরও এক জোড়া চটি, একটা মলিন ধুতি আর একটা চাদরই ছিল তাঁর বেশ। লোকে তাঁর বাড়িতে গিয়ে বাগানে কর্মরত তাঁকেই বাড়ির চাকর ভেবে জিজ্ঞেস করত, বিদ্যাসাগর মশাইকে একটু ডেকে দেওয়া যাবে? আমাদের কমিউনিস্ট নেতারা জমিদারের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও জমিদারি ছেড়ে দিয়ে দারিদ্র্য বরণ করে নিতেন সমাজ থেকে গরিবি হটাবেন বলে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান থেকে ছাড়া পেয়ে লন্ডনে গিয়ে কিছুতেই দামি হোটেলে উঠতে চাননি। বলেছেন, ‘রাসেল স্কয়ারে সস্তা হোটেলে রাখো, আগেরবার যেখানে এসে থেকেছিলাম।’ এই সব হোটেলে বেকার ছাত্ররা থাকে বলেও তাঁকে মানানো যাচ্ছিল না। তার জন্য আসা লিমুজিনে না উঠে তিনি বাঙালি কূটনীতিকের গাড়িতে উঠে এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে গিয়েছিলেন। বেগম মুজিব তাঁর ছেলেমেয়েদের বাহুল্যের মধ্যে বড় করেননি, বড় করেছেন মিতব্যয়িতার মধ্যে। তিনি সবার জামাকাপড় সেলাই করে দিতেন, তাঁদের বড় মেয়ে শেখ হাসিনাও ঈদে সেলাই মেশিনে ভাই-বোনদের জামা সেলাই করতেন।
বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি, বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী, বেগম মুজিব কোনো দিন ধানমন্ডি ছেড়ে বঙ্গভবন কি গণভবনে যাননি। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩২ নম্বরের বাড়ি ছারখার হওয়ার পর যখন তাঁরা ধানমন্ডি ১৮-এর গৃহবন্দিত্বের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় যাবেন জানেন না, তখনো বঙ্গভবন বা গণভবন নয়, ধানমন্ডিতেই আরেকটা বাসা ভাড়া নিয়ে জাতির জনককে নিয়ে তাঁরা উঠেছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ একাত্তরে কলকাতায় থিয়েটার রোডের বাড়িতে থাকতেন চৌকির ওপর, নিজের কাপড় নিজেই কাচতেন। আমাদের আদর্শ তো হওয়ার কথা মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের মতো বিচারপতি, খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের মতো ব্যাংকার, আকবর আলি খানের মতো আমলা!
সেই দেশে আজকে কী খবর আমাদের দেখতে হচ্ছে! ই-কমার্সের নামে হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করছে, ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়ে বিদেশে পালাচ্ছে, ঢাকার পাঁচতারা হোটেলে স্যুইট স্থায়ীভাবে ভাড়া করে প্রমোদকুঞ্জ বসানো হচ্ছে, ক্যাসিনোর নামে এক অন্ধকার জগৎ রাতের ঢাকাকে শাসন করছে। আর সেসবের সঙ্গে যুক্ত আমাদের যুবনেতারা, ছাত্রনেতারা, ক্ষমতাশালী ব্যক্তিবর্গ, লুটেরা ধনিকেরা, তাঁদের উচ্ছন্নে যাওয়া কিন্তু ক্ষমতাদর্পী ছেলেপেলেরা, এখন তো দেখা যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তাদের কেউ কেউ। হাজার কোটি টাকার মাদকের ব্যবসা চলছে। উদ্ধার করা হচ্ছে ভয়ংকর সব মাদক। এখানে-ওখানে ক্লাব কালচারের নামে কেবল যে ঢাকার একটা ‘নাইটলাইফ’ বানানো হচ্ছে তা-ই নয়, এই সব জায়গায় অবৈধ লেনদেন, অপরাধ, অস্ত্র, মাদক ইত্যাদির কেনাবেচা, চুক্তি-যুক্তি, দেওয়া-নেওয়ার মচ্ছব চলছে।
রাতের রাজারা শুধু রাতের অন্ধকারে চলাচল করলে তবু কিছুটা সান্ত্বনা নিজেকে দেওয়া যেত। কিন্তু এই রাতের রাজারাই আমাদের দিনেরও রাজা। যাঁরা দিনের বেলায় আমাদের শিশু-কিশোরদের হাতে পুরস্কার এবং কানে মধুর হিতোপদেশ বিতরণ করছেন, তাঁরাই রাতের বেলায় রাতের রাজা হয়ে উঠছেন!
এখন ঢাকার সত্যিকারের চরিত্রগুলো নিয়ে গডফাদার, ডন, আউট ল মার্কা সিনেমা-নাটক বানানো সম্ভব এবং সত্যি কথা বলতে কি, ওয়েব সিরিজও বানানো হচ্ছে। রাতের রাজারা শুধু রাতের অন্ধকারে চলাচল করলে তবু কিছুটা সান্ত্বনা নিজেকে দেওয়া যেত। কিন্তু এই রাতের রাজারাই আমাদের দিনেরও রাজা। যাঁরা দিনের বেলায় আমাদের শিশু-কিশোরদের হাতে পুরস্কার এবং কানে মধুর হিতোপদেশ বিতরণ করছেন, তাঁরাই রাতের বেলায় রাতের রাজা হয়ে উঠছেন! গডফাদারদের সত্যিকারের ফাদার বলে ভ্রম হচ্ছে। কোনটা চিনি, কোনটা বালু তা আর আলাদা করা যাচ্ছে না। মাঝেমধ্যে অভিযান চলছে, তখন খবর পড়ে আমরা বিহ্বল হয়ে পড়ছি। মাঝেমধ্যে এখানে-ওখানে তথ্য প্রকাশিত হলে আমাদের রক্তে সাপের শরীরের মতো হিম স্পর্শ এসে লাগছে। এদের কাছে ভালোরা অসহায় বোধ করছেন। কী করব, এদের শিকড় যে অনেক শক্তিশালী বলে তাঁরা হাত কামড়াচ্ছেন।
এই দেশ এমন ছিল না। কোত্থেকে হলো এই রকম! এর কারণ অবশ্যই লুটেরা পুঁজির দৌরাত্ম্য, কালোটাকার আস্ফালন। আইনশৃঙ্খলাকে মত্ত হাতির মতো পায়ে দলে সর্বগ্রাসী লোভের হস্ত বাড়িয়ে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি করতে পারলে রাতারাতি বড়লোক হওয়া যায়, তখন আইন আর শৃঙ্খলা এসে তাদের পকেটের মধ্যে ঢুকে পড়ে।
আর সেটা হতে পেরেছে সুশাসনের অভাব থেকে। জবাবদিহি না থাকার কারণে। সদুপদেশ কিংবা ক্ষমতাচূড়ার নিজস্ব সাধুতা, কৃচ্ছ্রতা তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আমাদের আতঙ্ক হলো কালোটাকা যেমন ভালো টাকাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে, এই রাতের রাজারা না আবার আমাদের মূলধারার নিয়ন্তা হয়ে ওঠে। আন্ডারওয়ার্ল্ড না হয়ে ওঠে আপার ওয়ার্ল্ড। কালোই না হয়ে ওঠে দিনের বেলার প্রধান বাস্তবতা। দিনের বেলা আঁধার আসে তখন, যখন সূর্যগ্রহণ হয়। আমরা তো তা হতে দিতে পারি না। আমাদের কালটাকে সূর্যগ্রহণের কাল বানাতে পারি না। রাহুর গ্রাসে আলোর উৎসকে গ্রস্ত হতে দিতে পারি না।
রাতের রাজারা যদি দিনের রাজাদের অপসারণ করে, তাহলে বঙ্গবন্ধুর দেশে, লালনের দেশে, সুফিয়া কামালের দেশে, তাজউদ্দীনের দেশে, বেগম মুজিবের দেশে এর চেয়ে দুঃখের আর কিছুই থাকবে না!
লেখক : আনিসুল হক, সাহিত্যিক ও সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো।
সান নিউজ/এনএম