মো. তৌহিদ হোসেন : তালেবান যোদ্ধারা ১৫ আগস্ট বিনা বাধায় কাবুলে প্রবেশ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, তাঁরা রক্তপাত চান না, শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানিয়েছেন। এ–ও বলেছেন, তাঁরা কোনো প্রতিশোধ চান না, সব আফগানকে নিয়েই দেশ চালাতে চান। কাবুলের মানুষ অবশ্য তাতে আশ্বস্ত হয়নি। প্রাণ বাঁচাতে যেভাবেই হোক, শহর ত্যাগের চেষ্টা করছে অনেকেই। শহরে ও এয়ারপোর্টে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে।
২০ বছর ধরে মার্কিনদের হাতে গড়ে তোলা আফগান সেনাবাহিনী কী করে ত্বরিত তালেবানের সামনে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে, এ নিয়ে ভবিষ্যতে অনেক গবেষণা হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছিলেন, দেড়-দুই মাস কাবুল নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে ক্ষমতাসীন সরকার, আর সে ক্ষেত্রে হয়তো তালেবানের সঙ্গে দর-কষাকষির খানিকটা সুযোগ থাকত। রাশিয়ানরা যখন আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে, তাদের সমর্থিত নজিবুল্লাহ সরকার কিন্তু তারপরও দীর্ঘদিন কাবুল এবং আরও কিছু শহরের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল। এ সময় আমি সরকারি কাজে দিল্লি থেকে কাবুলে গিয়েছিলাম এক সপ্তাহের জন্য। চারপাশের পাহাড়ে মুজাহিদীনরা ছিল। কিন্তু আফগান বিমানবাহিনী তাদের ওপর আক্রমণ বজায় রেখেছিল। কিছু রকেট এসে পড়ত শহরে, তবে নগরবাসী বেশ মানিয়ে নিয়েছিল এর সঙ্গে। এবারে আফগান বিমানবাহিনীর কোনো অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়নি। সেনারা তো পালিয়ে বাঁচার দিকেই মনোযোগ দিয়েছিল বেশি।
তাড়াতাড়ি পাততাড়ি গোটানোর জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রবল সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছেন, এমনকি তাঁর নিজ দলের নেতাদের পক্ষ থেকেও। তবে বাইডেন একটি কথা একদম সঠিক বলেছেন। তিনি বলেছেন, মার্কিন সেনারা আরও পাঁচ বছর আফগানিস্তানে থাকলেও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হতো না। আফগান সেনাবাহিনী বেতনের বিনিময়ে মার্কিনদের সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে মাত্র। সত্যিকার অর্থে স্বাধীনভাবে লড়াই করার মতো মানসিকতাই তারা অর্জন করতে পারেনি।
গত ২০ বছর আফগানিস্তানে মার্কিনদের সমর্থনপুষ্ট সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ স্বাভাবিক কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এর আগে মুজাহিদীন সরকারকে হটিয়ে যখন তালেবান ক্ষমতা দখল করেছিল, সে সরকারের মেয়াদে বাংলাদেশ কোনো সম্পর্ক গড়তে যায়নি। নতুন বাস্তবতায় তাহলে কী করবে বাংলাদেশ? শুরুটা কিন্তু খারাপ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র চাইছিল, মার্কিনদের সহায়তা করার কারণে যে আফগানরা তালেবানের কোপানলে পড়তে পারে, তাদের একাংশকে বাংলাদেশে ‘সাময়িক’ আশ্রয় দিতে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। প্রথমত, সাময়িকের কোনো সংজ্ঞা নেই। যদি তাদের ইউরোপ বা আমেরিকায় পুনর্বাসন করতে হয়, সেটা এখনই করা যায়। আছে উপসাগরীয় দেশগুলো, যাদের রাজন্যের অস্তিত্ব মার্কিন সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল। সাময়িক আশ্রয় সেখানেও দেওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা, তালেবান এবার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার জন্য এসেছে। বাংলাদেশে এরূপ আশ্রয় দেওয়া তাদের প্রতি বৈরী আচরণ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
গত ২০ বছর আফগানিস্তানে মার্কিনদের সমর্থনপুষ্ট সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ স্বাভাবিক কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এর আগে মুজাহিদীন সরকারকে হটিয়ে যখন তালেবান ক্ষমতা দখল করেছিল, সে সরকারের মেয়াদে বাংলাদেশ কোনো সম্পর্ক গড়তে যায়নি। নতুন বাস্তবতায় তাহলে কী করবে বাংলাদেশ?
তালেবান সরকারকে যেন বাংলাদেশ স্বীকৃতি না দেয়, এমন অনুরোধও এসেছে মার্কিন তরফ থেকে। প্রকৃতপক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই তালেবানকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তাদের প্রতিষ্ঠিত আফগান সরকারকে সঙ্গে না নিয়ে তালেবানের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সরকারের রূপরেখা নিয়ে দর-কষাকষি করছে। এমতাবস্থায়, স্বীকৃতি না দেওয়ার এই আবদার নিতান্তই বালকোচিত। গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক শক্তিগুলো ইতিমধ্যেই তালেবানের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ স্থাপন করেছে এবং কিছুদিনের মধ্যে সরকার গঠিত হলে অবশ্যই সে সরকারকে তারা স্বীকৃতি দেবে। এমনকি সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে যে ভারত, তারাও তালেবানের সঙ্গে কাজ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের তাড়াহুড়োর কোনো প্রয়োজন নেই। তবে যথাসময়ে, আফগানিস্তানের প্রতিষ্ঠিত সরকারের সঙ্গে নিজেদের স্বার্থেই আমাদের যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে।
আফগানিস্তানের সঙ্গে আমাদের চলমান দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। একটি হচ্ছে, ব্র্যাক সেখানে আর্থসামাজিক উন্নয়নে দীর্ঘদিন তাদের প্রকল্প চালু রেখেছে। নতুন পরিবেশে তারা তাদের কাজ কতটা চালিয়ে যেতে পারবে, এটা একটা প্রশ্ন। তবে যে কর্মীরা সেখানে আছেন, তাঁদের নিরাপত্তা যেন বিঘ্নিত না হয়, সে বিষয়ে নতুন ক্ষমতাবানদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। আফগানিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের পরিমাণ খুব বেশি নয়, তবে তার একটা বড় অংশ ওষুধ। আমাদের ওষুধশিল্পের জন্য এটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, যে সরকারই কাবুলে ক্ষমতায় থাকুক, এটা তাদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বাংলাদেশ সবচেয়ে কম দামে মানসম্পন্ন ওষুধ রপ্তানির সুনাম অর্জন করেছে। বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখার এবং বৃদ্ধির কৌশল এখন থেকেই ঠিক করতে হবে।
সবশেষে নিরাপত্তা ইস্যু। তালেবানের বিজয় নিয়ে প্রায় সব নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞই প্রচণ্ড উদ্বেগ ব্যক্ত করেছেন। তাঁদের এ উদ্বেগ যুক্তিসংগত। বাংলাদেশে যে ক্ষুদ্র কট্টরপন্থী গোষ্ঠী রয়েছে, তালেবান তাদের অনুপ্রেরণার উৎস ছিল এবং আফগানিস্তানে তালেবানের পরিপূর্ণ বিজয়ে তারা নতুন করে অনুপ্রাণিত হতে পারে। তবে আমার মনে হয়, বিগত বছরগুলোতে আমাদের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। কট্টরপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে তারা উল্লেখযোগ্য সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। তবে সচেতনতা ও নজরদারিতে কোনো শৈথিল্য যেন না আসে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আমরা আরেকটা হোলি আর্টিজান ঘটনা চাই না।
প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে দোহায় তালেবান মুখপাত্র মুহাম্মাদ নাইম ওয়ারদাক বলেছেন, দেশের বাইরে তালেবানের কোনো অ্যাজেন্ডা নেই। এটা ঠিক কথার কথা বলে মনে হয় না। তালেবান যখন কাবুলের ধারেকাছে নেই, তখন তাদের সঙ্গে উচ্চপদস্থ চীনা কর্মকর্তাদের প্রকাশ্য সভা হয়েছে। তালেবান দেশের বাইরে ইসলামি বিপ্লব রপ্তানি করবে কি না, এতে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি উদ্বেগ চীনের। কারণ, ওয়াখান করিডরের মাধ্যমে শিন জিয়াংয়ের সঙ্গে সীমান্ত আছে আফগানিস্তানের। আর তালেবান যেন নির্যাতিত উইঘুরদের পাশে না দাঁড়ায়, এটা চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের জন্য চীনের সমর্থন সহায়তা হবে নিতান্ত প্রয়োজনীয়। উভয়ের স্বার্থেই তাই তালেবান উইঘুর বিষয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকবে, যেমনটি করে আসছে পাকিস্তান।
একটি আশঙ্কার কথা অবশ্য আমি পুরো বাদ দিতে পারছি না। যে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা তরুণ ক্যাম্পগুলোতে অবস্থান করছেন, তাঁদের মধ্যে কট্টর মতবাদে বিশ্বাসী অনেকেই থাকতে পারেন। তালেবানের বিজয় তাঁরা কীভাবে দেখছেন, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ক্যাম্পগুলোয় বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণ খুব শিথিল। এটি দীর্ঘ মেয়াদে দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। সময় থাকতে এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া খুবই জরুরি।
লেখক : মো. তৌহিদ হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব
সান নিউজ/এনএম