প্রসূন রহমান
চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের মৃত্যুদিন আজ। তাঁর সঙ্গে কাজ করছেন আরেক নির্মাতা প্রসূন রহমান। স্মৃতি ও বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে এ লেখায় তিনি লিখেছেন তারেক মাসুদের অসমাপ্ত স্বপ্নগুলোর কথা।
সময়কাল ২০০৭। জুন মাসের এক বিষন্ন দুপুরবেলায় দেখি, বাংলাদেশ থেকে বিবিসির লাইভ টক শো হচ্ছে। প্রচারকেন্দ্র বাংলাদেশের বিআইসিসি। শেরেবাংলা নগরের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র। বিবিসির হার্ড টকের উপস্থাপক স্টিফেন সাকুর পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন অতিথি আলোচকদের সঙ্গে। আলোচনার বিষয়, বাংলাদেশ ক্যান ডেলিভার ডেমোক্রেসি। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আলোচনায় উপস্থিত আছেন সাবের হোসেন চৌধুরী এবং বিএনপির পক্ষে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা।
আর নিরপেক্ষ বক্তা হিসেবে যাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, তাঁর নাম তারেক মাসুদ। পাশ্চাত্য শিক্ষাক্রমে পাঠলব্ধ দুজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদের মাঝখানে বসেছেন তিনি।
তাঁর পরিচয়, তিনি সমাজসচেতন চলচ্চিত্র পরিচালক। সেদিন দেখেছিলাম, এক চলচ্চিত্র নির্মাতার সমাজ ও রাজনৈতিক চেতনার অন্তর্গত শক্তি, তাঁর শিক্ষা ও মেধার স্ফুরণ, ব্যক্তিত্ব ও যুক্তি উপস্থানের ধার। অন্য ভাষার ওপর তাঁর দখল ও যথার্থ শব্দ প্রয়োগের প্রতিক্রিয়া।
সেদিন জেনেছিলাম সত্যিকার চলচ্চিত্র নির্মাতার সংজ্ঞা ও পরিচয়। আরেকবার জেনেছিলাম, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ওপর ভর করে সৃজনশীল বেশির ভাগ শিল্প যেখানে এসে মিলিত হয়, সেটি চলচ্চিত্র।
তারেক মাসুদের সঙ্গে আমার প্রাথমিক জানা–বোঝার প্রক্রিয়া তারও কিছুটা আগে, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের চলচ্চিত্র বোঝাপড়ার কর্মশালায়। এরপর একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আরও একবার নতুন করে জানা। তাঁর চিন্তা ও দর্শন এবং স্বপ্ন ও পরিকল্পনাগুলোর সঙ্গে পরিচিত ও একাত্ম হওয়া।
তিনি বলতেন, ‘চলচ্চিত্রকে শুধু বিনোদনের মাধ্যম মনে করা হলে এর শক্তিমত্তার দিকটাকে অস্বীকার করা হয়। এটা বুঝতে না পারার ব্যর্থতা। কেউ কেউ হয়তো এটাকে শুধুই বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে দেখতে চায়। কিন্তু আমরা এটাকে চর্চা করি “সিরিয়াস ওয়ার্ক অব আর্ট” হিসেবে।’ বলতেন, একজন সমাজ সচেতন নির্মাতার কাজ হচ্ছে, দর্শকের মনে অস্বস্তি তৈরি করা। প্রশ্ন তৈরি করা। প্রদর্শনী শেষ হয়ে যাওয়ার পর দর্শক আরও কিছুক্ষণ বসে থাকবেন। হাততালি দিতে ভুলে যাবেন। কী যেন নেই, কী যেন থাকার কথা ছিল অথবা নিশ্চিত হতে না পারা একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে খানিক বাদে ভ্রু কুঁচকে প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে যাবেন। সে ভাবনা হয়তো পরবর্তী কয়েক দিন তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াবে। হয়তো একসময় ভুলে যাবেন, কিন্তু এর রেশ থেকে যাবে দীর্ঘকাল।
‘আদম সুরত’, ‘মুক্তির গান’, কিংবা ‘মাটির ময়না’— হয়তো একেকটি নাম, একেকটি চলচ্চিত্র তো বটেই, কিন্তু শেষ হওয়ার পরও এর রেশ থেকে যায়। বুকের ভেতর খানিকটা শুন্যতা এসে ভর করে। প্রদর্শনী শেষে হাততালি দেওয়ার প্রয়োজন থাকে না। ভাবনার খোরাক হাতে আসে অনেক। ‘অর্ন্তযাত্রা’ কি একই রকম? বা ‘রানওয়ে’? ‘রানওয়ে’ বোধ হয় ভাবনার খোরাক জোগায় একটু বেশি। ‘রানওয়ে’ হয়তো এই অন্ধ-বন্ধ সময়ের ভিজ্যুয়াল মেটাফর।
সত্যজিৎ রায়ের ‘অপু ট্রিলজি’র মতো একটা অসাধারণ ট্রিলজি নির্মাণের স্বপ্ন দেখতেন তারেক ভাই। সেই ভাবনা থেকেই ‘কাগজের ফুল’–এর বীজবপন। এটা হতো প্রিকুয়েল। জানতে চেয়েছিলাম, যখন ‘মাটির ময়না’র সিকুয়েল নির্মাণ করবেন, তখন কোন গল্পটা বেছে নেবেন? প্রথমবার বলেছিলেন, ‘এত দিন কি বাঁচব?’ উত্তরের জন্য নাছোড়বান্দার মতো লেগে ছিলাম। যদি বাঁচেন, তাহলে কোন গল্পটা বেছে নেবেন? চোখমুখ উজ্জ্বল করে বলেছিলেন, ‘ “মাটির ময়না”র আনুর বড় হয়ে ওঠার গল্প। আমার যৌবনের গল্প।’
একজন নির্মাতার ক্রমেই পরিণত হয়ে ওঠার পথে যে যাত্রা, সেই যাত্রা তার একান্ত নিজস্ব হলেও তা থেকে যে প্রাপ্তি ঘটে, তা অন্য সবারই—তার দর্শকের, নিজস্ব জনগোষ্ঠীর। কিন্তু পরিণত হয়ে ওঠার পর যখন তার সবচেয়ে ক্ষুরধার কাজটি করার সময় আসে এবং তখনই যদি সে হারিয়ে যায়, সে ক্ষতি কার? সে ক্ষতিও আসলে দর্শকের এবং জনগোষ্ঠীরই। তারেক মাসুদ বোধ হয় পরিণত হয়ে ওঠার শীর্ষে পৌঁছেছিলেন। এই দেশে একজন সৃজনশীল মানুষ যতটা উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেন, ঠিক ততটাই।
সত্যজিৎ রায়ের ‘অপু ট্রিলজি’র মতো একটা অসাধারণ ট্রিলজি নির্মাণের স্বপ্ন দেখতেন তারেক ভাই। সেই ভাবনা থেকেই ‘কাগজের ফুল’–এর বীজবপন। এটা হতো প্রিকুয়েল। জানতে চেয়েছিলাম, যখন ‘মাটির ময়না’র সিকুয়েল নির্মাণ করবেন, তখন কোন গল্পটা বেছে নেবেন? প্রথমবার বলেছিলেন, ‘এত দিন কি বাঁচব?’ উত্তরের জন্য নাছোড়বান্দার মতো লেগে ছিলাম। যদি বাঁচেন, তাহলে কোন গল্পটা বেছে নেবেন? চোখমুখ উজ্জ্বল করে বলেছিলেন,‘ “মাটির ময়না”র আনুর বড় হয়ে ওঠার গল্প। আমার যৌবনের গল্প।’ সেই যৌবনের গল্প আমরা কিছুটা জেনেছিলাম। ছিলেন মাদ্রাসার ছাত্র। সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়। তারপর একদিন তিনি হয়ে উঠলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা। তারেক মাসুদের বেড়ে ওঠার গল্পটা সিনেমার মতোই অথবা গল্পের চেয়ে কিছুটা বেশি। কিন্তু আমরা বঞ্চিত হলাম সেই ট্রিলজি থেকে। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে যোগ হওয়ার মতো আরও দুটি স্বর্ণপালক আগস্টের এক বৃষ্টির দিনে মহাসড়কের পিচঢালা পথে তাঁর প্রাণের সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেল।
চলচ্চিত্র বিষয়ে আব্বাস কিয়ারোস্তামির একটি কথা তারেক ভাইয়ের খুব প্রিয় ছিল, ‘সিনেমা ইজ আ সিরিজ অব লাইজ, সেইড টু পুট ইন ফ্রন্ট অব আস দ্য গ্রেটার ট্রুথ।’ চলচ্চিত্র হচ্ছে মিথ্যার মালা দিয়ে গাঁথা এমন এক প্রচেষ্টা, যা আমাদের সামনে এক বৃহত্তর সত্য বলার চেষ্টা করে। কিয়ারোস্তামির এই কথা চলচ্চিত্রের দার্শনিক দিক মাথায় রেখে বলা হলেও, তারেক ভাই নির্মাণের প্রক্রিয়াটি মাথায় রেখে একই কথা রিফ্রেজ করে বলতেন, ‘ফিল্ম মেকিং ইজ অ্যান আগলি প্রসেস হুইচ ইজ ইন্টেন্ডিং টু ক্রিয়েট আ গ্রেটার বিউটি।’
তবে এই দৃশ্যময় পৃথিবী থেকে মিলিয়ে যাওয়ার পরও কতভাবে জড়িয়ে আছেন তিনি আমাদের জীবনে! আমাদের মুক্তির গানে গানে, আমাদের অন্তর্গত যাত্রায়, আমাদের স্বপ্ন ও মননে। তাঁর বলে যাওয়া কত কথা, সৃজনশীল কত কাজের সমাহার, কত কত উচ্চারণ আর উদ্বেলিত হাসির শব্দ আমাদের চারপাশ ঘিরে থাকে। তারেক ভাই, ভাবতে ভালো লাগে না আপনি নেই। তবুও আজ এক দশক পূর্ণ হতে যাচ্ছে আপনি নেই, এটাই সত্যি।
চলচ্চিত্র বিষয়ে আব্বাস কিয়ারোস্তামির একটি কথা তারেক ভাইয়ের খুব প্রিয় ছিল, ‘সিনেমা ইজ আ সিরিজ অব লাইজ, সেইড টু পুট ইন ফ্রন্ট অব আস দ্য গ্রেটার ট্রুথ।’ চলচ্চিত্র হচ্ছে মিথ্যার মালা দিয়ে গাঁথা এমন এক প্রচেষ্টা, যা আমাদের সামনে এক বৃহত্তর সত্য বলার চেষ্টা করে। কিয়ারোস্তামির এই কথা চলচ্চিত্রের দার্শনিক দিক মাথায় রেখে বলা হলেও, তারেক ভাই নির্মাণের প্রক্রিয়াটি মাথায় রেখে একই কথা রিফ্রেজ করে বলতেন, ‘ফিল্ম মেকিং ইজ অ্যান আগলি প্রসেস হুইচ ইজ ইন্টেন্ডিং টু ক্রিয়েট আ গ্রেটার বিউটি।’ বলার জায়গা থেকে দুজনের পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন হলেও দুটো কথাই দুজনের অভিজ্ঞতাজাত সৃজনশীল অভিজ্ঞান। নিজেদের কাজগুলো করতে গিয়ে এসব কথার আক্ষরিক প্রমাণ নিয়মিতই পেয়ে আসছি আমি। তবু ‘গ্রেটার ট্রুথ’ বলার প্রচেষ্টা আর ‘গ্রেটার বিউটি’ সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষায় প্রতিনিয়ত আগলি প্রসেসের মধ্য দিয়ে যাওয়ার এক আনন্দ-বেদনার সৃজনশীল অভিযাত্রা চলমান।
‘মাটির ময়না’র আয়শা চরিত্রের মুখে উচ্চারিত একটি সংলাপ তারেক ভাইয়ের নিজেরও খুব প্রিয় ছিল, ‘ব্যথা যে দেয়, তারও তো ব্যথা থাকতে পারে’। তারেক ভাই, কত অবলীলায় জীবনের গুঢ় অনুভূতির কথা আপনি বলে গেছেন নানা ভঙ্গিতে। ব্যথা আপনিও দিয়েছেন আমাদের। আপনার অবেলায় চলে যাওয়া পুরো জাতি নিজের শরীরে ক্ষত হিসেবে দেখেছে। সৃজনশীল প্রাণের এমন অপচয় কে মানতে পারে! কিন্তু আপনার নিজের ব্যথা কি অনেক বেশি ছিল? জানা হলো না।
তারেক ভাই বলতেন, কাজের দিক থেকে প্রত্যেক সৃজনশীল মানুষের তিন ধরনের পরিকল্পনা থাকা উচিত—স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি। এই বিভিন্ন মেয়াদি পরিকল্পনারও ‘বিকল্প’ থাকতে পারে। সে অনুযায়ী ‘কাগজের ফুল’ নির্মাণ যখন পরপর দুইবার পিছিয়ে দিতে হয়, সে সময়ই তিনি উদ্যোগ নেন ‘রানওয়ে’ নির্মাণের। ‘রানওয়ে’ যেহেতু বিকল্প হিসেবে এসেছে, তাই এটাকে বলতেন অন্তর্বর্তীকালীন প্রজেক্ট।
তাঁর পরিকল্পনার মধ্যে ছিল, ‘কাগজের ফুল’ যদি কোনো কারণে আরও একবার স্থগিত করতে হয়, তাহলে নতুন একটি প্রজেক্ট হাতে নেবেন। সেটি হবে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আরেকটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। প্রাথমিকভাবে গল্প নির্বাচন করা ছিল আগে থেকেই। তবে সেটি বলা বারণ ছিল বলে আজও অনুক্তই থাকছে।
অসমাপ্ত কাজসহ তাঁর নির্মাণ পরিকল্পনার তালিকায় যা ছিল, তা–ও খুব ছোট নয়। ভাষা আন্দোলন এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ধারণকৃত দুটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র অসমাপ্ত রয়ে যায়। পরিকল্পনায় ছিল বাংলাদেশের উৎসব নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের। স্বপ্ন ছিল তিন ‘দিন/দীন’–এর ওপর একটা তথ্যচিত্র নির্মাণের। অর্থাৎ জয়নুল আবেদিন, জসিমউদ্দীন ও আব্বাসউদ্দিনের ওপর। বেঁচে থাকলে কোন স্বপ্নটা সফল হতো আর কোনটা হতো না, আমরা তা জানি না। কিন্তু আমরা তো হারিয়ে ফেললাম স্বপ্ন দেখার মানুষটাকেও। আবার এটাও ঠিক যে তারেক মাসুদকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি সত্যি, কিন্তু তাঁর স্পিরিট আছে সবখানে।
একান্ত আপনজনের মৃত্যু কখনো কখনো আমাদের জীবন থামিয়ে দেয়। অর্থহীন মনে হয় বেঁচে থাকা। তবে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই আবার সবকিছু চলমান হয়ে ওঠে। উঠতে হয়। তারেক ভাইয়ের সহধর্মিনী ও সহযোদ্ধা ক্যাথরিন মাসুদও তাঁর জীবনকে চলমান করে তোলার চেষ্টা করেছেন তারেক ভাইয়ের অসমাপ্ত কাজগুলো এগিয়ে নেওয়ার জন্য। তাঁর সেই স্বপ্ন ও প্রত্যয়ের সঙ্গী হয়ে রয়েছি আমরা কেউ কেউ এক দশক ধরেই। নিজেদের স্বপ্ন ও কর্মপরিকল্পনার পাশাপাশি সেসব অসমাপ্ত স্বপ্নও আমাদের পিছু ছাড়বে না কখনোই।
সান নিউজ/এমএম