হেলাল মহিউদ্দীন : তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়া যেমন হওয়ার কথা, তেমনই হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সচিব (পূর্ব) ১৫ আগস্ট দিবাগত রাতে একটি জাতীয় পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দেন। তাঁর ভাষ্য, বাংলাদেশ আফগানিস্তানের ‘জনগণের সঙ্গে’ আছে। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ অতীতেও আফগানিস্তানের জনগণের সঙ্গে কাজ করেছে। ভবিষ্যতেও আফগান জনগণের রায়ের প্রতি বাংলাদেশের পূর্ণ সমর্থন থাকবে।
যদিও ‘জনগণের রায়’ দেওয়ার সুযোগ আদৌ কখনো আসবে কি না, কেউই নিশ্চিত নয়। কারণ, ১৯৪৯ সালের পর আর কোনো নির্বাচনেই জনগণের ইচ্ছার তেমন কোনো প্রতিফলন হয়নি। ১৯৬৪ সালের নির্বাচনও ছিল রাজা জহির শাহর পছন্দনীয় মানুষদের নির্বাচনী কাণ্ড। অনেকটা আইয়ুব সরকারের ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ আদলের। ১৯৬৫ সালের নির্বাচনে স্বল্পসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতির পরও অবশ্য নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু হয়েছিল। কিন্তু সেটিকে জনগণের রায় বলা কঠিন ছিল। তারপরের নির্বাচনগুলো হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের, নয়তো মার্কিনদের ছত্রচ্ছায়ায় হয়েছিল।
আফগান জনগণ কোন ধরনের সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থা চায়, সেটি ২০২০ সালের শুরুতে প্রথম জানা গেল। আফগান ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ নামের প্রতিষ্ঠানটি ‘শান্তি অধ্যয়ন’ সিরিজের ষষ্ঠ গবেষণায় প্রথমবারের মতো জনগণের প্রত্যাশা কী, সেটি আমাদের জানায়। গবেষণাটির শিরোনাম ছিল, ‘রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সংঘাত-উত্তর শাসনব্যবস্থার ধরন সম্পর্কে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি’ (পলিটিক্যাল সেটেলমেন্ট অ্যান্ড পোস্ট-কনফ্লিক্ট অর্ডার ইন আফগানিস্তান পিপলস ভিউ)।
আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশের জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি এতে উপস্থাপিত হয়।
উত্তরদাতাদের ৬৪ শতাংশই জানিয়েছে, তালেবানের বিদায়ের পরবর্তী সরকারব্যবস্থা মন্দের ভালো এবং তা মেনে নেওয়া যায়। তাদের ৮০ শতাংশই বলেছে, তারা নিখাদ গণতন্ত্র চায়, সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার চায় এবং সুষ্ঠু ও বৈধ সরকার চায়। সোজা কথা, তালেবানের ফিরে আসা তারা চায়নি।
মাত্র এক বছর আগের এই গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলকে আমলে নিলে অনায়াসে বলা যায়, তালেবানের ক্ষমতা দখলে বেশির ভাগ আফগানই অখুশি। তালেবানের ক্ষমতা পুনর্দখল তাদের আরাধ্য ছিল না। কিন্তু ২০১৯ সালের কারচুপির নির্বাচনে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় ফেরা আশরাফ গনিকেও তারা তাদের সরকার হিসেবে মেনে নিতে পারছিল না।
গনির সরকার প্রশাসনকেও দুর্নীতিবাজ করে তুলেছিল। ফলে জনগণের ভোগান্তি বেড়েছিল। তারা চেয়েছিল গনির সরকারও বিদায় হোক। তাই তালেবানের শহরের পর শহর দখলের পরও গনির পক্ষে নামার মতো জনগণের দেখা মেলেনি। সেনাবাহিনীও লোকক্ষয়ের প্রতিরোধে নামার কোনো কারণ খুঁজে পায়নি। আফগান জনগণ ক্রমেই বুঝতে পারছে, তারা ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে পড়েছেন। তালেবান যতই আশ্বস্ত করতে চাইছে, তারা আগের নৃশংস তালেবান আর নেই, জনগণ বিশ্বাস করতে পারছে না। এসব আশ্বাসে নারীদের বিশ্বাস প্রায় শূন্যের কোঠায়। এটি অনুমান করা যায়, তালেবান রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পরিপক্বতা নিয়ে যথেষ্ট উদার অবস্থান না নিলে দেশে গৃহযুদ্ধ, হানাহানি, ভাঙন, প্রাণ ও সম্পদ ক্ষয় আবারও বাড়বে।
তালেবানের শাসনে বাংলাদেশের চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ আছে কি না—এই প্রশ্ন অনেকেরই। সত্য হচ্ছে, বাংলাদেশকে শুধু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলেই চলবে না, বিপদ মোকাবিলার প্রস্তুতির পথেই যেতে হবে। আপাতত বাংলাদেশ সতর্ক মন্তব্যের আশ্রয় নিয়েছে। কূটনীতির কিছু ছকবাঁধা বুলি থাকে। গা বাঁচানো বা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানির’ মতো। যেমন ‘আমরা গভীরভাবে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছি’ অথবা ‘সংশ্লিষ্ট দেশের জনগণের ইচ্ছার প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন থাকবে’ অথবা ‘জনগণই দেশের ভালোমন্দের সিদ্ধান্ত নিক’ ইত্যাদি। বোধগম্য কারণেই বাংলাদেশের এই সতর্ক অবস্থানটি যথার্থ।
বাংলাদেশ অবশ্য খানিকটা উদ্বেগাকুল মন্তব্য করলেও তেমন অযথার্থ হতো না। কারণ, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতি। তবু বাংলাদেশ সতর্ক অবস্থা মেনে বা গা বাঁচিয়েই হয়তো বলতে পারত ‘আশা করা যায় তালেবান উদার গণতন্ত্রের পথে যাত্রা করবে।’
বাংলাদেশের অতি সতর্ক অবস্থানের কারণ আফগানিস্তান এখন সার্কের সদস্যরাষ্ট্র। সেদিক থেকে গোষ্ঠীভুক্ত দেশ হলেও কূটনৈতিক সম্পর্ক পরোক্ষ ধরনের। দেশটিতে বাংলাদেশের দূতাবাসও নেই। তা ছাড়া আফগানিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কখনো কোনো রকম বিরোধও তৈরি হয়নি। উপরন্তু বাংলাদেশ আফগানিদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান থেকে একদল বাংলাদেশি আফগানিস্তানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। এমনকি পাকিস্তানে আটকা পড়া বাংলাদেশে আগমনেচ্ছু বাংলাদেশিদেরও আফগানিস্তান হতে ভাড়া করা বিমানেই মুক্ত স্বাধীন স্বদেশে পরিবহন করা হয়। এই কৃতজ্ঞতার দায় থেকেও বাংলাদেশের কূটনৈতিক শিষ্টতার পথ যথার্থ হয়েছে। বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র ভারত পাকিস্তানকে দোষারোপ করে চললেও বাংলাদেশ সে রকম প্রতিক্রিয়া এড়িয়ে চলার বুদ্ধিদীপ্ত পথ ধরেছে। বাংলাদেশ জানিয়েছে, আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থিতিশীলতাই প্রত্যাশিত। আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার পক্ষেই দেশটির অবস্থান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ১৪ আগস্টেই জানান, আফগানিস্তানে তালেবান কিংবা সরকার কারও সঙ্গেই বাংলাদেশের কোনো ঝগড়া নেই। বাংলাদেশের ভাষ্যে তালেবানকে স্বীকৃতিদানে অনীহা প্রকাশ পেয়ে গেলে বাংলাদেশকেই ভূরাজনৈতিক ও আঞ্চলিকভাবে আরও বেশি বিপন্নতার ঝুঁকিতে পড়তে হতো।
তালেবানের কাবুল দখল বাংলাদেশকে যথেষ্ট আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। কারণটি কৌশলগত। যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের নেতৃত্বে কোয়াডের কার্যক্রম শুরুর বিষয়টি চীন মোটেই ভালোভাবে নেয়নি। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাই একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় উঠেপড়ে লেগেছে চীন। তালেবানের প্রতি চীনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইন্ধন গত কয়েক মাসে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। চীনের উইঘুর মুসলিম নির্যাতন বিষয়ে তালেবান জানিয়েছিল, ‘চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে’ তারা নাক গলাবে না। তখনই বোঝা গিয়েছিল তালেবানের পেছনে চীন জুটেছে। চীনের উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক নয়। এটিও তালেবানের চীনপ্রীতির আরেকটি কারণ। চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আফগান অংশ নির্বিঘ্নে শেষ করতে চায়।
তালেবান ইতিমধ্যে প্রতিশ্রুতিই দিয়ে বসেছে, তারা চীনকে বিআরআই বিষয়ে সর্বাত্মক সহায়তা দেবে। কারণ, ‘অর্থনীতি’ই তালেবানের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। বিআরআই সে ক্ষেত্রে তাদের জন্য সোনার ডিম পাড়া হাঁস হয়ে উঠতে পারে।
কথা হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের কী সমস্যা? সমস্যা বহুবিধ। মিয়ানমারের সেনাশাসকেরা সম্পূর্ণভাবেই চীন সমর্থিত। মিয়ানমার যেকোনো ছুতোয় বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া ঠেকাতে চাইবে। মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গা ঠেকানো প্রকল্পে চীনের সায়ই শুধু নয়, সমর্থন ও সহায়তাও থাকবে। এ বিষয়েও কারণ একই—চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থ। রাখাইন রাজ্যের আশপাশে মিয়ানমারে চীন প্রতিষ্ঠা করতে চলেছে এশিয়ার অন্যতম বড় শিল্পনগরী।
বিআরআই প্রকল্প শেষ করার প্রয়োজন তো আছেই। রাখাইন রাজ্য পর্যন্ত তেল, গ্যাসলাইন এবং রেলপথ টানার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। চীনের উদ্দেশ্যই থাকবে এই অর্থনৈতিক স্বার্থটির সুরক্ষা।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত একটি নাজুক সীমান্ত পথ। এ পথে ইয়াবা, আইস, মেথসহ নানা মাদক যেহেতু সহজেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাচার করা সম্ভব, অস্ত্রশস্ত্র এবং গোয়েন্দা কার্যক্রমের আগমন-নির্গমনও সম্ভব। চীন-মিয়ানমার জোট বাংলাদেশকে বশে রাখার জন্যও তটস্থ করে রাখার কৌশল নিতে পারে। রোহিঙ্গাদের নানাভাবেই ব্যবহার করা সম্ভব। তালেবানের নীতি-আদর্শের প্রতি বিশ্বাসী কিছু মানুষের ভক্তি-শ্রদ্ধা-বিশ্বাস থাকা অস্বাভাবিক নয়। রোহিঙ্গা ও অ-রোহিঙ্গাদের মধ্যে তালেবান-সহানুভূতিশীলদের মিয়ানমার হয়ে আফগানিস্তান ও তালেবান-সংযোগ অসম্ভব কিছু নয়। ভিনদেশে অস্ত্র ও যুদ্ধবিদ্যার প্রশিক্ষণও মিলতে পারে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের একটি ছোট দলকেও তালেবানমনস্ক বা জঙ্গি প্রমাণ করা গেলে মিয়ানমারের সীমাহীন লাভ। জঙ্গি অজুহাত তৈরি করা গেলে মিয়ানমারের জন্য রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে অস্বীকৃতি জানানো অনেকটাই সহজ হয়ে উঠবে। আফগানিস্তান মার্কিন ছত্রছায়াযুক্ত বা তালেবানমুক্ত থাকলে বাংলাদেশকে এই ভূরাজনৈতিক ঝুঁকির কবলে পড়তে হতো না।
বাংলাদেশকে তালেবানের পুনরুত্থান, ক্ষমতা দখল ও পরবর্তী পদক্ষেপগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণে নামতে হবে। বাংলাদেশের কাম্য আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য সতর্কতা, সাবধানতা এবং সীমান্ত ব্যবস্থাপনাও সুসংহত করতে হবে।
লেখক : ড. হেলাল মহিউদ্দীন, অধ্যাপক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেন্টার ফর পিস স্টাডিজের সদস্য
সান নিউজ/এনএম