আরিফ চৌধুরী শুভ
৫০ বছরের বাংলাদেশ নিয়ে আজ কত হৈচৈ। কত আয়োজন, কত অর্জন, কত স্বার্থকতা আরো কত স্বপ্ন। ভোরের সূর্যের মতো বাংলাদেশ যেন আজ ঝলমল করে জ্বলছে সাফল্যের সেতুতে দাঁড়িয়ে। কিন্তু সাফল্যের বহুমুখী সমীকরণে হিসেবের খাতায় থমকে দাঁড়াতে হয় ১৫ আগস্টের কালরাতের শেষ প্রহরে এসে। সমস্ত অর্জন, স্বার্থকতা আর স্বপ্ন নিমিষেই মিলে গেছে এই রাতের অন্ধকারে। বুলেট বৃষ্টিতে ঝাঁঝরা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বুক। লাল রক্তে পিতার নিথর দেহটি পড়ে ছিল ধানমন্ডির ৩২ নং বাড়িতে। কেউ এগিয়ে আসেনি সেদিন। কেউ না!
ইতিহাসের জঘন্যতম, নৃশংস এই হত্যাকাণ্ড ঘটে ১৯৭৫ সালের এই কালরাতে। এ দিন গোটা বাঙালি জাতিকে কলঙ্কিত করেছিল সেনাবাহিনীর উচ্ছৃঙ্খল কিছু বিপথগামী সদস্য। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক ভবনটি হয়ে পড়েছিল মৃত্যুপুরী। একে একে হত্যা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবাইকে এমনকি ছোট্ট রাসেলকেও। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাহিরে থাকায় সেদিন বেঁচে গেলেন ভাগ্যক্রমে।
যে নেতার জন্ম না হলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না, জীবনের ১৩ টা বছর যিনি জেলখানার সেলে কাটিয়েছেন বাঙালি জাতির অধিকার আদায় করতে গিয়ে, সেই জাতির পিতাকে এমন নির্মম মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে তা কল্পনাই ছিল না করো, এমনকি বঙ্গবন্ধুর নিজেরও। তার নিথর রক্তমাখা দেহটিকে গোসল করানো হয় কাপড় কাচার সাবান দিয়ে। কাফনের কাপড় হিসেবে পরানো হয়, শেখ মুজিবেরই দান করা রিলিফের কাপড়ের কয়েক টুকরো।৭ কোটি মানুষকে মাথা তুলে বাঁচতে শিখিয়েছেন যিনি, ইয়াসির আরাফাত, ফিদেল কাস্ত্রোরা যাকে নিজেদের অনুপ্রেরণা মনে করতো, সেই মানুষটার জানাজা পড়ল মাত্র ১৫-১৬ জন। দু:খটা সারাজীবনই করতে হবে আমাদের।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পরের দিন লন্ডনের বিখ্যাত দ্যা ডেইলি টেলিগ্রাম পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছিল, এই করুন মৃত্যুই যদি মুজিবের ভাগ্যে ছিল, তাহলে বাংলাদেশ সৃষ্টির কোনো প্রয়োজন ছিল না। এ কথাতো চিরন্ত সত্য। নিখাঁদ সত্য। এ কথা আমিও বলি আজ। শোকে বিহ্বল একটা জাতি যখন শেখ মুজিবকে স্মরণ করছে, ঠিক তখন কিছু উন্মাদ উল্লাসিত হচ্ছে আরেকটা দলীয় প্রধানের ভুয়া জন্মদিন পালনে। এরা নাকি আবার গণতন্ত্রের মা-বাবা। প্রকারন্তে এরাই পিতা হত্যার ষড়যন্ত্রকারী এবং দেশদ্রোহী, লোভী ও স্বার্থপর জনগণ।
মুজিবের আদর্শ ও উচ্চতা যে হিমালয়ের চেয়েও বড় তা বিশ্ব নেতারাই বলে গেছেন। যুদ্ধে ধর্ষিতা নারীদের যখন পরিবার সমাজ ও স্বজনেরা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং সে খবর ধানমন্ডি ৩২ এ শেখ মুজিবের কানে গেলে তিনি বুক চাপড়ে কেঁদে কেঁদে বললেন, কেউ যদি বীরাঙ্গনাদের পিতার নাম জিজ্ঞেস করে, তবে তোমরা বলে দিও তাদের পিতা শেখ মুজিবুর রহমান আর তাদের ঠিকানা স্থানে লিখে দিও ধানমন্ডি ৩২ নম্বর।
হে প্রজন্ম! তোমরা জেনে রাখো, এমনই ছিলেন আমাদের প্রিয় নেতা বাঙালি জাতির মুক্তির মহানায়ক অবিসংবাধিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবুর রহমান। সেই কালো ফ্রেমের চশমা পরা হিমালয়কে চিনে নিও তোমাদের আত্ম-উপলব্ধি দিয়ে। শুধু কালো কোট পরলেই তুমি মুজিব আদর্শ হবে না, মুজিব আদর্শ ধারণ করতে হলে তোমাকে চিনতে হবে মুজিবকে। দাঁড়াতে হবে অসহায়ের পাশে, হতে হবে সৎ ও সাহসী, পড়তে হবে মুজিব, মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে। তবেই তুমি উজ্জিবীত হবে মুজিব আদর্শে।
আজ যে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে স্বাধীন ভূখণ্ডের ওপরে, তার বয়স অর্ধশত পার হতে চলেছে। এই ৫০ বছরে আমরা যেমন মাথা উঁচু করে বুক ফাটিয়ে স্লোগান দেই, খুশিতে আত্মহারা হই, তেমনি হাহাকার বাড়ে ১৫ আগস্টের কালরাতে।। আজ আমাদের সবকিছুর মাঝে বঙ্গবন্ধু থাকলে কতই না সুন্দর হতো। তখন হয়তো আমরা এতটা বিভক্ত হতাম না। সাম্প্রদায়িকতা আর মৌলবাদ আমাদের গ্রাস করতে পারতো না এতটা। আমাদের এত দাবিও থাকতো না আজ। এই বাংলাদেশ হয়তো বিশ্বের নেতৃত্বশীল দেশগুলোর একটি হতো। আমরা হতাম বিশ্বায়নের বিশ্ব।
যে শোক আজ শক্তিতে পরিণত হয়েছে, আসুন সেই শক্তি দিয়েই সমবেত কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলি ‘তুমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, একাত্তরে জন্ম নেয়া বাঙালির আরেক নাম’।
লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ (মাস্টার্স), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি জাতীয় পাঠাগার আন্দোলন (জাপাআ)