এম সাখাওয়াত হোসেন : মানুষের জীবনে অনেক ঘটনা ঘটে, অনেক স্মৃতির জন্ম দেয়। অনেক স্মৃতি মুছে যায়, কষ্ট করে মনে করতে হয়। আবার কিছু স্মৃতিকে কোনোভাবেই ভোলা যায় না। আমার জীবনে এমনই এক স্মৃতি, যা প্রায় প্রতিনিয়তই স্মৃতিপটে ছবির মতো ফুটে ওঠে। আমার জীবনে এমনই এক বৃহৎ স্মৃতি, যা আমি জীবনে ভুলতে পারব না, সেটা হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কতিপয় বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তার হাতে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবার নিহত হওয়া এবং তার পরের ঘটনা। অনেক প্রশ্ন তাড়িয়ে বেড়ায়, যার সহজ উত্তর নেই।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর পর থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তৎকালীন সামরিক বাহিনী কর্তৃক দেশের নেতৃত্বের শূন্যতার মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে যেভাবে জড়িয়ে ২২টি ছোট-বড় অভ্যুত্থান আর বিশৃঙ্খলায় যুক্ত হয়ে পড়েছিল, আমি সে সম্বন্ধে লিখেছিলাম, যা ১৯৯৬ সালে অবসরে যাওয়ার পর প্রকাশ করা হয়েছিল। ওই বইয়ের বেশির ভাগ অংশজুড়ে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর পরবর্তী ঘটনার বিবরণ দিয়েছিলাম।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর দিনটি ছিল শুক্রবার। আমি তখন ঢাকা ব্রিগেডের দুজন স্টাফ অফিসারের একজন। ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিল বীর বিক্রম, একজন অত্যন্ত সৎ মুক্তিযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধুর প্রতি যাঁর ছিল অগাধ ভক্তি। তিনি বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজনদের মধ্যে একজন ছিলেন। অপর জ্যেষ্ঠ স্টাফ অফিসার ছিলেন মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন বীর বিক্রম (বর্তমানে বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত ও সাবেক মন্ত্রী)। ভোর প্রায় সাড়ে পাঁচটা হবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চল থেকে ব্রিগেডের ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানির অধিনায়ক ক্যাপ্টেন (তৎকালীন প্রয়াত) রাজীউদ্দিনের ফোনে ঘুম ভেঙে গেল। তিনি রেডিও শুনতে বললেন। আমি মাথার কাছে রাখা রেডিও খুলতেই পরিচিত গলায় অবিশ্বাস্য ঘোষণা শুনলাম। ঘোষক মেজর (অব.) শরিফুল হক ওরফে ডালিম যে ঘোষণা দিয়েছিল, তা যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর হত্যা এবং খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠনের ঘোষণা বারবার প্রচারিত হচ্ছিল। কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো কিছু সময় বসে রইলাম। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
আমি আমার ব্রিগেড কমান্ডারের বাসায় ফোন করলাম, শুনলাম তিনি নেই। কিছুক্ষণ আগেই মেজর হাফিজ ও তৎকালীন মেজর খন্দকার রশিদের সঙ্গে বের হয়েছেন। আমার পেছনের বারান্দা দিয়ে সেনাভবনের প্রধান গেট দেখা যায়। একটি সামরিক জিপ বের হওয়া ছাড়া আর কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি। তৎকালীন সেনাপ্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ বীর উত্তম। আমার একমাত্র করণীয় পোশাক পরে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে যাওয়া। হেঁটেই পৌঁছালাম অফিসে। আমি ব্রিগেড কমান্ডার ও মেজর হাফিজের কথা জিজ্ঞাসা করে জানলাম তাঁরা তিন বাহিনী প্রধান, বিডিআর প্রধানসহ হেডকোয়ার্টার-সংলগ্ন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নে রয়েছেন। আরও রয়েছেন উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। ব্যাটালিয়নের রাস্তার মুখে ট্যাংক দাঁড়ানো এবং সেখানে এই অভ্যুত্থানের অন্যতম হোতা শরিফুল হক ডালিম, যাকে কিছুদিন আগে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। কী কারণে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল, তার বিবরণ আগামী প্রকাশনীর ২০১৪ সালে প্রকাশিত মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহর বই ১৫ আগস্ট; এ ন্যাশনাল ট্র্যাজেডি-তে আছে। ততক্ষণে রেডিওতে রণবাদ্য বাজছে।
ঘণ্টাখানেক পরে ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল অফিসে হাজির হলে আমি তাঁর কক্ষে গেলাম। তিনি তাঁর চেয়ারে বসা অত্যন্ত দুঃখভরা করুণ মুখে আমাকে দেখে বলে উঠলেন যে কতিপয় সেনা কর্মকর্তা, যারা মানসিক বিকারগ্রস্ত, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। হত্যা করেছে সেরনিয়াবাত ও শেখ মণিকে। ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, ‘দে শুড বি আনসারেবল অ্যান্ড পানিশড (তাদের জবাবদিহি করতে হবে এবং শাস্তি পেতে হবে)। পরে বললেন, ‘তিন বাহিনী প্রধান ও বিডিআর প্রধান এঁদের নির্দেশে রেডিওতে গিয়েছেন নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের জন্য। এখনো বঙ্গবন্ধুর রক্ত শুকায়নি।’ খন্দকার মোশতাক সম্বন্ধে বললেন যে তিনি যে বিশ্বাসঘাতক, তা স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ই আঁচ করা গিয়েছিল।
ব্রিগেড কমান্ডার অফিসে আসার আগেই আমার ফোনে ওই সময়কার আওয়ামী লীগের কয়েকজন সাংসদ জানতে চেয়েছিলেন, তাঁরা সেনাবাহিনীর কোনো কাজে লাগতে পারেন কি না? আমি বিরক্তি প্রকাশ করে ফোন রেখে দিয়ে ভাবছিলাম, এঁরা কী ধরনের মানুষ। মাত্র কয়েক দিন আগেই হয়তো বঙ্গবন্ধুর একটু সান্নিধ্য পেতে মরিয়া ছিল, আর কয়েক ঘণ্টাতেই এই পরিবর্তন! আমি এ ঘটনা ব্রিগেড কমান্ডারকে বলতে তিনি একটা গালি দিয়ে বললেন যে এখনো বঙ্গবন্ধুর রক্ত শুকায়নি, এর মধ্যেই তাঁদের এই পরিবর্তন। তিনি সকালে তাঁর বাড়ি থেকে হাফিজ আর রশিদের সঙ্গে বের হওয়ার ঘটনাও বললেন। এর মধ্যে আমার অফিসের সেপাই রানার এসে বলল যে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে তৎকালীন মেজর হুদা (অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত ও সাজাপ্রাপ্ত) আমাকে খুঁজছেন। ব্রিগেড কমান্ডার প্রথমে বললেন যে হুদা তো ওই চক্রের। পরে বললেন, শুনে আসেন।
ওই সময়ে কুমিল্লা থেকে আগত প্রথম ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি, যাদের এ মাসের ডিউটি ছিল বঙ্গবন্ধুর বাড়ি গার্ড দেওয়া। এসব নিয়োগ তখন সেনাসদর থেকেই দেওয়া হতো। টেলিফোনে জানালেন যে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা পরবর্তী পর্যায়ে ছবি তুলতে বিটিভি আর দুটি পত্রিকাকে ডেকেছিল ছবি তোলার পর মত পরিবর্তন করে বাশারকে দিয়ে সেনানিবাসে পাঠিয়ে দিতে বলে গেছে। বাশার সেনাসদর ও ব্রিগেডে ফোন করে আমাকে ছাড়া আর কাউকেই পায়নি। এগুলো হস্তান্তর করতে চায় অন্যথায় অন্য কারও হাতে পড়তে পারে। আমি বলেছিলাম যে ব্রিগেড কমান্ডার বললে কাউকে পাঠাতে পারি। অবশ্য তখন আমি আর দুজন ক্যাপ্টেন ছাড়া ব্রিগেডে কেউ ছিল না। হাফিজ ওই দিন সারা দিন অফিসে আসেননি। কোথায় ছিলেন, কেন আসেননি, সে বিষয়ে ২০২০ সালে রচিত তাঁর বই সৈনিক জীবন: গৌরবের একাত্তর রক্তাক্ত পঁচাত্তর-এ (প্রথমা প্রকাশন) লিখেছেন।
সময় তখন আনুমানিক ৯টার কিছু বেশি হতে পারে। আমি ব্রিগেড কমান্ডারের অফিসে গিয়ে দেখলাম, তিনি কারও সঙ্গে কথা বলছেন মনে হলো। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের সঙ্গে কথা বলছেন। কথা শেষ হলে আমি বিস্তারিত জানালাম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নির্দেশ দিলেন যে আমি ব্যক্তিগতভাবে গিয়ে ওই ফিল্মগুলো নিয়ে এসে তাঁকে দিই। সঙ্গে বললেন যে পারলে দেখে আসতে যে ওই সব হত্যাকারী কী করেছে। ততক্ষণে জানাজানি হয়ে গেছে যে ওই বাড়িতে পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। বুকে কম্পন ধরল। জানি না সেনানিবাসের বাইরে কী অবস্থা। জনরোষের মুখে পড়তে হবে কি না? এত বড় দল এত নেতা-সমর্থক কোথাও না কোথাও প্রতিরোধ তো হবেই। সঙ্গে দুজন সশস্ত্র সেপাই নিয়ে বের হওয়ার পথে চালককে বললাম, সমস্যা দেখলে ফিরে আসব।
সিঁড়ির দ্বিতীয় ধাপে সাদা পাঞ্জাবি আর চেক লুঙ্গি পরা বিশালদেহী ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী বঙ্গবন্ধুর মরদেহ। পরিচিত চশমাটি ঠিকরে এক পাশে পড়ে রয়েছে। হাতের পাইপটি আরেক পাশে। সিঁড়িতে চাক চাক রক্ত প্রায় জমাট। পাশে সামান্য জায়গা। সেখানে অনেক বুটের দাগ। এগুলো ঘাতকদের বুটের দাগ। থমকে কয়েক মিনিটের বেশি দাঁড়াতে পারলাম না। পা কাঁপছিল।
খুব দ্রুত ফার্মগেট হয়ে নির্মাণাধীন সংসদ ভবন, যেটি সে সময় রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তর এবং সৈনিক লাইন হিসেবে ব্যবহৃত হতো, কোনো সাড়াশব্দ নেই। এই প্রথম সংসদ ভবনের সামনের সড়কে একটি ট্যাংক, তার ওপরে ট্যাংকের সদস্যরা অত্যন্ত বিশৃঙ্খল অবস্থায় হাত-পা ছুড়ে অর্ধশায়িত অবস্থায় বিশ্রাম করছে। ব্যারেলটি সংসদ ভবনের দিকে তাক করা। আমাকে দেখেও না দেখার ভান করল। অভিবাদন তো দূরের কথা। মনে মনে বললাম, যারা বঙ্গবন্ধুর মতো এত বিশাল ব্যক্তিত্বকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করতে পারে, তাদের কাছ থেকে কোনো শৃঙ্খলা আশা করা বাতুলতা মাত্র।
ওই জায়গা পার হয়ে দেখি সোবহানবাগ মসজিদের এক পাশে আরেকটি ট্যাংক অনুরূপভাবে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। এখানেও ওই একই দৃশ্য। কোথাও জনমানবের চিহ্ন নেই। আমি কোনো দিন বঙ্গবন্ধুর বাড়ি দেখিনি। শুধু পত্রিকায় ছবি ছাড়া। মাসখানেক আগে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল (পরে ব্রিগেডিয়ার ও মরণোত্তর বীর উত্তম) জামিলের সহায়তায় বঙ্গবন্ধুর অফিসে গিয়েছিলাম আমার সহধর্মিণীকে বরিশাল মেডিকেল কলেজ থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে স্থানান্তরের অনুরোধ নিয়ে। ওই প্রথম বঙ্গবন্ধুর সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। দ্বিতীয়বার ওনাকে দেখা। আমি যখন নিতান্তই বালক, তখন যুবনেতা মুজিবকে দেখেছিলাম। আর এবার এত বড় ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়িয়ে আরজি করেছিলাম। তিনি শোনামাত্রই কর্নেল জামিলকে আমার সমস্যা সমাধান করতে যা করার প্রয়োজন, করতে বললেন। আমি অভিভূত হয়েছিলাম। তিনি আমাকে কখনো দেখেননি, কিন্তু আমার সমস্যার কথা শুনে আর কিছুই জিজ্ঞাসা না করে সমাধান করতে বলেছিলেন।
এসব মনে করতে করতে প্রথমবারের মতো জাতির পিতার বাড়ির সামনে নামলাম। গেটে দাঁড়ানো ক্যাপ্টেন বাশার। আমার পরিচিত প্রথম ফিল্ড রেজিমেন্টে চাকরিরত (প্রয়াত লে. কর্নেল অব.) অভিবাদন দিয়ে বললেন যে তিনি অপেক্ষায় ছিলেন ফিল্মগুলো হস্তান্তর করতে। তিনটি ফিল্ম একটি বিটিভির রোল, অপর দুটি পত্রিকার। মাত্র চারটি পত্রিকাই তখন প্রকাশিত হতো। বাশার জানালেন যে এগুলো যাতে অন্য কারও হাতে না পড়ে, এমনই এক ঘাতক ছবিগুলো বাশারের হাতে দিয়ে সেনানিবাসে পাঠাতে বলেছে। বাশার জানালেন যে তাঁর ডিউটি ছিল সাতটা থেকে। তাঁকে ও তাঁর সৈনিক দলকে প্রায় হত্যাযজ্ঞ ঘটার পর মোতায়েন করা হয়।
আমি বাশারের হাত থেকে রোলগুলো নিয়ে সামনের সেই বিখ্যাত বারান্দার দিকে তাকালাম। বলতে পারব না মনের অবস্থা কী ছিল। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। সাধারণ মধ্যবিত্তের বাড়ির মতো। আশপাশে প্রায় গায়ে গায়ে লাগানো বাড়িগুলো। গতকাল গভীর রাত পর্যন্ত কত দর্শনার্থীতে গমগম করেছিল আর এই মুহূর্তে কবরস্থানের মতো নীরব, কোনো মানুষের ছায়াও দেখিনি। আমি শুনেছিলাম, আমার অতি পরিচিত কর্নেল জামিলকেও বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে এখানে পৌঁছার আগেই সোবহানবাগ মসজিদের সামনে সৈনিকদের সঙ্গে কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে তাঁকে হত্যা করা হয়।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম। মনে হলো পা কাঁপছে। বাশার বললেন যে কর্নেল জামিলের মরদেহ গ্যারেজে তাঁর গাড়িতেই রক্ষিত, দেখব কি না? মুখ দিয়ে কিছুই বলতে পারলাম না। আমার এই অত্যন্ত প্রিয় মানুষটিকে শেষবারের মতো দেখতে গেলাম। গাড়ির পেছনের সিটে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা কর্নেল জামিলের সর্বদা হাসিমুখটি দেখে কুঁকড়ে উঠেছিলাম। শুনলাম, বঙ্গবন্ধু তাঁর বাড়ি আক্রমণ হলে তোফায়েল আহমেদ, সেনাপ্রধানসহ যে কতিপয় ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিলেন—কর্নেল জামিল ছিলেন তার মধ্যে একজন। তিনি বঙ্গবন্ধুর ডাকে জীবন দিয়ে তাঁর সৈনিকের কর্তব্য এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি আনুগত্যের প্রমাণ দিয়ে গেছেন। তাঁর এই ত্যাগ ছিল বীরোচিত।
আমার মন ভীষণ ভারাক্রান্ত, ভাবছিলাম চলে আসব। বাশার বললেন, আমি যেন ভেতরে গিয়ে দেখি কী নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে আমাদেরই পরিচিত এই জনাকয়েক উচ্ছৃঙ্খল কর্মকর্তা। একটু দম নিয়ে ভেবে বাশারের পিছু নিলাম। রিসেপশনে চোখে পড়ল একজন পুলিশ কর্মকর্তার মরদেহ ইউনিফর্মে সামনের টেবিলের ওপরে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে। বাশার জানালেন, বাড়িতে ঢুকতে প্রধান গেটের চাবি দিতে অস্বীকৃতি জানালে তঁাকে হত্যা করা হয়েছে। পরে ঘাতকেরা তালা ভেঙে ঢুকেছে। আমি নিশ্চুপ, বুকের ভেতরে কাঁপন ধরেছে। নিচের তলায় গেস্টরুমে দেখলাম বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের ও তাঁর সঙ্গে থাকা আরেকজনের মরদেহ।
সেদিন সামান্য বেসামরিক প্রতিরোধ গড়ে তুললেও ইতিহাস অন্য রকম হতো। পরবর্তী ঘটনাগুলো হয়তো রোধ করা যেত। এখন এত বছর ধরে আমাদের প্রজন্মের যাঁদের দেখি, বঙ্গবন্ধুর নামে আবার প্রাণ দেওয়ার কথা বলেন, আশ্চর্য হই। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা নিজেও এ সম্পর্কে একাধিকবার বলেছেন।
বাশারের পিছু পিছু ভেতরের দোতলার সিঁড়ি বেয়ে প্রথম ল্যান্ডিং পার হতেই হৃৎস্পন্দন আরও বাড়ল। সিঁড়ির দ্বিতীয় ধাপে সাদা পাঞ্জাবি আর চেক লুঙ্গি পরা বিশালদেহী ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী বঙ্গবন্ধুর মরদেহ। পরিচিত চশমাটি ঠিকরে এক পাশে পড়ে রয়েছে। হাতের পাইপটি আরেক পাশে। সিঁড়িতে চাক চাক রক্ত প্রায় জমাট। পাশে সামান্য জায়গা। সেখানে অনেক বুটের দাগ। এগুলো ঘাতকদের বুটের দাগ। থমকে কয়েক মিনিটের বেশি দাঁড়াতে পারলাম না। পা কাঁপছিল। যে অঙ্গুলির তর্জনে বাঙালি জেগেছিল স্বাধীনতায়, সে আঙুলটি ক্ষতবিক্ষত। বঙ্গবন্ধুর মুখটি প্রশান্ত। অকুতোভয় এই নেতা মৃত্যুকে সামনে দেখেও স্বাভাবিক ছিলেন। মুখ দেখে মনে হলো ঘুমিয়ে রয়েছেন। বুকটি ঝাঁজরা হয়ে গেছে। সাদা পাঞ্জাবিতে রক্তের ছোপ। আমি বাক্রুদ্ধ। কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে আর দাঁড়াতে পারছিলাম না।
বাশার বললেন যে আমি যেন ওপরেও দেখে যাই—কী নির্মমভাবে এরা হত্যা করেছে। এমনকি বাড়ির কাজের মানুষকেও বাদ দেয়নি। আস্তে আস্তে বঙ্গবন্ধুর মরদেহ পাশ কাটিয়ে ওপরে উঠে বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষের পাশের রুমে যা দেখলাম, তা বর্ণনা কীভাবে করব। পরিবারের বাকি সবার মরদেহ এক জায়গায় করা। নববিবাহিত শেখ কামাল ও লেফটেন্যান্ট জামালের স্ত্রীদ্বয়। সর্বাগ্রে অতি সাধারণ একজন নারী, তিনি বঙ্গবন্ধুর পত্নী বেগম ফজিলাতুন্নেছা। ঠিক তাঁর পাশে ছোট শিশু রাসেল। রাসেলকে দেখে আমার নিজের ছেলের কথা মনে হলো। প্রায় সমবয়সী। ভেতরটা ডুকরে কেঁদে উঠল। চোখের পানি আটকে রাখতে পারছিলাম না। এই শিশু আর পরিবারকে যারা এভাবে হত্যা করতে পারে, তারা মানুষ নয়। কর্নেল শাফায়াত জামিল ঠিকই বলেছেন, ‘এরা উন্মাদ হত্যাকারী, ঠান্ডা মাথার খুনি।’
বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। পুরো বাড়িতে রক্ত আর বারুদের গন্ধ। মনে হলো দম আটকে যাবে। নামার পথে বঙ্গবন্ধুকে, যিনি আমাদের জন্য একটি স্বাধীন দেশ দিয়েছেন, মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়ে সালাম দিলাম। তাঁর মৃত্যু কি এভাবে হওয়ার কথা ছিল? ওই মুহূর্তে প্রায় দৌড়ে বের হয়ে লম্বা নিশ্বাস নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। তখন অনেক সময় পার হয়ে গেছে। রাস্তাঘাট আশপাশে খালি। গাড়িতে বসে ফিরছি।
ভাবছিলাম, বঙ্গবন্ধু যে কয়েকজনকে বাড়ি আক্রমণের কথা যাঁরা জানিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে কর্নেল জামিল জীবন উৎসর্গ করলেন। ঘটনার তিন দিন পর ব্রিগেড কমান্ডারসহ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদের বাসায় দেখা করতে গিয়েছিলাম। তাঁর মুখে শুনলাম, তিনি বহু চেষ্টা করেও কোনো নেতার সাহায্য পাননি। এমনকি দেখাও হয়নি। এত বড় বিশাল রক্ষীবাহিনী নীরব দর্শক হয়েছিল। এমনকি তোফায়েল সাহেবকেও তারা সাহায্য করতে পারেনি।
অফিসে ফিরতে ফিরতে বারবার একটি কথাই মনে হচ্ছিল, বঙ্গবন্ধুর জন্য প্রাণ দেওয়ার অঙ্গীকার করা নেতা-কর্মীদের কেউ বের হননি, পাওয়াও যায়নি। কেন এমন হলো? (তৎকালীন রক্ষীবাহিনীর অন্যতম পরিচালক আনোয়ারুল আলম শহীদের রচিত বই রক্ষীবাহিনীর সত্যমিথ্যা, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৩ দ্রষ্টব্য)। এমনকি বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের মরদেহ দাফন করার জন্যও নাকি কাউকে পাওয়া যায়নি। অবশেষে ঢাকা সেনানিবাসের স্টেশন কমান্ডার প্রয়াত কর্নেল আবদুল হামিদের দায়িত্বে বঙ্গবন্ধুর মরদেহ টুঙ্গিপাড়া তাঁর জন্মস্থানে পাঠানো হয়েছিল। আর পরিবারের অন্য সদস্যদের বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছিল।
সেদিন সামান্য বেসামরিক প্রতিরোধ গড়ে তুললেও ইতিহাস অন্য রকম হতো। পরবর্তী ঘটনাগুলো হয়তো রোধ করা যেত। এখন এত বছর ধরে আমাদের প্রজন্মের যাঁদের দেখি, বঙ্গবন্ধুর নামে আবার প্রাণ দেওয়ার কথা বলেন, আশ্চর্য হই। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা নিজেও এ সম্পর্কে একাধিকবার বলেছেন। আমার এই স্মৃতি তো আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে। সত্যি সেলুকাস, বিচিত্র এই দেশ!
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের নিহত সদস্যদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
লেখক : ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)
সান নিউজ/এনএম