ড. ইঞ্জিনিয়ার মো. আমজাদ হোসেন
বর্তমানে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারীর বিস্তারে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ড ও স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। মহামারীর এ সময়ে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাও অনেকটা ব্যাহত হচ্ছে, যা শিক্ষার্থীবান্ধব নয়।
বাংলাদেশে প্রযুক্তিগত সুবিধা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষা প্রদান ও শিক্ষা গ্রহণ কাঠামো অনেকটা সেকেলেই রয়ে গেছে। মহামারী করোনা দেশে আসার অর্ধ-সহস্রাধিক দিন পার করেছে, কিন্তু শিক্ষার জায়গাটি মনে হচ্ছে একই স্থানে ঘুরপাক খাচ্ছে সঠিক সিদ্ধান্ত ও নীতিমালা প্রণয়ন আর সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায়।
করোনাকালীন স্বাস্থ্যনীতি অনুসরণ করে এবং শিক্ষার যথাযথ মান বজায় রেখে শিক্ষা ব্যবস্থা কিভাবে চালিয়ে নেয়া যায় সেদিকে গুরুত্ব দেয়া আবশ্যক। করোনা মহামারীর এ সঙ্কটকালীন যেখানে বিশ্বে মৃত্যুর মিছিল ভারি হচ্ছে, সেখানে উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ব্যবস্থায় খুব বেশি ভাটা পড়েনি। বরং করোনার সময় শিক্ষা ব্যবস্থাকে তারা আরও উন্নত ও ডিজিটাইজড করেছে।
উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় শ্রেণীকক্ষের পাঠদান হাইব্রিড (সরাসরি ও অনলাইনে) আর পুরোপুরি অনলাইন ব্যবস্থায় (লাইভ ক্লাস এবং রেকর্ডেড ক্লাস)। অনলাইনে শিক্ষার মান বজায় রাখা নিয়ে করোনাকালীন শিক্ষা ব্যবস্থার সম্ভাব্য সমাধান নিয়েই আলোচনা করব।
করোনাকালীন পঠিত বিষয়ের বিস্তারিত পাঠ্যসূচী, একাডেমিক ক্যালেন্ডার ও পরীক্ষা (সরাসরি ও অনলাইনে) গ্রহণের সময়কাল সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সুষ্ঠু ধারণা না থাকার ফলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। করোনাকালীন প্রেক্ষাপটে উক্ত সমস্যাটি গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিটি বিষয়ে কতগুলো ক্লাস, লিখিত পরীক্ষা, মৌখিক পরীক্ষা ও কুইজ নেয়া হবে এবং মেধা ও মান যাচাইয়ের জন্য পাঠ্যসূচী প্রণয়ন ও গ্রহণের নির্দিষ্ট তারিখ, প্রদত্ত বিষয়বস্তুর সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা একাডেমিক ক্যালেন্ডারে উল্লেখ থাকবে।
সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী হওয়ার কারণে সেমিস্টার পরবর্তী সময় তার অন্যান্য কাজ ও পড়ালেখা নির্বিঘ্নে চালিয়ে নিতে পারছে। শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকরা ক্লায়েন্ট টেকনোলজি ব্যবহার করতে পারে, যেখানে সকল পঠিত বিষয়ের সকল বিষয়বস্তু আপলোড করে দেয়া হয়। প্রতিটি অনলাইন ক্লাস সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা থাকবে, যাতে করে শিক্ষার্থীরা পরবর্তীতে ভিডিও ক্লাসটি দেখে সহজেই শিখে নিতে পারে।
তাই করোনাকালীন প্রেক্ষাপটে শুরুতেই পঠিত বিষয়ের সময়কাল, বিস্তারিত পাঠ্যসূচী ও একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রদান করা হলে শিক্ষার্থীদের বিষয়ের রূপরেখা সম্পর্কে পরিষ্কার ও বিস্তর ধারণা থাকবে এবং আগ্রহ হারানোর বিষয়টিও দূর করা যাবে।
করোনাকালীন লেখাপড়ার ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থী আলাপচারিতার বা সাহায্য নেয়ার প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। একজন শিক্ষককে ক্লাসের সময় ছাড়া প্রতি সপ্তাহে নিদিষ্ট সময় জুম/গুগল মিট/গুগল ক্লাসরুম/অনলাইন এলএমএস সফটওয়্যায়ে শিক্ষার্থীদের জন্য রাখতে হবে, যাতে করে শিক্ষার্থীরা ওই নির্দিষ্ট সময় শিক্ষকের সহায়তা নিতে পারে।
শিক্ষার্থীদের জন্য বাড়তি সাক্ষাতকার সময় দেয়ার বিষয়টিও সব বিষয়ের পাঠ্যসূচীতে শিক্ষক অন্তর্ভুক্ত রাখবেন। এছাড়া শিক্ষার্থীদের নিজেদের ব্যক্তিগত যোগাযোগের জন্য আলোচনা ফোরাম করে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করতে পারে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীরা দলভিত্তিক পড়ালেখার জন্যও এটি ব্যবহার করতে পারে।
করোনাকালীন সব অনুষদ বা বিভাগের সব বিষয়ে অনলাইনে পড়ানোর সম্ভাব্যতা না থাকা। যে ক্লাসগুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সরাসরি সাক্ষাত অপরিহার্য এসব ক্লাসের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতি সপ্তাহের কোভিড পরিসংখ্যান পর্যবেক্ষণ করে শ্রেণীকক্ষে অথবা ল্যাবরেটরিগুলোতে ছাত্ররা আগে থেকে আবেদন করলে তবেই সুযোগ পাবে। প্রকৌশলের অনেক বিষয়েরই সিমুলেশন সফটওয়্যার ব্যবহার করা যেতে পারে।
একটি ইলেকট্রিক্যাল এ্যান্ড ইলেকট্রনিক সার্কিট খুব সহজেই সিমুলেটর দিয়ে তৈরি করা যায়। কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের ব্যবহারিক অনেক কোর্সে সহজেই অনলাইনে গ্রহণ করা যায়। কিছু বিষয়ে অনলাইনে পড়ানোর অসম্ভাব্যতা রয়েছে। পরবর্তীতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে শিক্ষার্থীরা সেই অংশটি শেষ করলে তাদের গ্রেডটি পেয়ে যাবে। এক্ষেত্রে বিভাগের বিকল্প সমমানের কোর্সও শিক্ষার্থীরা সম্পন্ন করতে পারে।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পরীক্ষা সরাসরি ও অনলাইনে গ্রহণের জন্য নির্দেশনা প্রদান করেছে। অনেক শিক্ষক অনলাইনে পরীক্ষা নেয়ার ক্ষেত্রে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র জুম/গুগল মিট/গুগল ক্লাসরুম/অনলাইন এলএমএস সফটওয়্যারে আগে থেকেই আপলোড করে রাখতে পারেন, যা শুধু নির্ধারিত সময়ই শিক্ষার্থীর নিকট দৃশ্যমান হবে।
পরীক্ষা নেয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকরা লকডাউন ব্রাউজার ব্যবহার বাধ্যতামূলক ব্যবহার করতে পারে। এতে ছাত্রটি ওই ব্রাউজার ছাড়া অন্য কোন পেজ ব্রাউজ করলে তার পরীক্ষাটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে শেষ হয়ে যাবে।
এখানে শিক্ষার্থীকে অবশ্যই ভিডিও অন করে রাখতে হবে। অনলাইনে পরীক্ষার কার্যকারিতা এবং শিক্ষার্থীরা ইমেল/টেক্সট করা, নিজস্ব ডিভাইসে থাকা উত্তরের সহায়তা নেয়া, গুগল, ইয়াহু বা অন্য কোন সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করে তথ্য/উত্তর তৈরি করে অসাধু উপায় অবলম্বনের সম্ভাবনার সুযোগ পায়। তবে শিক্ষার্থীদের যদি প্রশ্নপত্র ও উত্তরের বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা না থাকে তবে এ স্বল্প সময়ে কৌশলটি অবলম্বন করে উত্তর তৈরি করা বেশ কঠিন বিষয় আর প্রযুক্তিগত উচ্চমাত্রার জ্ঞানহীনদের জন্য কষ্টকর বা প্রায় অসম্ভব।
বৈদ্যুতিক কারণ, যান্ত্রিক ত্রুটি বা ইন্টারনেট সংশ্লিষ্ট প্রতিবন্ধকতার কারণে কোন পরীক্ষার্থী পরীক্ষা চলাকালীন গুগল ক্লাসরুম অথবা জুম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে অথবা উত্তরপত্র নির্ধারিত সময় আপলোড করতে ব্যর্থ হলে তাকে নিদিষ্ট সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ঠ প্রত্যাবেক্ষককে অবহিত করতে হবে। এক্ষেত্রে যদি কোন শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয় অথবা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উত্তরপত্র জমাদানে (আপলোড) করতে ব্যর্থ হয় তবে তার পরীক্ষা পরবর্তীতে গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লেন্ডেড লার্নিং শিক্ষা ব্যবস্থা, মূল্যায়নের নীতিমালার বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়ন, কার্যকর ব্যবস্থা উন্নয়ন ও উপস্থাপন করা দরকার।
করোনাকালীন সেমিস্টার শেষে সকল বিভাগের শিক্ষার যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণের নিশ্চয়তা বজায় না থাকা। সেমিস্টার শেষে প্রমাণ হিসেবে শিক্ষককে মূল্যায়ন ফল জমা দিতে হবে। সকল শিক্ষার্থীর ক্যাটাগরিভিত্তিক মূল্যায়নের ফলও জমা দিতে হবে। তাই শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের পক্ষ থেকেই দায়সারাভাবে করোনা মহামারীর অজুহাত দেখিয়ে কোনভাবেই সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে একটি কোর্স পড়াবার সুযোগ নেই। শিক্ষার গুণগত মান নিয়ন্ত্রণের নিশ্চয়তাটি এবং সেইসঙ্গে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্যও খুব সহায়ক হবে।
সকল অনুষদ/বিভাগ এবং শিক্ষার্থী দ্বারা শিক্ষকের মান যাচাই ও মূল্যায়ন না থাকা। প্রতিটি সেমিস্টার শেষে শিক্ষার্থীরা নিজেদের পরিচয় গোপন করে শিক্ষককে মূল্যায়ন করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল অনুষদ/বিভাগ পরে শিক্ষককে শিক্ষার্থীর প্রদত্ত মূল্যায়ন ফলটি পাঠাবে। করোনাকালীনও সকল বিভাগে বিষয়টি বাধ্যতামূলক করতে হবে। এই পদ্ধতিটি শিক্ষকদের কাজের প্রতি দায়িত্বশীল হতে এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও একটি বিভাগের সামগ্রিক লক্ষ্য সম্পর্কে জানতেও সাহায্য করবে।
শিক্ষকদের অনলাইনে পড়ানোর যোগ্যতা হিসেবে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী অনলাইন শিক্ষাদান কর্মশালার আয়োজন করতে হবে। সকল অনুষদের সকল শিক্ষককে অনলাইন শিক্ষাদান কর্মশালায় অংশগ্রহণ করতে হবে। সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জামাদি প্রদান করে শিক্ষকদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান আরও বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিকল্পনা করতে হবে।
বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস নেয়া হচ্ছে, কিন্তু অল্প কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি সেটি পরে এক সময় নেয়া হবে। আমাদের আবাসিক ও অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের কিছু অংশ মাত্র করোনা ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ সমাপ্ত করেছে। দ্বিতীয় ডোজও রয়েছে। ভ্যাকসিন প্রদানে নতুন করে বয়সসীমা ২৫ বছর করা হয়েছে। তাতে সকল শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী ভ্যাকসিন পাবেন।
প্রতিনিয়ত আমাদের চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে অগণিত মৃত্যু। প্রিয়জন হারানোর বেদনায় আকাশ-বাতাস ভারি হচ্ছে। মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হচ্ছে প্রিয়জনরা। ডিজিটাল বাংলাদেশ মানে তো এই নয় যে, শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের সুযোগকে সহজলভ্য করে তোলা। বরং সব প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ডিজিটাইজ করা। স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা অনেকটাই এগিয়েছি এবং আমাদের দেশেই অসংখ্য মেধাবী প্রকৌশলী ও শিক্ষাবিদ আছেন, যাদের সমবেত প্রচেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য একটি ডিজিটাইজড শিক্ষা পরিকাঠামো গড়ে তোলা অসম্ভব কিছু নয়।
তাই আশা রাখছি মন্ত্রিপরিষদ এবং শিক্ষাঙ্গনের নীতিনির্ধারকরা আলোচনায় বসে এটির সমাধান করবেন। তবে আমাদের শিক্ষানীতি নির্ধারকরা যদি ইতিহাস থেকে সান্ত¡না খোঁজেন- প্লেগ মহামারীর সময় তো দুই বছর স্কুল-কলেজ সব বন্ধ ছিল আর তাতেই তো নিউটন পেল ভাবনা-চিন্তার বাড়তি সময়, বের করে ফেলল মহাকর্ষের সূত্র আর ক্যালকুলাসের নানা তত্ত্ব, তা হলে হবে না।
দুই বছর পরীক্ষা নেয়া বন্ধ থাকলে আমাদের ছেলেমেয়েরা নিউটন, ডালটন অথবা কি হয়ে বেরিয়ে আসবে জানি না, তবে মহামারী শেষে সেটি সামলে নিতে গিয়ে আমাদের প্রত্যেকেরই যে মাথায় হাত দিয়ে বসতে হবে সেটি সহজেই অনুমেয়। তাই ডিজিটাইজড শিক্ষা প্রদান কাঠামো নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। তা না হলে একদিন হয়ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনবাদ লিখতে হবে আমাদের।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
ইলেক্ট্রিক্যাল এ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
সান নিউজ/এমএম